মিত্র মনোজ - প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য




মিত্র মনোজ

 

প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য


মনোজ মিত্র। ২২ ডিসেম্বর ১৯৩৮ থেকে আজ ১২ নভেম্বর ২০২৪ ভোর আটটা পঞ্চাশ। ছিয়াশিটা বছর। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে কলকাতা। সর্বদিক থেকেই ঈর্ষণীয় ব্যাপ্তি বলতে হবে। ১৯৫৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজের দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতক হন তিনি। কলেজে পড়বার সময় থেকেই নাটকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়া। সেই সময় সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বাদল সরকার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তদের। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন মনোজ। রবীন্দ্রভারতীর নাট্যবিভাগে ‘শিশিরকুমার ভাদুড়ী অধ্যাপক’ হিসেবে পড়িয়েছেন। নাটকের সবচেয়ে সহজে যেটা করা যায়, তা হল পড়ানো। তা মনোজ সেই সহজ কাজেই নিজেকে ফুরিয়ে দেবেন এমন তো নয়, মনোজ মিত্র রচিত ছোটো-বড়ো একাঙ্ক-পূর্ণাঙ্গ নাটকের সংখ্যা একশো-র বেশি বই কম নয়। তাঁর প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ লেখেন ১৯৫৯ সালে। তবে ১৯৭২ সালে বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালনায় মনোজ-রচিত ‘চাকভাঙা মধু’ নাটকের থিয়েটার ওয়ার্কশপকৃত প্রযোজনার মধ্যে দিয়েই সম্ভবত বাংলা থিয়েটার পাড়ার এ কোণ থেকে ও কোণে হঠাৎ এসে পড়ল ‘মনোজাগতিক’ রশ্মিরেখা! যে আলো পরবর্তী চল্লিশ বছরে বাংলা নাটকে একটি একান্ত ‘মনোজীয়’ আলোর মালা তৈরি করেছে। ১৯৫৭-এ বন্ধু পার্থপ্রতিম চৌধুরীর (পরিচালক ও অভিনেতা। পরবর্তীকালে ‘যদুবংশ’ ছবি করে প্রভূত খ্যাতিলাভ করেন) প্রতিষ্ঠিত ‘সুন্দরম’ নাট্যসংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে অলোকসামান্য অভিযাত্রার সুত্রপাত, মাত্র বছর কয়েক আগেই বয়েসজনিত কারণে তাতে ছেদ পড়েছিল। ১৯৮৫ সালে নাট্য রচনার জন্যে সঙ্গীতনাটক আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। নাট্যকার হিসেবে এশিয়াটিক সোশাইটির স্বর্ণপদক, দীনবন্ধু পুরস্কার ও পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি সম্মান তো আছেই। পরবর্তীকালে তপন সিংহ, সত্যজিৎ রায়, তরুণ মজুমদার সহ বহু বিশিষ্ট পরিচালকের ছবিতে স্মরণীয় অভিনয়ের সাক্ষর রেখে গিয়েছেন মনোজ মিত্র।        

মনোজ মিত্রের ত্রি-সত্তা: নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। প্রত্যেকটিতেই তিনি স্মরণীয়, তবে সম্ভবত বাংলা নাটকের ইতিহাস প্রথমত তাঁকে পরিণত স্বাধীনতা (পঞ্চাশের দশকের শেষ, ষাটের শুরু) ও রবীন্দ্রোত্তর কালের এক বর্ণাঢ্য নাট্যকার হিসেবে গোটা একটি পরিচ্ছদে ঠাঁই দেবে। ‘চাকভাঙ্গা মধু’ (১৯৬০), ‘নেকড়ে’ (১৯৬৮), ‘শিবের অসাধ্যি’ (১৯৭৪), ‘নৈশভোজ’-এর মতো নাটকে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শোষিত অন্তেবাসী মানুষের কণ্ঠস্বর, অন্তহীন চোয়ালচাপা সংগ্রাম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যদিও মনোজ কোনদিন কমিউনিস্ট পার্টি বা গণনাট্যের চৌহদ্দি মাড়িয়েছেন বলে জানা নেই। চাকভাঙ্গা মধু-তে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ, লাঞ্ছনা, চরম অনাহারের মধ্যে জেগে ওঠে ‘বাদামী’ জেগে ওঠে সারা গ্রাম জমিদার অঘোর ঘোষের অত্যাচারের শেষ দেখবে বলে!  মনোজ মিত্রের ‘নরক গুলজার’ (১৯৭৬), বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় করেছিল থিয়েটার ওয়ার্কশপ। দর্পিত শাসকের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া বিদ্রুপের প্রতিস্পর্ধা— তখন সেই অদৃষ্টপূর্ব সেন্সারশিপ, ‘রিপ্রেসিভ স্টেট’-এর হিংস্র দাঁতনখ-বের-করা এমারজেন্সি-কাল। মানবের শুভচেতনার উপরে অগাধ বিশ্বাসে ভর করে লেখেন ‘মেষ ও রাক্ষস’ (১৯৭৯) নাটক— নাটকের ঘাত-প্রতিঘাতে মেষচর্ম আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় আর সেই অগ্নিশুদ্ধ মেষ (হীরামন), সুবর্ণ আর নীলকমলের যূথবদ্ধ আক্রমণে রাক্ষসের পতন ঘটা দেখান মনোজ। ‘অশ্বত্থামা’ (১৯৭২/৭৩) নাটকটি মনোজ নতুন পাঠ রচনা করেন, তাতে বিভ্রান্ত অশ্বত্থামার মুখে যখন তিনি সংলাপ বলাচ্ছেন— ‘অন্ধ আমি, শত্রু চিনি না, শত্রুকে আঘাত করতেও পারি না! শেষ মুহূর্তে ভুল করি, একটা দৃষ্টিহীন বিশাল খাঁড়া কাঁধে জনারণ্যে ঘুরে বেড়াই!’ তখন নেপথ্যে যেন জাঁ পল সার্ত্র-র ‘ক্রাইম প্যাসিওনেল’-এর ট্র্যাজিক নায়ক ‘ইয়াগো’ আবির্ভূত হয়— প্রশ্নহীন আনুগত্য, তা সে পার্টির প্রতিই হোক বা ব্যক্তি দুর্যোধন— অশ্বত্থামা আর ইয়াগো একই ধূসর প্রাঙ্গণে একই হাহাকার কণ্ঠে এসে দাঁড়ান!  

ভদ্রতা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বাম রাজনীতির সঙ্গে অন্য কোনরকম যোগ না রেখেও ওই কালে এই গোত্রের রাজনৈতিক চেতনা জারিত নাট্যরচনা একটা প্যারাডক্স যেন। 

অলোকানন্দার পুত্রকন্যা-এ (১৯৮৮) এসে বুঝি এই রহস্যমোচন হল। ব্যাষ্টির যূথবদ্ধতার শক্তিকে অস্বীকার না করে, বরং বলা যেতে পারে তাকে খানিকটা পাশ কাটিয়ে যেন এক বিকল্পতার সন্ধানে মনোজ সর্ব-অমঙ্গল-এর বিরুদ্ধে, সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক ক্লেদের ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব চরিত্রশক্তিকে দাঁড় করালেন। এর গায়ে গায়ে এল ‘শোভাযাত্রা’ তার ‘মলিন বিবর্ণ ঢাউস এক রথ’ (নাট্যকারের প্রথম মঞ্চনির্দেশ) নিয়ে— যুগ যুগ ধরে বিপন্ন ধ্বস্ত পীড়িত মানবতার মিছিল যেন! ‘জলসাঘর’ ছবি করে সত্যজিৎ আগমার্কা ‘বিপ্লবী’দের দুয়ো পেয়েছিলেন; অভিযোগটা ছিল জমিদার বিশ্বম্ভর রায়কে প্রতিভূ করে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের উপরে পরিচালকের মমত্ব(!)। একই গোত্রের ‘বিপ্লবী’রা মনোজের ‘শোভাযাত্রা’র মাধবকাটির জমিদার রায়বাড়ির শেষতম শরিক ধনগোপাল, অতসী আর অটিস্টিক একুশ বছরের শঙ্খকে মঞ্চে দেখে কী বলতে পারেন জানা কথা।  

সত্যি বলতে কী পঞ্চাশোত্তর বাংলা সাধারণ রঙ্গালয় যাকে বলে ‘ম-ম’ করত মনোজ আর মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাটক নিয়েই! তা সে পাড়ার স্টেজ বা অফিস-ক্লাবই হোক বা কলকাতার চৌরঙ্গিপাড়ার বৌদ্ধিক নাটমহল। নাট্য রচনায় উৎপল দত্ত প্রচুর ও প্রবল ছিলেন অবশ্যই, কিন্তু মনোজ বা মোহিতের অধিকাংশ নাটকের মতো ‘আপামরত্ব’ (শব্দটি ‘কয়েন’ করলাম; অর্থ সহজবোধ্য) উৎপল পাননি। মানে, ফস করে কেউ বা কারা ভাবল, ‘আইস নাটক করি’ আর তারা ম্যারাপ বেঁধে আধখানা ‘টিনের তলোয়ার’ বা ‘সূর্যশিকার’ বা একখানা ‘ব্যারিকেড’ নামিয়ে দিল— এমন ঘটেনি। কিন্তু তারাই সোৎসাহে মনোজের ‘সাজানো বাগান’, ‘পাখি’, ‘কালবিহঙ্গ’, ‘চোখে আঙুল দাদা’, ‘আমি মদন বলছি’, ‘কেনারাম বেচারাম’ থেকে ‘রাজদর্শন’ তক অবলীলায় প্রযোজনা করে গেছে, সঙ্গে মোহিতের ‘বাজপাখি’, ‘কণ্ঠনালিতে সূর্য', ‘চন্দ্রলোকে অগ্নিকান্ড’ বা ‘ক্যাপ্টেন হুররা’র মতো নাটক। বাংলা নাট্যমঞ্চের জ্বালানির যোগানের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলেছিলেন মনোজ আর মোহিত মিলে; আজ যার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কী ঘটছে তা বাংলা নাটকের তন্নিষ্ট দর্শকমাত্রেই জানেন। একটি অবশ্য-উল্লেখ্য সতর্কীকরণ এইখানে— যে-কোন বিষয়েই তন্নিষ্ঠার ভিত্তিভূমি শুধুমাত্র বিষয়টির বর্তমানের প্রতি আগ্রহ কিন্তু নয়— ঘটমানতার স্রোতে তার ভূত-ভবিষ্যৎও একই গোত্রের অতন্দ্র অবধান দাবি করে।  মনোজের নাটক (এবং মোহিত) ও সেই প্রসঙ্গে আজকের বাংলা নাটক সম্পর্কে বর্তমান লেখকের এই উক্তির ব্যাখ্যা সেই তন্নিষ্ঠার প্রতীক্ষা করবে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন? কেন মনোজের নাটকের এমন ব্যাপক ব্যবহার, বাংলা নাটক করতে চাইলেই সবার আগে মনোজের নাটকের বই (ও মোহিতের) খোঁজ পড়ে কেন? নয় নয় করে ‘চক্ষুরুন্মীলিতং’-এর পর থেকে চার-সাড়ে চারটে দশক তো কাটিয়ে ফেললাম— আমার বয়েসি যে-কোন শিক্ষিত বাঙালিই এই ঘটনার সাক্ষী আছেন বলে আমার বিশ্বাস।

এই ঘটনাটাকে একটু তলিয়ে দেখা যাক। মনোজের নাটকের বিষয়বৈচিত্র্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তুলবার মতো নির্বুদ্ধি প্রকাশ না করেও যদি একটা বড়ো ও ‘জেনারেল ফ্রেমওয়ার্ক’- তাঁর নাটকগুলোকে রাখতে চাই তো দেখতে পাব, সেই ফ্রেমওয়ার্কের শীর্ষকোণগুলি হল সাধারণ মানুষের জীবনের আলোছায়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়াপাওয়ার খতিয়ান, তার হিসেব-মেলানো, তার লক্ষ্যচ্যূতি ও সেই কারণে হতাশা-সন্তাপ, আবার ফিরে দাঁড়ানো— আর মনোজের এই ‘নাট্যপেটিকা’ বা ‘নাট্য-তোরঙ্গ’-র উপরে নীচে আগাপাশতলায় আঁকা আছে নির্ভেজাল হাস্যকৌতুক আর সূক্ষ্ম শ্লেষ-প্রহসনের ফুলকারি কারুকাজ! যা দিয়ে মনোজ আদিগন্ত পরম কুশলতায় বিছিয়ে দেন তাঁর গ্রহনযোগ্যতার শীতলপাটি।

উদাহরণ দিতে দিতে বেলা গড়িয়ে রাত, রাত ভোর হয়ে যাবে— তবু শেষ হবে না! জরুরি অবস্থার মধ্যে ‘নরক গুলজার' নাটকের সেই গান ‘কেউ কথা বলো না/ কেউ শব্দ কোরো না/ ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন/ গোলযোগ সইতে পারেন না… ভগবানের ছানাপোনা/ দেবতা আছেন নানাজনা/ আয়েসে ফুর্তি করে/ ফ্যাট গ্যাদার করছেন’— হাসতে হাসতে সমস্ত সরকারি সেনসারশিপের মুখে ছুড়ে দেয় স্পর্ধিত চ্যালেঞ্জ। ‘সাজানো বাগান’ থেকে ‘রাজদর্শন’ লাগাতার এই হাসি চলেছে, কখন মুচকি তো কখন ‘হেঃ-হেঃ’ আর কখন ‘হো-হোঃ’! ‘রাজদর্শন’-এ (১৯৮১) মহারাজা নন্দের পুনরুজ্জীবনলাভে ‘শোকাকুলা’ রাণী যশোমতী কুঁজি মন্থরার কাছে বিলাপ করছেন— ‘ওরে কুঁজি, আমি জলে ঝাঁপ দেব, আমি আগুনে পুড়ে মরব!’ আর কুঁজি সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলছে— ‘যে-কোন একটা করো মা, নইলে জলে-আগুনে যে কাটাকাটি হয়ে যাবে!’ ‘রাজদর্শন’-এ লোভী বামুন লম্বোদর, অভিরাম কামার আর শবদেহে লম্বোদরের আত্মার প্রবেশে পুনরুজ্জীবিত নন্দরাজ আমাদের হাসাতে হাসাতেই ক্ষমতালোভ-ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি-দুর্নীতি-স্বজনপোষণ আর শেষে উত্তরণের গল্প শুনিয়ে যায়। ‘কেনারাম বেচারাম’-এ হারানো-মানুষ খুঁজে জায়গামতো ‘ফিট’ করিয়ে দেবার এজেন্ট নগেন পাঁজা পুলিশ ইন্সপেক্টারকে ‘হারিয়ে যাওয়া’ নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আসনে ফিট করবে বলে বিহ্বল করে ফেলে! ‘গল্প হেকিমসাহেব’-এ নদীর ওপারে পলাশপুরের তালুকদার পশুপতি পোদ্দারের সঙ্গে এপারের দরিয়াগঞ্জের ওয়ালী খাঁ-এর বোলবোলাও-এর টক্করে পশুপতির একশো লেঠেল তো ওয়ালীর একশো বারো! পশুপতির হাতে পঞ্চাশ ডাকাত, তো ওয়ালীর ‘পঁচপান্ন’! পলাশপুরের পশুপতিকে উড়িয়ে দিয়ে ওয়ালী বলেন— ‘হারামিটা বিয়া করেছে তিনটা, আমার শাদি গুণে গুণে চারটা!’ তাই না শুনে ওয়ালী খাঁ-এর খাস-চামচা বক্কর উস্কানি দেয়—‘মারে কাট্টা, ভো-কাট্টা! তবে... শুনেছি ভারী কচি নাকি পলাশপুরের ছোটবউটা!’ তা শুনে তাচ্ছিল্যভরে ওয়ালী (অভিনয়ে মনোজ স্বয়ং) বলে—‘কত কচি, উঁ? বলি, ছোটোবউ কত কচি? আমার ছোট বিবির বয়েস... তার বয়েস আর কী বলব, তার বাপের বয়েসই পঁয়ত্রিশ!’ ‘পাখি’ একাঙ্ক নাটকে শ্যামা আর নীতিশের সেই মিষ্টি-করুণ দাম্পত্য! বিবাহবার্ষিকী পালনের ‘বড়লোকি’ শখে হতদরিদ্র নীতিশের এলাহী আয়োজন, ওদিকে তার ভাঁড়ে মা ভবানী; রাগে-ফেটে-পড়া শ্যামার ভাষায়— ‘হাতে হ্যারিকেন!’ তাতেও অদমিত নীতিশের সপাট উত্তর—‘তা হ্যারিকেনের সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভের হাতে হ্যারিকেন থাকবে না তো কি গোলাপের তোড়া থাকবে?’

অথচ একদিনের সেই আনন্দ সমারোহের মধ্যে নীতিশ তার বৃদ্ধা মায়ের চিঠি খুলে পড়তে চায় না, কারণ সে ছোটোবেলা থেকে জানে, ‘কখন কোন চিঠি কোন খবর নিয়ে আসে! ভালো খবর কখন আসে না রে!’ আদিগন্ত দারিদ্রের অসহায়তার মধ্যে দাঁড়িয়েও কয়েকটা ঘণ্টার জন্যে সে সব ভুলে ‘কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ’ গাইতে চায়! ‘কেনারাম বেচারাম’-এ (১৯৭৬) শেষে নিজের বাড়িতে ফিরে এসে নগেন পাঁজাকে বলা বেচারাম চাটুজ্জের সেই সংলাপ— ‘সংসারে আমাদের মতো বুড়ো বাপ মায়েদের অবস্থা কেমন জানো, ওই ইংরেজির অ্যাপোস্ট্রফির মতো— মাথার উপরে সাজানো থাকে, কিন্তু কোন উচ্চারণ নেই!’ ‘কিনু কাহারের থেটার’ বা ‘পুঁটিরামায়ন’-এ অবক্ষয়িত সমাজের নানান ছবির মালা, আর সে মালাগুলো গাঁথা হয়েছে শ্লেষ আর কৌতুকের সুতো দিয়ে। 

উদাহরণের শেষ নেই, মনোজের বেশিরভাগ নাটকের বয়ান বড়ো আটপৌরে, কেমন যেন পাশের বাড়ি বা পাশের পাড়ার কথা‌, অথচ এ সবের পরতে পরতে মিশে থাকে স্বপ্নময়তার হালকা নীলচে জোছনার মতো নরম আলো— ‘গল্প হেকিমসাহেব’-এ হেকিমের তৈরি (ও হারিয়ে-ফেলা) কুষ্ঠের ওষুধটির মতো, যে ওষুধ চাঁদনিরাতের জোছনাপান করলে তবেই কার্যকরী ওষুধ হয়ে ওঠে!

সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলির তুলনায় নাট্যসাহিত্যের কিছু তফাত আছে। তার একটি হল এই যে, সাহিত্যিক বা কবি তাঁদের জীবৎকালে তাঁদের সৃষ্টির কারণে জনতার অভিনন্দনে ভূষিত নাও হতে পারেন, খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা হয়তো জীবৎকালে তাঁদের অনায়ত্ত থাকতেই পারে। হয়তো দেখা গেল, তাঁদের চলে যাবার পরে ভবিষ্যতের মানুষ তাঁদের সাহিত্যকর্ম নতুন করে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হল ও তাঁদের প্রাপ্য সম্মানে অভিষিক্ত করল, এমন হতেই পারে। কিন্তু নাট্যকারের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। যে নাট্যকার তাঁর জীবৎকালে তাঁর নাটকের জন্য জনতার আশীর্বাদ লাভ করেননি, তাঁকে ব্যর্থ নাট্যকার হিসেবে চিহ্নিত করাই যায়। বলে দেওয়াই যায়, তাঁর অবস্থিতিকালের পরে অদূর বা দূর ভবিষ্যতেও তাঁর খাতায় জনপ্রিয়তার কড়ি শূন্যই থেকে যাবে। এটাই নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মনোজ কিন্তু চুড়ান্ত সফল, তিনি তাঁর নাটকের প্রবল কাটতি মারকাটারি জনপ্রিয়তা স্বচক্ষে দেখে, চেটেপুটে উপভোগ করে তবে আজ প্রয়াত হয়েছেন। মনোজ মিত্র তাঁর নাটক নিয়ে তাই অবলীলায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলা থিয়েটারের আড়েদীঘে এক সর্বজনপ্রিয় সর্বজনগ্রাহ্য নাট্যমিত্র হয়ে ছড়িয়ে পড়েন। ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’ নাটকের একেবারে শেষে অলকার দুই কুল-ছাপানো মায়ার মতো ছড়িয়ে যান মনোজ মিত্র। আর তা দেখে রজনীনাথের মতো বলে উঠতে সাধ যায়— ‘খেলাটায় জিতে গেলে তুমি! নো টাইম ইজ দ্য লাস্ট টাইম!’

______________________________________________________________________________

নাট্যকার প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্যের নাটক গল্পগড়ের গল্পগাছাপড়ুন শারদীয় অন্তরীপ ১৪৩১-এ:




মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন