কলকাতা-ত্রয়ীর অর্ধশতক : মৃণাল সেনকে ফিরে দেখা - দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়


 



কলকাতা-ত্রয়ীর অর্ধশতক : মৃণাল সেনকে ফিরে দেখা


দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়


প্রায় দেড় দশকের কঠিন সংগ্রামের পর ছয়ের দশকের শেষে পৌঁছে মৃণাল সেন পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেলেন

১৯৬৮ পর্যন্ত পরিচালক মৃণাল সেনের মার্কশিট ছিল ভয়াবহতেরো বছরে আটটি ছবি, সাতটি বক্সঅফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে এমনকি হেমন্তকুমারের প্রযোজনায় খাস কলকাতা নিয়ে সংগীত-সমৃদ্ধ ছবি নীল আকাশের নীচেও দর্শকদের তেমন আকর্ষণ করতে পারেনি বাংলার প্রযোজককুল হাত গুটিয়েছেন, আকাশকুসুম নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পত্রযুদ্ধ তাঁকে পরিচিতি দিলেও প্রতিষ্ঠা দেয়নি ভাগ্যান্বেষণে ওড়িয়া ভাষায় ছবি করেছিলেন মাটির মনিষ, সে ছবিও তেমন চলল না, উপরন্তু তিনি আবার বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেনএবার তাঁর অপরাধ— তিনি কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্লাসিক উপন্যাসের উপসংহার বদলে দিয়েছেনওড়িশার বুধমণ্ডলী তাঁর মুণ্ডপাত করতে লাগলেনউত্যক্ত মৃণাল সেন তাঁর প্রযোজককে বলেছিলেন সিনেমার ক্রেডিট টাইটল থেকে তাঁর নাম মুছে দিতেব্যাপারটা শেষ অবধি তত দূর গড়ায়নি, কিন্তু এত বিতর্ক আর দর্শকের কাছে পৌঁছোতে না পারার হতাশার ফলে মৃণাল নিজের ওপর ভরসা হারাতে শুরু করেছিলেন

১৯৬৭ সালে মৃণাল দেখলেন তাঁর হাত খালি, কেবলমাত্র সরকারি ফিল্‌ম্‌স ডিভিসন তাঁকে ভারতের ইতিহাসের ওপর একটি চার রিলের তথ্যচিত্র করার কাজ দিয়েছেএই কাজের জন্য তাঁকে প্রায়ই বোম্বে যেতে হত, আরব সাগরের তীরের এই মহানগরটির নাম তখন মুম্বাই হয়নি, সেখানে ভারত সরকারের উদ্যোগে সদ্য জন্ম নিয়েছে ফিল্‌ম ফিনান্স কর্পোরেশন বা FFC, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির বাইরে গিয়ে অন্য জাতের ছবি বানাবার জন্য একটি নতুন সংস্থাফিল্‌মজগতের এক বন্ধুর তাড়নায় মৃণাল সেন বাধ্য হন আট পাতার একটি ফিল্‌মভাবনা কর্পোরেশনকে জমা দিতে দশ বছর আগে মৃণাল সাহিত্যিক বনফুলের ভুবন সোম গল্পটির চিত্রস্বত্ব কিনে রেখেছিলেন, তাঁর মনে হল সেই গল্প থেকে একটা অন্যধরণের ছবি করা সম্ভবএফ এফ সি-র কর্তারা তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে ছবিটি প্রযোজনা করতে রাজি হয়ে গেলেনতৈরি হল ভুবন সোম

এই ভুবন সোম নিয়েই মৃণাল সেনের ভারতীয় সিনেমায় সত্যিকারের আবির্ভাব ষাটের দশকের শুরুতে তাঁর বাইশে শ্রাবণ অনেকের ভালো লেগেছিল, কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিতও হয়েছিল, কিন্তু তাঁর পরবর্তী ছবিগুলি সেই মানের হয়নি প্রকৃতপক্ষে ভুবন সোমকে দিয়েই ভারতীয় সিনেমার নবতরঙ্গও শুরু হয়

ভুবন সোম-এর বিপুল শৈল্পিক ও বাণিজ্যিক সাফল্য শুধু মৃণাল সেনকে নয়, তাঁর সতীর্থ ও সমসাময়িকদেরও বিস্মিত করেছিলএই ছবির নির্মাণের সময় বিদেশে এক প্রশ্নোত্তরের আসরে সত্যজিৎ রায়কে অন্যান্য বাঙালি ফিল্‌মমেকারদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হয় প্রশ্নকর্তা ছিলেন বিখ্যাত পরিচালক লিন্ডসে আ্যান্ডারসনসত্যজিৎ বলেন— ‘গত দশ বছরেরও বেশি... বাংলায় কিছু ইন্টারেস্টিং ও প্রশংসনীয় কাজ হয়েছে ঘটক ও সেন দুজনেই দারুণ, তাঁদের সিনেমা এখানে দেখানো উচিতঘটক হয়তো সিনেমা বানানো ছেড়ে দেবেন, কারণ কেউ তাঁর দায়িত্ব নেবে নাতিনি মদ্যপআর সেন— টাকার জন্য সেন... শুনেছি এখন হিন্দি সিনেমা বানানো শুরু করেছেন

কোনও ব্যাখ্যা বা টীকার প্রয়োজন নেই, তবে মনে হয়, সত্যজিৎ কলকাতায় মৃণালের সগৌরব প্রত্যাবর্তন আশা করেননিহিন্দি সিনেমা নিয়ে উন্নাসিকতা বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে বহুদিনই প্রচলিত, সত্যজিৎ রায়ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না

ফিল্‌ম্‌স ডিভিসনের কাজ ও ভুবন সোম-এর শুটিংয়ের জন্য মৃণাল সেনকে এক বছরের বেশি কলকাতার বাইরে কাটাতে হয়েছিল ১৯৬৯ সালে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরে তিনি দেখতে পেলেন তাঁর পরিচিত আবহের মধ্যেও কিছু পরিবর্তনের আভাস প্রথম চোখে পড়ার মতো পরিবর্তনটার জন্য মৃণাল অনেকদিন ধরেই আশা করে আছেন— তাঁর মতিলাল নেহরু রোডের ছোট্ট ফ্ল্যাটের সামনে প্রযোজকদের গাড়ির ভিড়! সকলেরই সর্নিবন্ধ অনুরোধ— আর-একটা ভুবন সোম চাই! জীবনে প্রথমবার মৃণাল নিজের ইচ্ছামতো ছবি করার সুযোগ পাচ্ছেন!

কিন্তু আরও অনেক বড়ো পরিবর্তনের সংকেত তিনি মনের মধ্যে পেতে লাগলেনপশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগ তখন শুরু হতে চলেছে দীর্ঘ কুড়ি বছরের কংগ্রেসি শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির এক যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলকিন্তু এই শাসন দীর্ঘস্থায়ী হল না যদিও মার্কবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বা সি পি এম এই সরকারে চালকের আসনে ছিল, দলের উগ্রবাদী অংশটি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করে উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়িতে কৃষকবিপ্লবের ডাক দিল সে-ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার ছাত্র বেরিয়ে এসে এই আন্দোলনকে একটা সুস্পষ্ট নাগরিক রূপ দিল, কলকাতা শহর আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল

ছাত্রজীবন থেকে বাম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মৃণাল সেন বাতাসে বারুদের ঘ্রাণ পেলেনপ্রথমেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই পরিস্থিতিতে ভুবন সোম জাতীয় ছবি বানানোর প্রশ্ন ওঠে না, তা বাস্তবতা থেকে পলায়নের সমতুল্যএকজন সমাজসচেতন শিল্পী হিসাবে তিনি সেই পথে চলবেন নাএই অদ্ভুত সময়কে তুলে ধরতে হলে তাঁকেও প্রথাবিরোধী কিছু করতে হবে, এই স্থবির শিল্পমাধ্যমকে একটু ধাক্কা দিতে হবে

মৃণাল সেনের মনে হল তাঁর সামনে তিনটি পথ আছেমধ্য-ষাটে কলকাতায় প্রচুর ব্রেখ্‌ট চর্চা চলছে, মৃণালের মাথায় ঘুরতে লাগল সিনেমার একটা নতুন রূপরেখা তিনি একবার ভাবলেন ব্রেখটীয় এলিয়েনেশন সিনেমায় আনা যেতে পারে তৎকালীন ইউরোপীয় ও ল্যাটিন আমেরিকার সিনেমা ভেরিটে শৈলী-তে সরে গিয়ে স্টুডিয়ো, আলো, বিশাল ক্যামেরা বাদ দিয়ে ছোটো, হাতে ধরা ক্যামেরা নিয়ে ডকুমেন্টারির ভঙ্গিতে ফিল্‌ম বানাতে হবে, এবং সেই ক্যামেরাকে হতে হবে সর্বত্রগামী চিত্রনাট্য লেখার সময় নিটোল গল্পের কথা ভুলে যেতে হবেএই চিন্তার ফসল হল আদ্যন্ত পরীক্ষামূলক ছবি ইন্টারভিউ চিত্রনাট্যর খসড়া মোটামুটি শেষ হয়েছে, মৃণাল প্রযোজক খুঁজছেন, একদিন সকালে এক কয়লাখনির মালিক, দয়াশঙ্কর সুলতানিয়া তাঁর বাড়ি এসে হাজির তিনি সিনেমা বানাতে চান, মৃণালের লেখা নতুন ছবির গল্প শুনতে চাইলেনতখনও চিত্রনাট্য লেখা শেষ হয়নি, মৃণাল সেন মুখে মুখে নায়কের ট্রাম-যাত্রার আখ্যানটি শোনালেনসুলতানিয়া এককথায় ছবিটি পরিবেশনা করতে রাজি হয়ে গেলেন মৃণাল নিজের ব্যানারেই ইন্টারভিউফিল্‌মটি নির্মাণ করেছিলেন তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর পুরোনো সহযোগী আশীষ বর্ম

এখানে বলা দরকার, ইন্টারভিউ-এর বীজ কিন্তু মৃণাল সেনের কল্পনায় অনেকদিন ধরেই সুপ্ত ছিল একজন বেকার যুবকের চাকরি পাবার প্রত্যাশা এবং সেই চাকরি পাবার জন্য তাকে কী কী করতে হয়, এই বিষয় নিয়ে তিনি অনেকদিন ধরে চিন্তা করেছেনআশীষ বর্মণ ‘আকাশ কুসুম গল্পটিরও লেখক ছিলেন, তাঁর সহযোগিতায় ইন্টারভিউ অনেকটা আকাশ কুসুম-এর পরিপূরক হয়ে উঠল কিন্তু অনেক বেশি শানিত, অনেক বেশি চমকদার

দুটো ফিল্মের মধ্যে মিলগুলো একবার লক্ষ করা যাক— আকাশ কুসুম-এর নায়ক অজয় এবং ইন্টারভিউ-এর নায়ক রঞ্জিত দু’জনেই বিধবা মায়ের একমাত্র পুত্র এবং দু’জনের ওপরেই সংসারের ভার (রঞ্জিতের আবার একটি অবিবাহিত বোনও আছে) দু’জনেই গরিব হলেও ঝকঝকে সুপুরুষ চেহারা, দু’জনেই ধনীর মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বলা যেতে পারে অজয় চাকরি করার চেষ্টা করলে কী হত ইন্টারভিউ যেন তারই উপাখ্যানমৃণাল সেন কোনওরকম ভণিতা না করেই নিজের এই ফিল্‌মটি সম্পর্কে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন— আকাশ কুসুম হল ঈশপের গল্পের ময়ূরপুচ্ছধারী বায়সের ময়ূর সাজার আধুনিক সংস্করণসেই শুনে সত্যজিতের অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া ছিল— “A crow-film is a crow-film is a crow-film.

ইন্টারভিউ-এর নায়ক গোটা ছবি ধরে একটা স্যুট খুঁজে বেড়ায়দু’জনেই চায় সমাজের একটু উপরতলায় উঠতে, কিন্তু দু’জনেই ব্যর্থ হয় আর এখানেই এল পার্থক্য— আকাশকুসুমের অজয় হার মেনে নিয়েছিল, কিন্তু ইন্টারভিউ-এর রঞ্জিত পাল্টা আঘাত হানল ছবির শেষে কাপড়ের দোকানের জানলার কাচ ভেঙে স্যুট পরা পুতুলকে বিবস্ত্র করার মধ্যে যে রাগ ফেটে বেরোয়, তা যেন সমাজের বিভিন্ন স্তরে জমে থাকা রাগের সঙ্গে কোথায়ও একাত্ম হয়ে যায়

মৃণাল সেন জানতেন তাঁর ছবি তখনই সফল হবে, যদি তা সর্বতোভাবে বিশ্বাসযোগ্য প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিফলন হয়ে উঠতে পারে ইন্টারভিউ-এর জন্য প্রথমেই তিনি নায়ক নির্বাচন করলেন একটি অপরিচিত মুখ— সে-সময়ে রঞ্জিৎ মল্লিককে কেউ চিনত না, সিনেমা-পাড়ার নায়কের তকমা নেই, স্বচ্ছন্দে যাকে কোনও পাড়ার বা পাশের বাড়ির চাকরি-খোঁজা ছেলে বলে মেনে নেওয়া যায়আরও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তিনি চরিত্রদের স্বনামে ডাকতে শুরু করলেন, রঞ্জিৎ মল্লিক হলেন সিনেমার রঞ্জিত, শেখর চ্যাটার্জি হয়ে উঠলেন শেখরকাকু প্রথম ফ্রেম থেকেই বোঝা গেল এটি অন্য ধারার সিনেমা— ঘোর বাস্তববাদী ভঙ্গিতে ছবির শুরু, হাতে-ধরা ক্যামেরা এগিয়ে চলে সকালের কলকাতার রাস্তা ধরে, উপচে-ওঠা ডাস্টবিন, পথবাসী নেড়ি কুকুর, ভিখারি, কোনকিছুই তার নজর এড়ায় না এমনি করে চলতে চলতে ক্যামেরা ঢুকে পড়ে মধ্যবিত্ত পরিবারটির রান্নাঘরে, ফোকাস করে মাটির উনুনের ওপর, তারপর তা আস্তে আস্তে উঠে মার মুখের ওপর স্থিত হয়, তিনি তখন সকালের প্রথম কাপ চা বানাতে ব্যস্তএই হল সিনেমা ভেরিতে স্টাইল, বাংলা সিনেমায় যা প্রথমবার দেখা গেল

সেই সময়ে সিনেমায় চরিত্রেরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলত, তখন তারা ক্যামেরার দিকে তাকাত না, কিন্তু এই ছবিতে রঞ্জিতের চোখ আগাগোড়া লেন্সের ওপর নিবদ্ধ ভারতীয় সিনেমার যাবতীয় প্রথাকে নিয়ে মৃণাল যেন খেলা করেছেননায়ককে তিনি দর্শকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন চলন্ত ট্রামের মধ্যেঅসামান্য এই দৃশ্যটির দিকে একবার না তাকালে মৃণাল সেনের প্রতি সুবিচার করা হবে না সকালবেলার ভিড় ট্রামে যাত্রীদের মধ্যে রঞ্জিত দাঁড়িয়ে, একজন যাত্রীর হাতে একটি সিনেমাপত্রিকা, তার মলাটে রঞ্জিতের ছবি, এক তরুণী রঞ্জিতের মুখের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেতখন রঞ্জিত এগিয়ে এসে আত্মপরিচয় দিতে থাকে— তার নাম রঞ্জিত মল্লিক, বাড়ি ভবানীপুর, একটা প্রেসে টুকটাক কাজ করেতার জীবনে বিশেষ কোনও ঘটনা নেই, কিন্তু এটাই পরিচালক মৃণাল সেনের পছন্দ তিনি বললেন— ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত উনি আমার পিছনে ছুটবেনআচ্ছা, আপনারাই বলুন, এর কোনও মানে হয়? (এই সময় মৃণাল সেনের ক্যামেরাম্যান কে কে মহাজনকে ছবি তুলতে দেখা যায়) উনি বলেছেন— আমাকে আলাদা কিছু করতে হবে না আমি তাঁকে বললাম আজ আমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে উনি বললেন— চমৎকার, দারুণ নাটকীয় ব্যাপার হবে(মহাজন ট্রাম থেকে নেমে পড়েন) দেখলেন, কীরকমভাবে আমার পিছনে এঁরা ছুটছেন! কিন্তু এখানে, আপনারা এতক্ষণ যা দেখলেন, তার সবটা কিন্তু সত্যি নয়আমি বাস্তব, জীবন্ত আপনারাও জীবন্ত কিন্তু যে মহিলাকে আমার মায়ের চরিত্রে দেখলেন, তিনি অভিনেত্রী, বাস্তবে তিনি আমার মা নন (সর্বজয়া রূপী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি পরদায় ভেসে ওঠে) ওই সর্বজয়া, মানে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আমার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছেন এইটুকু বলে রঞ্জিত ট্রাম থেকে নেমে আসে এক যাত্রীকে বলতে শোনা যায়— এটা আবার সিনেমা নাকি? এ তো আমার গল্প— আপনার গল্প!

ঠিক এইটাই এতদিন ধরে করতে চেয়েছিলেন মৃণাল সেন সিনেমাকে সব যাদুমন্ত্র থেকে বার করে এনে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ করে তুলতে এই নিশানায় ইন্টারভিউ এক বিশাল পদক্ষেপ রঞ্জিত ট্রাম থেকে নামবার পর একের পর এক ঘটনা ঘটতে শুরু করে— সিনেমাহলের ধর্মঘটী কর্মীরা তাদের দাবির সমর্থনে মিছিল বার করে, আদিবাসীরা তাদের নানারকম দাবির সমর্থনে ধামসা-মাদল-সহ পথে নেমে আসে, কোথায়ও বোমা পড়ার শব্দ হয়, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের তাড়া করে, এক কথায় সত্তরের অস্থির, অশান্ত কলকাতা আমাদের সামনে পরদার ওপর ফুটে ওঠে এর মধ্যে কোথায়ও কিন্তু নাটকীয়তা নেই, আবেগের বহিঃপ্রকাশ নেই, সবটাই ব্রেখ্‌টীয় এলিয়েনেশনের সার্থক রূপদান, পঁচিশ বছরের এক যুবকের জীবনের একটি দিনের খতিয়ানসে-দিন তার ইন্টারভিউ, একটি নামজাদা বৃটিশ ফার্মে (তখনও কলকাতায় বেশ কিছু এ রকম কোম্পানি ছিল) চাকরি পাওয়া নিয়ে তার খুব দুশ্চিন্তা নেই, তার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখরকাকু সেই ফার্মেই বড়ো পোস্টে আছেন, তিনি আশ্বাস দিয়েছেন সপ্রতিভভাবে বোর্ডের সামনে দাঁড়াতে পারলে বাকিটা তিনি দেখে নেবেনসারাদিন তারই প্রস্তুতি চলছে, যদিও রঞ্জিতের পরিকল্পনা মতো সবকিছু চলছে না রঞ্জিত ভেবেছিল সকালে চুলটা একটু ছেঁটে নিলে বেশ হয়, কিন্তু সেলুনে গিয়ে দেখে ঠাসা ভিড়, তাকে বেরিয়ে আসতে হয় তার প্রধান কাজ লন্ড্রি থেকে তার সবেধন নীলমণি স্যুটটি সংগ্রহ করা, কিন্তু লন্ড্রিতে গিয়ে দেখে সেখানকার কর্মীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করছে, সুতরাং স্যুট পাবার কোনও আশা নেই তবুও রঞ্জিত ঠান্ডামাথায় একজন পরিচিতের বাড়ি গিয়ে একটা স্যুট ধার করেবাড়ি ফেরার জন্য সে আবার ট্রামে ওঠে, সেখানে এক পকেটমার ধরা পড়ে আর তাই নিয়ে মারপিট, থানা-পুলিশএই সব হাঙ্গামায় সে ধার-করা স্যুটের প্যাকেটটি ট্রামেই ফেলে আসেএদিকে ইন্টারভিউ-এর সময় এগিয়ে আসছে, আর কিছু করার সময় নেই স্তম্ভিত বোর্ডের সামনে রঞ্জিত হাসিমুখে পাট-ভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবিতে বিশুদ্ধ বাঙালীরূপে দেখা দেয় ইন্টারভিউ বা প্রশ্নোত্তরের একটা প্রহসন চলে, কিন্তু পরিণাম নিয়ে কারুর মনে কোনও সন্দেহ নেই, রঞ্জিত বাতিল হয়ে গেছে তার কোনও অযোগ্যতায় নয়, ঠিকমতো জামাকাপড় না পরার অপরাধে

ছবির এই মুহূর্ত পর্যন্ত মৃণাল সেন ছবিটিকে প্রাত্যহিক বাস্তবের স্তরেই রেখেছিলেন সিনেমা ভেরিতে শৈলী-তে চারদিকে যা ঘটছে তাকে তথ্যচিত্রের মত লেন্সবন্দি করে রাখছিলেনএমনকি শুনে অনেকে অবাক হবেন, ছবি শুরু করার আগে মৃণাল চিত্রনাট্যও লেখেননিপ্রতিদিন সকালে তিনি তাঁর ইউনিটের সঙ্গে বসে ঠিক করতেন আজ কোন দৃশ্য তোলা হবে একদিন তিনি সকলকে নিয়ে এক থানায় ঢুকে পড়লেনওসি-কে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন— আমাকে একটু বলুন না, পকেটমার ধরা পড়লে আপনারা কী করেন থানার লোকজন এরকম অনুরোধ কখনও পায়নি, তারা খুব আনন্দের সঙ্গে গোটা প্রক্রিয়াটা অভিনয় করে দেখিয়ে দিলথানার এক দারোগা ছিলেন পকেটমার বিশেষজ্ঞ, তিনি পকেটমার সাজলেন আর ওসি হলেন দারোগা, গোটা পকেট মারার দৃশ্যটির এইভাবে শুটিং হয়ে গেলআর একদিন তিনি ঢুকলেন এক কর্পোরেট অফিসে, এইচ আর ডিপার্টমেন্টের প্রধানকে বললেন— আপনারা কেমন করে ইন্টারভিউ নেন আমাকে একটু দেখানসেখান থেকে গোটা ইন্টারভিউ-এর দৃশ্য তৈরি হয়ে গেল

ইন্টারভিউ নিয়ে একটা মজার গল্প আমি মৃণাল সেনের মুখেই শুনেছি, তাতে অর্ধশতক আগে টলিপাড়ার কাজের আবহাওয়া কেমন ছিল, তার কিছু আভাস পাওয়া যায় ইন্টারভিউ-এর শুটিং হচ্ছে, তখন সত্যজিৎ রায়ও প্রতিদ্বন্দ্বীর কাজ শুরু করেছেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো সারাদিনের কাজের পর দুই শিবিরেই চরেরা ঘোরা-ফেরা করত অন্য পক্ষের খবর জোগাড় করতেএকদিন মৃণাল সেনের কানে এল সে-দিন সকালেই মানিকবাবু সিদ্ধার্থের সেই বিখ্যাত ইন্টারভিউ-এর দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধরেছেন যেখানে সিদ্ধার্থকে প্রশ্ন করা হচ্ছে— এই দশকের সব থেকে বড়ো ঘটনা কী? সিদ্ধার্থ উত্তর দিচ্ছে— ভিয়েতনামের যুদ্ধ, যে-জন্য সে চাকরি পায় নাপরের দিনের শুটিং-এ মৃণাল সেন ইন্টারভিউ বোর্ডের এক সদস্যকে অনুরোধ করেন প্রশ্ন করতে— আজকের সবচেয়ে বড়ো খবর কীরঞ্জিত বিনা দ্বিধায় উত্তর দেয়— আমার ইন্টারভিউ স্যারফলও উভয়ক্ষেত্রেই একই— পত্রপাঠ নাকচ

ইন্টারভিউ ছবিতে মৃণাল সেন নিজেকে নিয়ে তামাশা করতেও ছাড়েননি রঞ্জিতের সুন্দরী বান্ধবী বুলবুল সারাক্ষণই টেলিফোনে ব্যস্ত থাকেএকবার সে কথায় কথায় নিজের ফোন নম্বর বলে ফেলে, ৪৭৮৮৯৯ (তখন ল্যান্ডলাইনের নম্বর ছয় সংখ্যার হত) দর্শকদের জানার উপায় ছিল না যে ওটি মৃণাল সেনেরই বাড়ির নম্বরসুতরাং প্রত্যহ বুলবুলের জন্য অসংখ্য ফোন আসত, আর গীতা সেন তাদের নামধাম জেনে নিয়ে গম্ভীর গলায় উত্তর দিতেন— বুলবুল বলে এখানে কেউ থাকে না

কিন্তু এই হাসি-তামাশার মুড থেকে ছবি হঠাৎ একটা সিরিয়াস বাঁক নেয় যখন রঞ্জিত বুঝতে পারে যে সে শুধু বাঙালি পোশাকের জন্য তার স্বপ্নের চাকরি পাবে নাসেই মুহূর্তে ছবিটা যেন একেবারে অন্য স্তরে চলে যায়আমাদের মনে পড়ে যায় ছবির শুরুতে দেখানো হয়েছিল ক্রেনে করে কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকে ভূতপূর্ব রাজপুরুষদের মর্মর মূর্তি নামিয়ে ফেলা হচ্ছে ব্যঞ্জনাটুকু এবার স্পষ্ট— আমরা বিদেশি শাসকদের মূর্তিকে বিসর্জন দিয়েছি, কিন্তু বিদেশিয়ানাকে বর্জন করতে পেরেছি কি? গল্প এখানেই শেষ, ছবি কিন্তু চলতে থাকেএক অন্ধকার ঘরে রঞ্জিত তার পরিচালকের মুখোমুখী হয়, আবার এক প্স্থ সওয়াল-জবাব চলে, রঞ্জিত মানতে একরকম বাধ্য হয় যে, একটা সার্বিক পরিবর্তন বা বিপ্লব প্রয়োজন সঙ্গে সঙ্গে পরদায় ভেসে ওঠে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছবি আর আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার দাবির আন্দোলনের নিউজরিল ফুটেজকলকাতা শহরের একটা তুচ্ছ ঘটনা বড়ো বড়ো আন্তর্জাতিক হেডলাইনের সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে উঠে আসে, কেননা মৃণাল সেনের মতে মূল ব্যাপারটা এক— সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

এইভাবেই প্রথম অংশের স্যুটের সন্ধান শেষে সম্পূর্ণ ক্রান্তির অনুসন্ধানে পরিণত হয়কিন্তু এই যাত্রা কি ঠিকঠাক ছিল? ছবির প্রথম পর্বের মেজাজের সঙ্গে শেষ পর্বের অসঙ্গতি এত দুস্তর যে দর্শক বিভ্রান্ত হয়ে পড়েনযে-জন্য শেষের সেই বিখ্যাত ক্লাইম্যাক্স, রঞ্জিতের শো-কেসের কাচ ভেঙে পুতুলের ওপর হামলা, পরিচালক যতটা চেয়েছিলেন ততটা অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি মৃণাল সেনের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা— চিত্রনাট্য বাদ দিয়ে ছবি করা বা শেখর চট্টোপাধ্যায় এবং কিছুটা করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিলে, আগাগোড়া অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে সিনেমা করার ফলে অনেকেই মনে করেন সিনেমার অভিনয়ের দিকটা কমজোর হয়ে গিয়েছিল, যদিও এই ছবির জন্য আনকোরা নতুন রঞ্জিত মল্লিক কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়ে ছিলেন যে-তারিখে তিনি এই পুরস্কার পান, প্রতি বছর ওই দিনটিতে রঞ্জিতবাবু সকালবেলা এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে মৃণাল সেনকে প্রণাম করে যেতেন— এ আমার স্বচক্ষে দেখা

ইন্টারভিউ সেই সময়ে সাধারণ লোকের ভালোলাগেনি, না কি ভালোলেগেছিল, নিশ্চিত করে বলা খুব শক্ত বক্স-অফিসে খারাপ করেনি মৃণাল সেনের গিমিক’— এই শব্দবন্ধটি এখান থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে পাকাপাকিভাবে যুক্ত হয়ে যায় মনে হয় ছবিটা কোথায়ও একটা ধাক্কা দিতে পেরেছিল এই ছবি চলার সময় ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্‌মচর্চার অধ্যাপক ডক্টর আ্যালবার্ট জনসন কলকাতাতে এসেছিলেন তিনি রাত্রের শো-তে ইন্টারভিউ দেখে উত্তেজিত হয়ে ট্যাক্সি করে রাত বারোটায় মৃণাল সেনের বাড়ি এসে তাঁকে প্রশ্নে প্রশ্নে আচ্ছন্ন করে ফেলেন— যেমন, রঞ্জিত কি সত্যই প্রেসে চাকরি করে? তার রাজনৈতিক মতাদর্শ কী? মৃণাল সেন উত্তর দিয়েছিলেন— সিনেমার একটা পা থাকে রিয়ালিটিতে, অন্যটা ফ্যান্টাসিতে

কিছু নকশালপন্থী যুবকও রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছিল— আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই অভিনেতা রঞ্জিত সাবেকি বনেদি পরিবারের সন্তান, অতিবাম রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ থাকার কথা নয়, তিনি সযত্নে তাদের এড়িয়ে গিয়েছিলেন অর্থাৎ আমাদের যা অবাস্তব মনে হয়েছে তার মধ্যেও কোথাও নিশ্চয় সত্যের বীজ ছিলসে-জন্যই নানা অপূর্ণতা সত্ত্বেও ইন্টারভিউ কলকাতা-ত্রয়ীর ভিত্তিপ্রস্তর হতে পেরেছিল

 

দুই

 

কলকাতা-ত্রয়ী নিয়ে এত কথার মধ্যে আমাদের মনে থাকে না ইন্টারভিউ ও কলকাতা-৭১-এর মধ্যে মৃণাল সেন আরও একটি ছবি করেছিলেন, এবং সম্পূর্ণ অন্য বিষয়েমৃণাল-অনুরাগীদের মধ্যেও বোধহয় খুব কম সংখ্যক মানুষই ছবিটি দেখেছিলেন, এবং বক্স-অফিসে ছবিটি একেবারে তলিয়ে গিয়েছিলএই কাব্যে উপেক্ষিতার নাম হল এক আধুরি কহানী, সুবোধ ঘোষের বিখ্যাত ছোটোগল্প গোত্রান্তর অবলম্বনে হিন্দিতে নির্মিত ছবিএকসময়ে গল্পটি ভালো লাগায় বহু বছর আগে মৃণাল চিত্রস্বত্ব কিনে রেখেছিলেন, কিন্তু সত্তরের শুরুতে ছবি বানাতে গিয়ে তিনি দেখলেন যে, সে ক্ষণও চলে গেছে, মনও চলে গেছে তিনি আরও হৃদয়ঙ্গম করলেন যে, বামপন্থী ট্রেড-ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপারটা তাঁর ঠিক আয়ত্তে নেই ফলে ছবি শুরু করার আগেই তিনি দ্রুত উৎসাহ আর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেনশুটিং-এর আগের দিন তিনি পত্নী গীতাকে বলেই ফেলেছিলেন— আজ রাতে আমার একটা হার্ট এটাক হলে বেশ হয়, এই যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাই

কিন্তু তেমন কোনও অঘটন ঘটেনি, তিনি তাঁর করণীয় সবই করলেন, কিন্তু একটি উদ্দেশ্যহীন ছবি তৈরি হল, যা কোথাও পৌঁছোল না, যদিও ছবিটি একটি বিদেশি ফেস্টিভ্যালে কিছু পুরস্কার পেয়েছিল কিন্তু মৃণাল সেন নিজে কখনও ছবিটিকে পছন্দ করতে পারেননি

 আসলে নকশালবাড়ি আন্দোলন যেমন যেমন ব্যাপ্তি পাচ্ছিল, কলকাতাও তত দিনে দিনে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল, মৃণাল সেনও সেই আগুনের আঁচে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন ১৯৬৯-এর বাইশে এপ্রিল, লেনিনের শততম জন্মদিনে, কলকাতার ময়দানে সরকারিভাবে একটি উগ্রপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হল চারু মজুমদারের নেতৃত্বে কৃষিবিপ্লবীরা হয়ে উঠল শহুরে গেরিলাবাহিনী কিছুদিনের মধ্যে চারুবাবু তাঁর খতম তত্ত্ব নিয়ে এলেনকলকাতা শহর ও শহরতলি এলাকা রক্তাক্ত হয়ে উঠলনকশালি হিংসার প্রত্যুত্তরে রাষ্ট্রশক্তিও তার দাঁত-নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়লগোটা রাজ্যে এক অভূতপূর্ব গৃহযুদ্ধের আবহ সৃষ্টি হয়েছিল

এই ঘটনাপ্রবাহে মৃণাল সেনও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেনতিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না কোন পক্ষকে তাঁর সমর্থন করা উচিততাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিল তাঁর কৈশোরের স্মৃতি, কেমন করে গা-ঢাকা দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাঁদের বাড়িতে রাতে গোপন বৈঠক করত, কেমন করে তাঁর মা পুলিশ আসার আগে নিষিদ্ধ কাগজপত্র সরিয়ে ফেলতেন, মনে পড়ে গেল, প্রাণদণ্ড নিশ্চিত জেনেও ফরিদপুরের একটি চোদ্দো বছরের বালক এক পুলিশ কর্মচারীকে গুলি করে হত্যা করেতাঁর মনে হল, এতগুলি দশকেও কিছুই বদলায়নিএকজন শিল্পী হিসাবে তাঁর কর্তব্য হল শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সিনেমার মধ্যেই তিনি পথ খুঁজে নিলেন

এই সময় একটি আশ্চর্য ঘটনা মৃণাল সেনকে নিজের পথ ঠিক করতে অনেকটা সাহাষ্য করেছিলকার্লোভি ভ্যারির সাফল্যের পর ইন্টারভিউ থেকে পরিবেশক দয়াশঙ্কর সুলতানিয়া তাঁর বিনিয়োগ করা অর্থ তো ফের পেলেনই, দেশে-বিদেশে ছবি কিছুটা বিক্রিও হল তিনি মৃণাল সেনের কাছে ফিরে এলেন দয়াশঙ্কর তখন পরবর্তী ছবি প্রযোজনা করতে পুরোপুরি রাজি, তিনি পরিচালককে বললেন— যে-কোনও বিষয় নিয়ে ছবি করতে পারেনমৃণাল সেনের সামনে আবার সুযোগ ছিল আর একটা মিষ্টি মিষ্টি ভুবন সোম জাতীয় ছবি করার, কিন্তু তিনি ওইরকমের কোনও গল্প দেখতেও চাইলেন না তাঁর চোখের সামনে তখন উত্তাল কলকাতা, তিনি সে-দিকেই মনোনিবেশ করলেনজন্ম নিল কলকাতা-৭১

কলকাতা-ত্রয়ী সম্পর্কে মৃণাল সেন খুব স্পষ্ট করে বলেছেন :

...৬০-৭০ দশকের সন্ধিক্ষণে নকশাল আন্দোলনকে দেখেছি, তাই নিয়ে ভেবেছি, জড়িয়ে পড়েছিএ দেখার মধ্যে বেহিসেবিপনা ছিল... বেপরোয়া ভাবনা ছিল... অনেকটাই আবেগ যুক্ত ছিলকিন্তু... আর কোনও হিসেব ছিল না, নির্লিপ্ত, শীতল পর্যবেক্ষণ ছিল না, ছক কষার কোনও চেষ্টা ছিল নানকশাল আন্দোলনকে সামনে রেখে কোনও অঙ্কটঙ্ক কষে ইন্টারভিউ, কলকাতা-৭১, কিংবা পদাতিক বানাইনিওই অস্থির সময়টার আগুনের তাপ যখন যেভাবে মনের ওপর ছাপ ফেলেছে, সেভাবেই একের পর এক ছবিগুলো করে গিয়েছি ...আমার ছবিগুলোও নকশাল আন্দোলনের রাজনৈতিক ভাষ্য বা বিশ্লেষণ নয়আমি সময়টাকে ধরতে চেয়েছিলাম, পেরেছিলাম কি না জানি না




গঠন-নির্মাণের দিক থেকে কলকাতা-৭১ মৃণাল সেনের জটিলতম ছবি, একসঙ্গে অনেকগুলি স্তরে তিনি বিচরণ করেছেন। ছবিটি তিন ভাগে বিভক্ত। ছবির শুরুতে পরদায় কতকগুলি বাক্য পরপর ফুটে ওঠে

আমার বয়স কুড়ি

কুড়ি বছর বয়স নিয়ে

আমি আজও হেঁটে চলেছি

হাজার বছর ধরে

দারিদ্র্য

মালিন্য

আর

মৃত্যুর ভিড় ঠেলে

আমি পায়ে পায়ে চলেছি

হাজার বছর ধরে

হাজার বছর ধরে

দেখছি

ইতিহাস

দারিদ্র্যের ইতিহাস

বঞ্চনার ইতিহাস

শোষণের ইতিহাস

এভাবে পৃথিবীতে কোনও সিনেমা শুরু হয়েছে কি না, দর্শকদের অন্তত জানা ছিল নাতাঁরা চমকে উঠলেনগোটা ১৯৭১ সাল জুড়ে শহরে যা যা হয়েছিল, সব কিছু যেন এই লাইনগুলোর মধ্যে তাঁদের সামনে উঠে এলএর পরে হাওড়া ব্রিজের লংশট-সহ কলকাতার বিভিন্ন দৃশ্যের একটা কোলাজ দেখা গেল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে ক্যামেরায় আসেন সুহাসিনী মুলে— ভুবন সোমের সুন্দরী, নিষ্পাপ চেহারার নায়িকা ছবিটি সাদা-কালো হলেও এই অংশটি রঙিমেয়েটি ময়দানের ঘাসে একটি রক্তাক্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করে চমকে উঠছে (দেহটি অবশ্য ফ্রেমের বাইরে থাকে) পিছনে আকাশবাণীর সংবাদপাঠকের গলায় ভেসে আসছে ময়দানে গুলিবিদ্ধ যুবকের মৃতদেহ আবিষ্কারের আখ্যান মেয়েটির ভীতচকিত বেদনাক্লিষ্ট মুখের ওপরে আবার আমার বয়স কুড়ি... ইত্যাদি লেখাগুলো ফুটে উঠতে থাকেছবির ভূমিকা এই পর্যন্তই

ভূমিকার পরেও কিন্তু ছবি শুরু করার আগে মৃণাল সেন আরও একটু সময় নিলেন তিনি একটি আদালতের দৃশ্য যোগ করেন, কাপড়ের দোকানের ডামি ভাঙার অপরাধে রঞ্জিত মল্লিকের বিচার চলছেআমার মতে এই অংশটুকু কলকাতা-৭১ ছবির দুর্বলতম স্থান, অনেকটাই প্রক্ষিপ্ত মনে হয়কলকাতার এই ক্রুদ্ধ চরিত্র নিতান্ত আজকের নয়, তার একটা ইতিহাস আছে, তা শোষণের, বঞ্চনার, দারিদ্র্যের ইতিহাসতাঁর এই মূল থিমকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মৃণাল সেন একের পর এক তিনটি গল্পকে তুলে ধরেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মহত্যার অধিকার (রচনাকাল ১৯৩৩), প্রবোধকুমার সান্যালের অঙ্গার(রচনাকাল ১৯৪৩) ও সমরেশ বসুর এসমালগার (রচনাকাল ১৯৫৩)। এই তিনটি গল্পের মধ্য দিয়ে মৃণাল সেন শহরের দারিদ্র্য, ক্রোধ আর অবক্ষয়ের একটি নির্মম ছবি তুলে ধরেছিলেন সত্যজিতের তিন কন্যার এক দশক পর এই প্রথম তিনটি গল্প মিলিয়ে একটা ফিল্‌ম তৈরি হল, কিন্তু বিষয় ও নির্মাণশৈলীতে দুই ফিল্‌মমেকারের মধ্যে কী সুদুস্তর পার্থক্য! প্রতিবার গল্প থেকে গল্পান্তরে যাবার মধ্যবর্তী ফাঁকটুকুতে সেই গুলিবিদ্ধ যুবকটি এসে আমার বয়স কুড়ি... ইত্যাদি বলে যায় চলচ্চিত্রের মতো আধুনিক শিল্পমাধ্যমে সে যেন গ্রিক নাটকের কোরাসের ভূমিকা নিয়েছে

সাল-তারিখের শৃঙ্খলা মানতে হলে পরের গল্পটি ১৯৬৩-র হওয়া উচিত ছিল কিন্তু মৃণাল সেন সরাসরি ১৯৭১-এ ঢুকে পড়লেনপুরো কাহিনি নয়, একটি ছোটো দৃশ্যে ধরা পড়ে এক ধনী ব্যবসায়ীর নৈশ পার্টির অনুষ্ঠান ভদ্রলোক ভালো ভালো মানবদরদের কথা বললেও দর্শকের অজানা থাকে না যে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে চাল ব্ল্যাক করে তিনি বড়োলোক হয়েছিলেন এবং সম্প্রতি নিজের কারখানা লক-আউট করে বহু শ্রমিককে অনশনের মুখে ঠেলে দিয়েছেন পার্টিতে নাচ গান চলছে হঠাৎ সব আলো নিভে গেল, সংগীতের টেপ ছিঁড়ে গেল, চতুর্দিকে বিশৃংখলাসেই মৃত যুবকটি এবার এগিয়ে আসেসে বলতে থাকে— ভয় পাবেন না, আমার হাতে কোনও অস্ত্র নেই তারপর ব্রেখ্‌টীয় ভঙ্গিতে সে অতিথিদের জানায় সেইদিন সকালে ময়দানে তাকে খুন করা হয়েছেএকজন চিৎকার করে ওঠে— দেখা যায় ছেলেটির সারা দেহে রক্ত ছেলেটি সকলকে বলে তার হত্যাকারীকে খুঁজে বার করতে তার জিজ্ঞাসা— আপনারা এত নির্লিপ্ত কেন? সকলকে মূক করে দেয়আবার সে শোনায়— আমার বয়স কুড়ি...’। পার্টিতে হট্টগোল শুরু হয়এর মধ্যে পরদায় একটা মন্তাজ দেখানো শুরু হয়, কিছু তথ্যচিত্রের ফুটেজ, আগের কাহিনিগুলির অংশবিশেষআবার ক্যামেরা ফোকাস করে কলকাতার ওপরে, মিছিল আর বিক্ষোভের মধ্যে ছেলেটি দৌড়োচ্ছে, তাকে কারা যেন তাড়া করেছেকলকাতার গলি থেকে সে ঘন জঙ্গল পার হয়ে সমুদ্রতীরে এসে পড়ে, তার পথ জুড়ে মৃতদেহের স্তূপ জমতে থাকে, পৃথিবীব্যাপী স্বৈরচারী শাসনের যারা বলি, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, বায়াফ্রার মানুষেরা তার দৌড় শেষ হয় এক কুয়াশা-ঘেরা ময়দানে, একটা বন্দুকের শব্দ শোনা যায়, ছেলেটি ঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়েদর্শকের প্রথম দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায়, একটা বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল কিন্তু তখনই হঠাৎ চারপাশে ধ্বনিত হয় কলকাতা আকাশবাণীর স্বাক্ষরসংগীত বা সিগনেচার টিউনএখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, পঞ্চাশ বছর আগে বহু মানুষের দিন শুরু হতো ওই সুরের সঙ্গেসেই সুরটি শুনিয়ে মৃণাল সেন যেন বলতে চাইলেন নতুন দিন আসছে, হয়তো এই দিনটা চলে-যাওয়া দিনগুলোর থেকে একটু আলাদা হবেঅর্থাৎ সমাপ্তিতে একটা সম্ভাবনা খোলা রইল, যাকে ইংরেজিতে বলে open-ended

এখানে একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ না করে পারছি নাকলকাতা-৭১ মুক্তি পেয়েছিল সাহেবপাড়ায় অর্থাৎ মেট্রো সিনেমাহলেভালো ভিড় হত, লাইন দিয়ে দর্শক টিকিট কাটততাই দেখে মৃণাল সেন পুলকিত হয়েছিলেনক্লাস পালিয়ে দুপুরের শো-তে ছবি দেখতে গেছিছবি শেষ হল, সকলেই একটু ঘোরের মধ্যে, হঠাৎ সামনের রো-তে বসা কয়েকটি যুবক উঠে দাঁড়াল, মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে ধ্বনি দিতে লাগল— মৃণাল সেন লাল সেলাম, মৃণাল সেন যুগ যুগ জীয়ো মৃণাল সেন কোনদিনই তথাকথিত জনপ্রিয় পরিচালক ছিলেন না, বাংলার দর্শক এবং সুধীজন তাঁকে ঈষৎ ভীতিজড়িত সম্ভ্রমের সঙ্গে বরাবরই দূরে সরিয়ে রেখেছেকিন্তু সে-দিনের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস ভুলতে পারব না

 

তিন

 

কলকাতা-৭১ ভালো চলেছিল এবং দর্শকের মনে রীতিমতো তরঙ্গ তুলতে সক্ষম হলকিন্তু আরও একটি জিনিসও হল বিভাজন দর্শক আর সমালোচকেরা পরিষ্কার দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন মূল ধারার মিডিয়ার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁরা ছবির তীব্র সমালোচনা করলেন, কেউ কেউ এতদূর বলে ফেললেন যে, এটি কোনও শিল্পকর্মই নয়, রাজনৈতিক ইস্তাহার কিন্তু অতি-বামদের ছবি ভালো লাগলমতাদর্শের দিক থেকে মৃণাল সেন তখনও তাঁদের চোখে শোধনবাদী হলেও তিনি শত্রুকে ঠিকমতো চিনিয়ে দিয়েছেন

মৃণাল সেন নিজে কি ভাবছিলেন?

উনিশশো একাত্তরে শুটিং করলেও কলকাতা-৭১ মুক্তি পায় বাহাত্তরের অক্টোবরেততদিনে বাম আন্দোলনের ছবি বদলে গেছে দুই কমিউনিস্ট পার্টি তিন হয়ে গেছে, তা আমরা আগেই দেখেছিএদের ভিতর হানাহানি চলতই, কিন্তু এবার তৃতীয় দলের মধ্যেও গৃহযুদ্ধ শুরু হলকলকাতা-৭১ জনসমক্ষে আসার ঠিক তিন মাস আগে নকশালবাড়ি আন্দোলনের শীর্ষ নেতা চারু মজুমদার লালবাজারে পুলিশের হেফাজতে প্রাণত্যাগ করলেন, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না অস্বাভাবিক, সে বিতণ্ডা আজও অমীমাংসিতবিভ্রান্ত মৃণাল সেনের মনে হল, কোথায়ও কিছু ভুল হয়ে গেছে, একটু আত্মসমালোচনা প্রয়োজন কিন্তু এই সমালোচনা কোনও বাইরের লোক নয়, দলের একজন কর্মীই করতে পারেমৃণাল সেনের মাথায় একটা ছবির ধারণা ঝাপসাভাবে দানা বাঁধতে শুরু করলদীর্ঘদিনের সহযোগী আশীষ বর্মণের সঙ্গে কয়েক দফা বসার পরে একটি চিত্রনাট্য তৈরি হয়, জন্ম নেয় পদাতিক

এ ছবির শুরুও নাটকীয়ভাবে কেন্দ্রীয় চরিত্র সুমিত উগ্র বাম দলের পুরো সময়ের কর্মী, নিয়মিত আ্যাকশন করা ছেলে, পুলিশের খাতায় নাম আছে একদিন সে ধরা পড়ে যায়, তারপর দুঃসাহসিকভাবে পুলিশের ভ্যান থেকে পালায়এই পলায়ন দিয়েই ছবি শুরুপার্টি তার জন্য এক নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করেএক তরুণ ক্যাডার বিমান তাকে অভিজাত পাড়ায় একটি ফ্ল্যাটে ডুপ্লিকেট চাবি খুলে ঢুকিয়ে দেয় ফ্ল্যাটের মালকিন পার্টির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্না এক পাঞ্জাবি মহিলা যিনি সেখানে একাই থাকেনবিমান সুমিতকে বুঝিয়ে দেয় ফ্ল্যাটের বাইরে যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধমহিলা সারাদিন চাকরিতে ব্যস্ত থাকেনবাড়িতে সুমিত একা, বই, খবরের কাগজ পড়ে তার দিন কাটে দু’জনের একাকীত্বের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে মহিলার সঙ্গে সুমিতের সম্পর্ক সহজ হয়ে আসেসুমিত জানায় বাড়িতে তার অসুস্থ মা, বৃদ্ধ পিতা আর ছোটোভাই রয়েছেস্বাধীনতা সংগ্রামী পিতা পার্টির আদর্শ বোঝেন না, সারাক্ষণই দু’জনের মতান্তর লেগেই থাকতমহিলা স্বামীবিচ্ছিন্না, একমাত্র ছেলে হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছেছোটোভাইয়ের মাধ্যমে পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ, সেই ভাই সম্প্রতি রোপার জেলায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছে

সারাদিনের নির্জনবাসের মধ্যে সুমিতের মনে নানা প্রশ্ন জাগেএকদিন সে পার্টি নেতৃত্বকে এক দীর্ঘ চিঠি লিখে বিমানের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়দিন পরে বিমান এসে জানায় খবর ভালো নয়দলের তাত্ত্বিক-গুরু নিখিলদা তার আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বিমানকেও বারণ করে দেওয়া হয়েছে— সে যেন সুমিতের কাছে আর না যায়

বিদায় নেবার সময় বিমান বলে যায়— সে খবর পেয়েছে সুমিতের মার অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু পুলিশ সুমিতকে খুঁজছে, সুতরাং তার বাড়ির দিকে না যাওয়াই ভালোকিন্ত সুমিত বিমানের সতর্কতা অগ্রাহ্য করে বাড়ি ফিরে যায়, কিন্তু যতক্ষণে সে পৌঁছোতে পারে, ততক্ষণে তার মার মৃত্যু হয়েছেতার বাবা তাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলেন, তাঁর অফিসে সবাইকে একটি কাগজে সই করতে বলা হয়েছিল যে এখানে কোনও স্ট্রাইক বা ইউনিয়নবাজি করা চলবে নাতিনি কিন্তু সই করেননি পুত্র সগর্বে পিতার দিকে তাকায়, শটটি ফ্রিজ হয়ে যায়বাইরে পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ শোনা যায়, বাবা ছেলেকে শুধু বলেন— বি ব্রেভ

নব্বই মিনিটের নিটোল মু্ক্তোর মতো এই ছবি আশ্চর্য নিচু স্বরে বাঁধা, ত্রয়ীর অন্য ছবিগুলির মতো নয়এখনেই মৃণাল সেন প্রথম অন্তর্মুখী হলেন, যা তাঁর পরবর্তী দশকের শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির প্রধান সম্পদঅথচ এখানেও তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন এখানেও তিনি আর্জেন্টিনার পরিচালক সোলানাসের ছবির কিছু অংশ তুলে ধরেছেনতাঁর প্রতিপাদ্য হল কলকাতা-ত্রয়ী হলেও এই ছবি যে-কোনও তৃতীয় বিশ্বের দেশে বানানো যেতএ ছাড়াও ছবির উপসংহার আমার অসামান্য মনে হয় একটি বিশেষ কারণে

১৯৪১ সালে আঠারো বছরের মৃণাল সেন কলকাতায় হস্টেলে থেকে কলেজে পড়তেনএকদিন হঠাৎ পুলিশ তাঁকে হস্টেল থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল অভিযোগ— তিনি কমিউনিস্টকমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে গেছে, পুলি সন্দেহ করছে তিনি নানা অবৈধ রাজনৈতিক কর্মে লিপ্ত সাতদিন জেল খাটার পর তিনি জামিন পেলেনতাঁর বাবা আইনজীবী ছিলেন, তা ছাড়া তিনি ফরিদপুর কংগ্রেসের বরিষ্ঠ কর্মীজেল থেকে বেরিয়ে তরুণ মৃণাল দেখলেন তাঁর বাবা গেটে দাঁড়িয়ে আছেন ঘোর কংগ্রেসি পিতা সে-দিন কমিউনিস্ট পুত্রের হাত চেপে ধরে শুধু একটি কথা বলেছিলেন— কিপ ইট আপ

প্রায় বত্রিশ বছর পরে পরিচালক পুত্র সেই মুহূর্তটিকেই সেলুলয়েডে বন্দি করে অমরত্ব দিলেনতাঁর ফিল্মে বারবার শিল্প আর জীবন এভাবে মিলে যায় বলেই মৃণাল সেন এক সার্থক জীবনশিল্পী

_________

 

তথ্যসূত্র :

১) Mrinal Sen; Sixty Years in search Of Cinema By Dipankar Mukhopadhyay, HarperCollins Publishers India, 2009.

২) কথাপুরুষ, দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়, প্যাপিরাস, ২০০৩

৩) তৃতীয় ভুবন, মৃণাল সেন, আনন্দ, ২০১১

৪) মৃণাল সেনের ফিল্মযাত্রা, শিলাদিত্য সেন, প্রতিক্ষণ, ২০১৫

৫) আন্তর্জাতিক আঙ্গিক, সম্পাদনা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ও উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, দেজ পাবলিশিং, ২০২০

৬) কৃত্তিবাস, মে ২০২১ 


মন্তব্যসমূহ