রাঘবের বউ - রূপম চট্টোপাধ্যায়




  
রাঘবের বউ

 

রূপম চট্টোপাধ্যায়


রাঘব জানে, তাকে দেখিয়ে লোকজন আড়ালে-আবডালে ফিসফিস করে বলে, "এই লোকটার বউ পালিয়ে গেছে"

 

বিবাহিত মানুষের হাজার একটা দুঃখ তবু তারা কাজের শেষে বাড়ি ফেরে ঝগড়া হয়, গালমন্দ হয়, তবু সুখে-দুঃখে এক হয়ে যায় আবার কিন্তু যাদের বউ পালিয়ে যায় তাদের কথা আলাদা সবাই কেমন অবজ্ঞার চোখে দেখে

'কী হয়েছিল', 'বউয়ের আলাদা কোনও সম্পর্ক ছিল কি না', 'সে বউকে খুশি রাখতে পারত কি না'-  ইত্যাদি প্রশ্নগুলো ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ত প্রথম প্রথম তারপর আস্তে আস্তে মানুষের উৎসাহে ভাঁটা পড়ে এক সময়, ঢেউ থিতিয়ে যায় আর হাজারটা টাটকা খবরের ভিড়ে চাপা পড়ে যায় মিলুর কেচ্ছা

মিলুর কেচ্ছা! সত্যিই কি কিছু কেচ্ছা ছিল? মিলুকে তো বেশ পছন্দ করত সবাই তাদের দুই বাড়ির লোক, প্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধব বড় প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল সে

যখন মিলু ছিল তখন খুব আগ্রহ ভরে রান্না করত রাঘব কোনদিন শুক্তো, কোনদিন লাউ-চিংড়ি, তো কোনদিন বেগুন দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল বৃষ্টি পড়লেই আকাশ-পাতাল খুঁজে ইলিশ আনত রাঘব খিচুড়ি বানাত মিলু সেদিন আর রাঘব ইলিশ ভাজত রান্নার হাত ভাল ছিল না ওর তরকারিতে প্রায়ই নুন বেশি দিয়ে ফেলত তারপর কাঁচুমাচু মুখ করে সামান্য ভালবাসা মাখিয়ে খাইয়ে দিত মিলুকে মিলু হাসি হাসি মুখ করে খেত, ঠিক বাচ্চা মেয়ের মতো সুর করে বলত, "দেখো, আমাদের একটা মেয়ে হবে ওর নাম দেব মীরা মিলু আর রাঘবের মেয়ে মীরা এরকম কোনও এক বৃষ্টির দিনে তুমি ইলিশ ভাজবে আমরা তখন জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখব তারপর আমি আর মীরাদুজনকেই তুমি খাইয়ে দেবে নিজের হাতে"

ভালবাসায়, সোহাগে অনাগত ভবিষ্যতের সুখ কল্পনায় তখন মেতে উঠত দু'জনে তাদের পুরনো বাড়ির কার্ণিশ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ভালবাসা চুঁইয়ে পড়ত মাটিতে প্রেমের সৌরভে ম ম করত আনাচ-কানাচ এখন অবশ্য রাঘবের সন্দেহ হয়, সত্যিই কি ভালবেসে খাবার খেত মিলু, নাকি ভয় পেত ওকে? যদি ভালই বাসত তাহলে অন্য কার ঙ্গে পালাল কেন?

"স্যার! স্যার!"

রথীনের ডাকে চটকা ভাঙে ওর রথীন, তার ছাত্র মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস টুয়েলভে পড়ে স্যারকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে-ও সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়েছে

 

রাঘব ঘোলা চোখে একবার তাকায় ওর দিকে ছেলেটাকে কি তার চেনা উচিত?

রথীন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে কাছে, গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, "স্যার, আপনি আর স্কুলে আসবেন না?"

 

রাঘব একইরকম ভাবে চেয়ে থাকে কথাগুলো চেনা চেনা ঠেকে বড্ড একসময় তার স্কুল ছিল, অজস্র ছাত্র-ছাত্রী ছিল, সামাজিক বন্ধন ছিল, আটপৌরে হাসিখুশি জীবন ছিল কিন্তু আজ সমস্তই হারিয়ে গেছে, মিলু যেন যাওয়ার সময় সবটুকু নিয়ে চলে গেছে সঙ্গে

সে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না কত প্রশ্নই তো ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে, সব প্রশ্নের কি উত্তর দেওয়া যায়?

রথীনকে রাস্তার পাশে ফেলে এগিয়ে যায় সে

 

ঘড়ি নেই হাতে, তবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে বেলা বাড়ছে এটা থানায় যাওয়ার সময় থানায় যাওয়া নিয়মিত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে আজকাল প্রথম প্রথম থানার অফিসার ওকে সময় দিতেন বোঝানোর চেষ্টা করতেন স্থানীয় হাই স্কুলের মাস্টারমশাইকে পরের দিকে অবশ্য বাইরে বসতে বলতেন এক-আধ দিন চা পাঠিয়ে দিতেন কথা বলার সময় হত না

 

আজকাল রাঘব তাই নিজেই অফিসারের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে না থানার গেট দিয়ে ঢুকে সামনেই যে কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে, তার নীচে চুপটি করে বসে থাকে দুপুর পর্যন্ত দাদুর মুখে শুনত কৃষ্ণচূড়া গাছ থাকলেই নাকি পাশে রাধাচূড়াও থাকে, একটার ফুল লাল, অন্যটার হলুদ হয়তো এখানেও ছিল একসময় এখন আর নেই

একেকদিন রাঘবের মনে হয় কৃষ্ণচূড়া গাছটাও তার হারিয়ে যাওয়া বউয়ের খোঁজে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে থানায় খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই তখন ভারি মায়া হয় রাঘবের, স্নেহ ভরে হাত বুলিয়ে দেয় গাছের কর্কশ শরীরে

 

অফিসার অবশ্য প্রায়দিনই রাঘবকে না দেখার ভান করে এড়িয়ে যা ভুলক্রমে কোনদিন চোখাচোখি হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে চলার গতি শ্লথ করেন, খুব মৃদুস্বরে বলে ফেলেন, "আপনি রোজ কেন আসেন রাঘববাবু? আমি তো বলেইছি আপনার স্ত্রীর কোনও খোঁজ পেলেই..."

অফিসারের কথার মাঝখানেই বুঝদারের মতো ঘাড় নাড়ে রাঘব, যেন এখানে আসাটা ভারী অন্যায় হয়েছে, আর আসবে না সে

অফিসার শুকনো হেসে চলে যান আসলে দু'জনেই ধরতে পারে পরস্পরের ছলনা পরেরদিন রাঘব আবার যথারীতি গিয়ে বসে কৃষ্ণচূড়ার তলায়

বিকেল হওয়ার আগেই সে আবার বেরিয়ে পড়ে ওখান থেকে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে হাঁটতে শুরু করে দ্রুত লয়ে পার হয়ে যায় হাই স্কুলের খেলার মাঠ, রেললাইন, পলাশের বন

খেলার মাঠে থাকা ছেলেগুলো প্রথম প্রথম ডাকত ওকে, ঙ্গ নেওয়ার চেষ্টা করত কিন্তু রাঘবের দিক থেকে কোনরকম সাড়া না পেয়ে একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছে ওরা অনেকেই রাঘবের কাছে পড়েছে এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও এত সতেজ, প্রাণবন্ত একটা মানুষ কীভাবে যে বদলে গেল, তারা কিছুতেই বুঝতে পারে না

 

হাঁটতে হাঁটতে ইজরি নদীর তীরে চলে আসে রাঘব তিরতির করে বয়ে চলা নদীর তীরে একটা বড় পাথরের ওপর বসে

সেই উঁচু পাথরটায় বসে কোনও-কোনওদিন আবার নিজেকে ভূগোলের শিক্ষক বলে মনে হয় যেভাবে রথীনদের পড়াত ক্লাসে, সেভাবেই ইজরির তীরে ছোট-বড় নুড়িগুলোকে সাজিয়ে ক্লাস শুরু করে সুন্দরবনের গরান গাছ চেনাতে চেনাতে ঢুকে পড়ে আমাজনের গভীর জঙ্গলে গাছ আর আগাছার ভিড়ে পা আটকে যায় রাঘবের, হাঁসফাঁস করতে করতে কার কথা যেন মনে পড়ে যায় স্থান-কাল ভুলে চিৎকার করে ডেকে ওঠে, "মিলুউউউ..."

 

দূরে থাকা রাখালের দল সে ডাক শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কুমোরপাড়ার বউগুলো গা ধুতে ধুতে থেমে যায় নদীর পাড়ে পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের গায়ে ধাক্কা খেয়ে সেডাক ফেরত আসে শূন্য হাতে সূর্য অস্ত যায় রাঘবের চোখ ভিজে ওঠে নদীর বালি মুঠোয় ভরে ছুঁড়ে মারে স্রোতস্বিনীর গায়ে, বিড়বিড় করে অভিশাপ দেয় সেই ছেলেটাকে, যে মিলুকে কেড়ে নিয়ে গেছে তার কাছ থেকে

সারাদিন যা-হোক করে বাইরে কাটায় রাঘব সাহস পায় না নিজের বাড়িতে ফিরতে শূন্য বাড়ি যেন গিলতে আসে ওকে কিন্তু সন্ধ্যা হলেই উদভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফেরে সে দমকা বাতাসের মতো আছড়ে পড়ে ঘুমিয়ে থাকা বাড়িটার কোলে আলো জ্বালে এক এক করে তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে মেঝের উপর

সারা ঘর জুড়ে মিলু ছড়িয়ে রয়েছে রান্নাঘরের বাসনপত্রে, আলনার ভাঁজ করা কাপড়ে, উঠোনে রেখে যাওয়া আচারের শিশিতে, সলতে নিভে যাওয়া প্রদীপের তেলে - সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে মিলুর শরীরি সুঘ্রাণ আঁজলা ভরে অনুভব করার চেষ্টা করে মিলুকে পারে না মিলু নেইএই কথা মানতে চায় না মন অতৃপ্তি, হতাশা একসময় আক্রোশে পরিণত হয় রাঘবের

 

তখন উত্তেজিত স্নায়ু শীতল করতে হুড়হুড় করে ঠাণ্ডা জল ঢালে সে উত্তেজনা কমলে যেন বাস্তবে ফেরে স্নান সেরে ভাত বসায়

হাঁড়িতে রোজ দু'জনের মতো চাল ফেলে ভাত ফুটে উঠলে দু'টো থালায় ভাগ করে, উপর থেকে সামান্য নুন-ঘি ছড়িয়ে দেয় তারপর একটা থালা টেনে গবগব করে খেতে থাকে

 

খাওয়া হয়ে গেলে অন্য থালা ভর্তি ভাত নিয়ে বেরিয়ে আসে উঠোনে তুলসীতলার কাছে একটা গর্ত অবহেলা ভরে অর্ধেকটা ভাত ঢেলে দেয় তার মধ্যে তিন পা এগিয়ে গিয়ে আরও একটা গর্ত দেখলেই বোঝা যায় সদ্য মাটি দিয়ে সেগুলো ভরাট করেছে কেউ দ্বিতীয় গর্তে থালার অবশিষ্ট ভাত উপুড় করে দেয় রাঘব তারপর চুপ করে বসে থাকে গর্তের পাশে সোহাগভরে তাকিয়ে থাকে কোনওদিন আবার বিড়বিড় করে বলে, "আজ এই খাও, একদিন তোমার জন্য ইলিশ নিয়ে আসব..." 

 

এই গর্তে মিলু আছে মিলু খাচ্ছে

                                                                                                                              অলঙ্করণ: শুভ্রনীল ঘোষ

______________________________________________________________________________


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি