ছেলেটা কাছাকাছি আসার আগেই তার ভয়ার্ত গলা শুনতে পেলাম, ফায়ারিং... ফায়ারিং...: সাহিল



আমি সাহিল। ঠিক যেখানে পহেলগাঁও থেকে ঘোড়া নিয়ে আপনারা পাঁচ কিলোমিটার চড়াই বেয়ে উঠে যান বৈশরণ ঘাটিতে সেখানে ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি রোজ। কালও ছিলাম। ছেলেগুলো ট্যুরিস্ট নিয়ে উপরে গেছে। আমি তখন নীচে, অন্যান্য দিনের মতোই জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে আছি। এরাই তো সব। এরা আছে তাই আমরা আছি, কাশ্মীর আছে। আজ যে আবার আমরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি, বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছি তা তো এই ট্যুরিস্টদের জন্যই। আমি এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইছিলাম, আর কারা উপরে ওই মিনি সুইজারল্যান্ড দেখতে যেতে চান?

কিন্তু আমার প্রশ্ন মুখেই রয়ে গেল। তার আগেই উপর থেকে আর্তনাদ ভেসে এল। আমরা সবাই ত্রস্তভাবে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের ছেলেগুলো তাদের ঘোড়া আর পর্যটক নিয়ে প্রায় হুমড়ি খেতে খেতে ওই সর্পিল পথ ধরে নীচে নামছে।

কী এমন হল? কী ব্যাপার? 

ছেলেটা কাছাকাছি আসার আগেই তার ভয়ার্ত গলা শুনতে পেলাম, ফায়ারিং... ফায়ারিং...

গলা শুকিয়ে গেল আমার, ফায়ারিং? তা কী করে হয়? 

ওদের সম্মিলিত ভীত গলার স্বর থেকে ঘটনাক্রম আঁচ করার চেষ্টা করলাম। তবে সবচেয়ে আগে যেটা মাথায় এল তা হল, বৈশরণে আরও অনেক ট্যুরিস্ট আটকে আছে। তাদের সাহায্য দরকার এখন।

ছুটলাম আমরা। যতজন ছিলাম, মনের সমস্ত সাহস জড়ো করে ছুটলাম। 

ওই দুর্গম পথ বেয়ে বৈশরণ পৌঁছানো বড় সহজ নয়। আমরা একটা শর্টকাট জানি। সেটাই ধরলাম।

মাঝরাস্তায় পৌঁছে আরও অনেককে দেখতে পেলাম। ঘোড়াওয়ালা, ঘোড়া আর ভীত, আহত ট্যুরিস্ট। শুনলাম কারা যেন এসে গুলি চালিয়েছে আবার। বৈশরণের জন্নতে কিছুক্ষণ আগেও যারা আনন্দ করছিল, খেলছিল নিজের মনে তাদের গুলি করে মেরে ফেলেছে কারা। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। আবার? আবার তাহলে অশান্ত হতে চলেছে কাশ্মীর?

ওখানে আর্মি ছিল না। কোনদিনই থাকে না। অত উঁচুতে, ওই মনোরম এক বুগিয়ালে যেখানে মানুষ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দর্শন করে সেখানেও যে কোনও কাপুরুষের দল লুকিয়ে থেকে এভাবে হত্যা করবে নিরীহ ট্যুরিস্টদের তা আর কে ভেবেছিল।

একটু পরেই সমস্ত এলাকা আর্মির দখলে চলে গেল। আমরা ক্লান্ত, বিষণ্ণ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। বন্ধ হয়ে গেল মার্কেট। বন্ধ হয়ে গেল বাজার, বেচা-কেনা। যাদের সাধ্য ছিল তারা ফিরে গেল এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে যত দূরে সম্ভব। বাকিরা আমাদেরই মতো অজানা ভবিতব্যের আশঙ্কায় বসে কাঁপতে লাগল পহেলগাঁওতেই। সারাদিন আর মুখে খাবার ওঠেনি কাল। অশান্ত মন শুধু প্রশ্ন করেছে কেন আমাদের সঙ্গেই এমন হয় বারবার। যতবার ভাবি এবার একটু সুদিন আসছে, আল্লাহ্‌ আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন, ঠিক তখনই একটা না একটা ঝঞ্ঝা এসে আছড়ে পড়ে কাশ্মীরীদের নসিবে। 

এরপর? কী হবে এরপর? হোম মিনিস্টার এলেন। বড়ো বড়ো অফিসার এলেন। দেশ-বিদেশের মিডিয়া এল। আজ বাদে কাল সবাই ফিরে যাবে নিজের জায়গায়। ট্যুরিস্ট কি আর ফিরবে কাশ্মীরে?

আমাদের আয়-উপায়, বেচা-কেনা সব ছাপিয়ে যে প্রশ্নটা সারারাত আমাকে ঘুমোতে দেয়নি তা হল, এরা কারা? বারবার নিরীহ মানুষ শিকার হচ্ছে এদের হাতে, আর কতদিন? দু'জন ঘোড়াওয়ালা যাদের দেখতাম নিয়মিত, সেই ছেলে দুটো আর ফেরেনি। বৈশরণের ঘাসে শেষবারের মতো বন্ধ হয়ে গেছে তাদের চোখ। মুগ্ধতার বদলে একরাশ ভয় নিয়ে তারা চলে গেছে পরপারে। আর সেই হতভাগ্য ট্যুরিস্টরা, যারা হয়তো নিজেদের নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছিল কাশ্মীর থেকে অথবা যারা জমা করতে চেয়েছিল সারাজীবনের স্মৃতি, কী দোষ ছিল সেই বেচারাদের? সারা জীবনের দুঃস্বপ্ন ছাড়া কী পেল তারা? 

জানি না আর কবে স্বাভাবিক হবে কাশ্মীর। জানি না কবে ফিরবে ট্যুরিস্টরা। আদৌ আর ফিরবে কখনও?
(বৈশরণে ঘোড়ার মালিক সাহিল। তার বেশ কয়েকটি ঘোড়া সহিস সমেত নিয়মিত পহেলগাঁও থেকে বৈশরণ উপত্যকায় যাতায়াত করে। তিনি নিজে নিচে থেকেই সম্পূর্ণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। আজ ফোনে তিনি জানালেন এই কথাগুলো— স্বাভাবিকের তুলনায় বিষণ্ন, গভীর ও উদ্বিগ্ন শোনাল তার স্বর।)




ভয়ের একটা ছায়া রয়েছে চারপাশে: মুক্তার

আমি মুক্তার, ট্যাক্সি চালাই শ্রীনগর থেকে বিভিন্ন রুটে। পহেলগাঁও-ও যাই। আমি কাল বাড়িতেই ছিলাম। ভয়ে আর কষ্টে রাস্তায় বেরোইনি। গতকাল, যখন এই ভয়ঙ্কর হামলা হল, আমি সেদিন পহেলগাঁওতে ছিলাম না। শ্রীনগরের লোকাল সাইটসিয়িং করাচ্ছিলাম ট্যুরিস্ট পার্টিকে। ফলে ওখানে কী হয়েছে জানতে পারিনি। যা জেনেছি, শুনেছি টিভি দেখে আর পরিচিতদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে।

শ্রীনগরে আপাতত সব ঠিকই আছে। গুলমার্গ, সোনমার্গ সবই খোলা আছে। সকলে ঘুরছে। তবে গোটা একদিন, মানে গতকাল, জম্মু ও কাশ্মীর পুরোটাই বন্ধ ছিল। সত্যি বলতে কি ভয়ের একটা ছায়া রয়েছে চারপাশে। পহেলগাঁও এখনও বন্ধ। কিন্তু যে ট্যুরিস্টরা শ্রীনগরের দিকে রয়েছেন, তারা যতটুকু সম্ভব ঘোরাফেরা করছেন। সকলেই ভয় পেয়েছে। ভয়ের পরিবেশ অবশ্যই তৈরি হয়েছে। আর ট্যুরিস্ট সিজনে তার ছাপ পড়বেই। ক্ষতি হবে অনেকটাই। এখনই অনেক বুকিং ক্যান্সেল হচ্ছে। যদিও আমার চেনাজানা কারুর কিছু হয়নি, কিন্তু যারা মারা গেল, তারা তো প্রত্যেকেই কারুর বাড়ির লোক! 

আমাদের তো সবদিক থেকেই ক্ষতি হল। বদনামও হল, টাকাপয়সারও ক্ষতি হল। আপনারা ভালো থাকুন। আপনারা যারা ভালোভাবে ঘুরে, সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে গেছেন, এটাই বড় কথা। সবই উপরওয়ালার হাতে। আমরা আর কী করব! আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করি সব দ্রুত স্বাভাবিক হোক।

(মুক্তার একজন ট্যাক্সিচালক, সমস্ত ট্যুরিস্টদের সে কাশ্মীর ঘুরিয়ে দেখায়। মূলত শ্রীনগর থেকেই সে অপারেট করে। ফোনে যোগাযোগ করা হলে মুক্তার এই কথাগুলো আজ আমাদের জানায়।)


মন্তব্যসমূহ

  1. সারা দেশ তো বটেই, পহেলগাঁও এবং অন্যত্র কাশ্মীরীরাও এই নারকীয় জঙ্গী হামলার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ সহ সমস্ত রকমের আতঙ্কবাদ নিশ্চিহ্ন হোক, ধর্মকে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ হোক--- ভারত সহ সারা বিশ্বে সেই সভ্য দিন নেমে আসুক।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি