‘আয় তোর মুন্ডুটা দেখি, আয় দেখি [ক্যালিপার্স] দিয়ে’: ব্রিটিশ-ভারতে ফ্রেনলজি চর্চা ও কয়েকটি ঠগি-করোটির রোমাঞ্চকর বৃত্তান্ত -

 


ফ্রেনলজিকাল বাস্ট ওক্যালিপার্স

‘আয় তোর মুন্ডুটা দেখি, আয় দেখি [ক্যালিপার্স] দিয়ে’: ব্রিটিশ-ভারতে ফ্রেনলজি চর্চা ও কয়েকটি ঠগি-করোটির রোমাঞ্চকর বৃত্তান্ত


সম্রাট লস্কর


মাননীয় মহাশয়,

কিছুদিন পূর্বে আপনি আমার উপর যে কার্যের দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছিলেন তাহা আমি সঠিক সময়ে সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারি নাই। তাহার জন্য আমি যারপরনাই লজ্জিত। আমি অবশেষে আপনার নিমিত্ত দশটি করোটি প্রেরণ করিলাম। এগুলি যদি আপনার কার্যের উপযুক্ত বলিয়া গণ্য করেন, আমি আপনার বর্তমান গবেষণার জন্য এই প্রকার আরও করোটি প্রেরণ করিব। আপনার যদি অপর ধরনের করোটির প্রয়োজন হয়, আমায় তাহা নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে আমি সেই ধরনের করোটিরও বন্দোবস্ত করিতে পারিব।

নানা কার্যে ব্যস্ততাজনিত কারণে বিলম্ব হইলেও আমার স্থির বিশ্বাস যে অতি সত্ত্বর আমি আপনার সাক্ষাতের সৌভাগ্যলাভ করিব। আপনার একান্ত অনুগত,

রাম মোহন রায়

 

হ্যাঁ, ১০ মার্চ, ১৮২২-এ ইংরেজিতে লেখা এই চিঠিটার লেখকের নাম ঠিকই পড়েছেন। কোনও মুদ্রণ প্রমাদ নয়, একই নামের ভিন্ন কোনও ব্যক্তি নয়, চিঠির প্রাপককে যিনি দশটি মানব করোটির জোগান দিচ্ছেন এবং আরও করোটির জোগানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তিনি ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রাজা রামমোহন রায়ই বটে। আপাত দৃষ্টিতে একটু চমক লাগে তো বটেই। মানব করোটি নিয়ে ঠিক কী করছেন রামমোহন? কোনও বেআইনি কাজ বা তন্ত্র সাধনার সঙ্গে যোগের ইঙ্গিত নয় তো? কিন্তু তাই যদি হত, তা হলে কি সেসব কথা কোনও চিঠিতে এরকমভাবে লেখা হত? চিঠিতে যে গবেষণার উল্লেখ আছে সেটা-ই বা কী নিয়ে? অতএব, চটজলদি বিচার না করে আমাদের একটু গভীরে যেতে হয়।

রামমোহন চিঠিটা লিখেছেন ডাঃ জর্জ মারে প্যাটারসনকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতায় পোস্টেড সার্জেন প্যাটারসন সেই সময় মেতে উঠেছেন এক অভিনব বিদ্যাচর্চায়। না, তিনি অবশ্য একা নন। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই ইয়োরোপের বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই নতুন ‘বিজ্ঞান’ নিয়ে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে গেছে। শুধু বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকেরাই নয় বেশ কিছু সাধারণ মানুষও যারা সমসাময়িক বিষয় ও জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে কিছু খোঁজ খবর রাখেন, তারাও তখন মেতে উঠেছেন ফ্রেনলজি নিয়ে। হ্যাঁ, ফ্রেনলজি (Phrenology)— এই নামেই পরিচিত হয়েছে এই নতুন বিদ্যা। বাংলা পরিভাষা হিসেবে মস্তিষ্কতত্ত্ব, করোটিতত্ত্ব বা শিরোমিতি-বিদ্যা কোনওটাই ঠিক মানানসই মনে না হওয়ায় ফ্রেনলজি হিসেবে উল্লেখ করাটাই সুবিধাজনক হবে। ঠিক কী এই ফ্রেনলজি যা এক কালে বিজ্ঞানী মহলে তুমুল আলোড়ন ফেললেও কয়েক দশকের মধ্যেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ছদ্ম-বিজ্ঞান, এমনকি অপবিজ্ঞান হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে? সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক। ফ্রেনলজি বলে যে জীবের (মূলত মানুষের) করোটির বহির্ভাগের আকারের ভিন্নতা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে নির্দেশ করে। করোটি হল মস্তিষ্কের আচ্ছাদন; মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে যেহেতু জীবের/মানুষের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো নির্দিষ্ট থাকে সেহেতু করোটির আকার বা করোটির গায়ের উঁচু-নিচু অংশগুলো দেখেই আন্দাজ করাই যায় যে সেই মানুষটির স্বভাব বা আচরণে কোন কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য দেখা যাবে। অতএব, করোটির উপযুক্ত নিরীক্ষণ ফ্রেনলজির একেবারে প্রাথমিক ধাপ। শৌখিন ফ্রেনলজিস্ট প্যাটারসনকে রামমোহন কেন বারোটি (প্রথম দশটির পর আরও দু’টি) করোটি পাঠিয়েছিলেন সেটা বুঝতে নিশ্চয়ই এখন আর কোনও সমস্যা থাকার কথা নয়।

ফ্রেনলজি চর্চার প্রকৃত সূচনা হয় জার্মান চিকিৎসক ফ্রাঞ্জ জোসেফ গলের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার বছরগুলিতে গল তাঁর নিজস্ব ফ্রেনলজি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত ছিলেন। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি যে মস্তিষ্কের ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু নির্দিষ্ট স্থানেই অবস্থিত তা নিয়ে গলের মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। কারও মস্তিষ্কের যে অংশগুলোর ঘনত্ব বেশি, করোটির আকার সেই স্থানে অবশ্যই কিছুটা উঁচু হতে বাধ্য। আর সেই আবের মতো উঁচু অংশ বা bumps-গুলো দেখেই সেই মানুষটির মধ্যে কোন কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য দেখা যাবে সেটা আন্দাজ করা যাবে— এই ছিল তাঁর তত্ত্বের মোদ্দা কথা। গল মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্থানে ২৭টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা জানিয়েছেন। গলের এক সময়ের সহকারী ও পরবর্তী কালের প্রতিদ্বন্দ্বী জোহান স্পারজিম আবার বলেছেন ৩৫টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা যেটাই ফ্রেনলজিস্টদের মধ্যে দীর্ঘদিন মান্যতা পেয়ে এসেছে। স্পারজিমের প্রচেষ্টায় ফ্রেনলজি ছড়িয়ে পড়েছে প্রথমে ইয়োরোপের নানান দেশে এবং পরবর্তীতে আমেরিকাতেও। ধীরে ধীরে এসেছে মানাসই যন্ত্রপাতি যেমন করোটির বিভিন্ন স্থানের সঠিক মাপের জন্য ক্যালিপার্স ও ক্রেনিয়মিটার; এসেছে করোটির মডেল (phrenological bust) যার উপর চলত ফ্রেনলজির শিক্ষানবিশদের অপটু হাতের প্র্যাক্টিস। মানে সব কিছু নিয়ে ফ্রেনলজি তখন রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছে। এমনকি কয়েক দশকের মধ্যে ফ্রেনলজিকে বিজ্ঞানের মূল ধারা থেকে ত্যাজ্য করা সত্ত্বেও শৌখিন ফ্রেনলজিস্টরা এই বিদ্যার চর্চা চালিয়ে গেছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। বিজ্ঞানের স্বীকৃতি হারালেও pseudo-science হিসেবেও ফ্রেনলজির আকর্ষণ ছিল বিশ্বজনীন।



                        চিত্র ১: জোসেফ গলের ফ্রেনজিকাল পরীক্ষা— একটি কার্টুন



চিত্র ২: মানব মস্তিষ্কে ৩৫টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অবস্থান (স্পারজিমের চার্ট)

      গ্রেট ব্রিটেনে ফ্রেনলজির রমরমা শুরু হয় স্পারজিমের ১৮১৪-১৮১৫ সালের ব্রিটেন সফরের অব্যবহিত পরেই। লন্ডন নয়, ব্রিটেনের ফ্রেনলজি চর্চার মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা। ১৮২০ সালে জর্জ কোম, তার ভাই অ্যান্ড্রু কোম আর ডেভিড ওয়েলসের সম্মিলিত উদ্যোগে স্থাপিত হয় এডিনবরা ফ্রেনলজিকাল সোসাইটি। বছর-ছয়েকের মধ্যে এই সংস্থার সদস্য সংখ্যা ১২০ পেরিয়ে যায় যাদের মধ্যে একটা গরিষ্ঠ অংশই ছিলেন পেশাগতভাবে চিকিৎসক। স্পারজিম-অনুপ্রাণিত জর্জ কোম বিস্তৃত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ফ্রেনলজি চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেন। তাঁর লেখা ‘The Constitution of Man’ এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে প্রকাশের দু’দশকের মধ্যেই ৩ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হয়ে যায়। বইটির বিপুল জনপ্রিয়তা থেকেই আন্দাজ করা যায় যে ফ্রেনলজি চর্চা শুধু কয়েকজন চিকিৎসক বা আগ্রহী বিজ্ঞানীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সাধারণ মানুষের মধ্যেও ফ্রেনলজি নিয়ে আগ্রহ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।

ফ্রেনলজি নিয়ে জর্জ কোম আর তার সহযোগীদের উৎসাহ সাগর পার হয়ে ব্রিটিশ-ভারতে পৌঁছোতে বেশি সময় নেয়নি। আমাদের পূর্বপরিচিত জর্জ মারে প্যাটারসনকে ব্রিটিশ-ভারতে ফ্রেনলজি চর্চার অগ্রণী হিসেবে গণ্য করা যেতেই পারে। মৃত মানুষের মাথার খুলি নানাভাবে জোগাড় করে তার উপর প্যাটারসন চালাতেন বিভিন্নরকম ফ্রেনলজিকাল এক্সপেরিমেন্ট। ইয়োরোপিয়ানদের করোটি আর ভারতীয়দের করোটির মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা টেনে প্যাটারসন প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ভারতীয়দের মধ্যে চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব দেখা যায়। ঊনবিংশ শতকের বিজ্ঞানের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন জাতিদ্বেষ ছিল সেটা প্যাটারসনের মতো ফ্রেনলজিস্টদের সিদ্ধান্ত থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। তাঁর ‘Phrenology of Hindostan’ লেখায় প্যাটারসন বলেন যে হিন্দুদের (পড়তে হবে ভারতীয়দের) করোটি পরীক্ষা করলেই বোঝা যায় যে তাদের মধ্যে ইয়োরোপিয়ানদের মতো লড়াই করার কোনও তেজ নেই। ভারতীয়রা ধূর্ত, ভিতু, উদ্ধত; তাদের খুলিতে গোপনীয়তা, সাবধানতা ও আত্ম-সম্মানের অংশগুলি উঁচু থাকে। অধিকাংশ সিদ্ধান্তে তারা উপনীত হয় তুলনার মাধ্যমে; যুক্তি দিয়ে বিচারের কোনও চেষ্টা তাদের নেই। এইরকম তীব্র রেসিস্ট সিদ্ধান্তগুলিকে বিজ্ঞানের আপাত মোড়ক দিয়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা ফ্রেনলজির মতো বিদ্যায় প্রায়ই দেখা যেত। প্যাটারসন অবশ্য একটা বেশ উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। ১৮২৫ সালে কলকাতার বুকে তৈরি করেন বিশ্বের প্রথম ফ্রেনলজিকাল স্কুল। বলাই বাহুল্য, সেই স্কুল বেশিদিন চালানো যায়নি কিন্তু ব্রিটিশ-ভারতে ফ্রেনলজি চর্চা কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে চলেছিল বিংশ শতকের গোড়া পর্যন্ত।

১৮৪০-এর দশক থেকে যখন ইয়োরোপ ফ্রেনলজির মাতামাতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে, ঠিক সেই সময়ে, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে ৭ জুন, ১৮৪৫-এ কয়েকজন উৎসাহী ব্যক্তির চেষ্টায় কলকাতায় স্থাপিত হচ্ছে শহরের নিজস্ব ফ্রেনলজিকাল সোসাইটি। এই সোসাইটির সভ্য রাধাবল্লভ দাস স্পারজিম আর কোমের তত্ত্বের সার সংগ্রহ করে লিখে ফেললেন বাংলা ভাষায় ফ্রেনলজি নিয়ে প্রথম বই— ‘মনস্তত্ত্ব সারসংগ্রহ’ যেটি প্রকাশিত হয় ১৮৫০ সালে। কলকাতার শৌখিন ফ্রেনলজিস্টদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অবশ্যই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। অভিনব বিদ্যার প্রতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বভাবজাত আকর্ষণ থাকায় ফ্রেনলজির প্রতি তিনি যে আগ্রহী হবেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। একইভাবে তিনি ঝুঁকেছিলেন ফিজিয়নমি (physiognomy) অর্থাৎ মানুষের মুখচিহ্ন দেখে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিচারের বিদ্যার দিকে। ১৮৮৫ সালে বালক পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফিজিয়নমি নিয়ে প্রবন্ধ— ‘মুখচেনা’; আর সেই বছরেই কল্পনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ফ্রেনলজি নিয়ে প্রবন্ধ ‘শিরোমিতি-বিদ্যা’। বেশ কিছু বছর ধরে তিনি তাঁর পরিচিতদের উপর বা আরও সঠিকভাবে বললে তাদের মাথার উপর চালিয়েছিলেন তাঁর শখের ফ্রেনলজি চর্চা। পণ্ডিত কৃষ্ণগোপাল ভট্টাচার্যের মাথা দেখে তাঁর স্বভাব নিয়ে যা যা বলেছিলেন পণ্ডিতমশাই স্বীকার করে নেন যে তার অনেকটাই মিলেছে। যদিও পণ্ডিতমশাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এটাও জানান যে ফ্রেনলজি দিয়ে বিচার করলে কিছু কিছু জিনিস মেলে, সব মেলে না। তবুও তাঁর ফ্রেনলজি চর্চা অব্যাহত ছিল আরও কয়েক বছর। ১২৯৯ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৮৯২ সালে) সাধনা পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায় তিনি ফ্রেনলজি নিয়ে আবার আর-একটা আলোচনা করেন— ‘আধুনিক মস্তিষ্কতত্ত্ব ও ফ্রেনলজি’। এক সময়ে বিদ্যাসাগরের মুখের উপর ফিজিয়নমি বিদ্যা প্রয়োগ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ করেছিলেন। এবার তাঁর ইচ্ছে হল বিদ্যাসাগরের মাথাটার উপর ফ্রেনলজিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর। বিদ্যাসাগরের থেকে প্রাথমিক সম্মতি পাওয়া গেলেও ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু শেষ পর্যন্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ইচ্ছেকে পূরণ আর করতে দেয়নি। নিজের বিখ্যাত ভাইয়ের মাথার উপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কোনওদিন ফ্রেনলজিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত প্রমাণ কিছু পাওয়া যায় না বটে, তবে রবীন্দ্রনাথের মাথা নিয়ে একটা ঘটনা উল্লেখ না করে এখানে পারা যাচ্ছে না, যার সঙ্গে ফ্রেনলজির একটা হালকা হলেও যোগ আছে। ঘটনাটার উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ নিজেই করেছেন তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-তে। ব্রাইটনে রবীন্দ্রনাথ ভর্তি হয়েছেন একটা পাবলিক স্কুলে। বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের নজরে প্রথমেই এল নতুন ছাত্রের মাথার উপর। উনি বলে উঠলেন— ‘বাহবা, তোমার মাথাটা তো চমৎকার!’ (What a splendid head you have!)

আন্দাজ করাই যায় যে পাবলিক স্কুলের সেই অধ্যক্ষ তাঁর ছাত্রের মাথাটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন একজন ফ্রেনলজিস্টের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদার মতো তাঁর শিক্ষকও হয়তো ছিলেন এক শৌখিন ফ্রেনলজিস্ট।



চিত্র ৪: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

তবে ব্রিটিশ-ভারতে ফ্রেনলজি চর্চা নিয়ে আলোচনা করার সময় ব্রিটিশ-ভারতের কিছু মৃত অপরাধীর খুলি নিয়ে ফ্রেনলজিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার রোমাঞ্চকর ইতিহাসটি না বলে থাকা যায় না। আর যখন জানা যায় যে সেই অপরাধীরা আর কেউ নয় বরং ঊনবিংশ শতকের সেই কুখ্যাত ঠগিরাই— তখন আমাদের মধ্যে আগ্রহের মাত্রা অনেকটাই বাড়ে বই-কি। তা এরকমই কয়েকজন কুখ্যাত ঠগির থুড়ি ঠগিদের মাথার খুলির বিলেত ভ্রমণের বৃত্তান্তই এখানে দেব এবার। 

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকাল স্কুলের একটা বিশেষ কক্ষে শয়ে শয়ে মানব-করোটি রাখা আছে। তাদের মধ্যে একটি বিশেষ র‍্যাকে আছে সাতটি করোটি, যেগুলো সেই ১৮৩৩ সালে ভারত থেকে পাড়ি দিয়েছিল এডিনবরা ফ্রেনলজিকাল সোসাইটির উদ্দেশ্য। রামমোহন প্যাটারসনকে যে বারোজন দেশীয় ব্যক্তির করোটি পাঠিয়েছিলেন তাদের কোনও পরিচয় জানা যায় না; এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা সাতটি করোটির ক্ষেত্রে সে-সমস্যা একেবারেই নেই। প্রতিটি করোটির কপালের হাড়ের ওপরই মানুষটির নাম লেখা আছে; আর নামের পরেই তাদের পরিচয়— ‘ঠগি’। নামগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক— দুর্গাপাল, গঙ্গা বিষ্ণু, সুফর সিং, হোসেন আলি খান, কেরামত খান, বক্সা আর গুলাব খান। হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের এই সাতজন ঠগির করোটি মধ্যভারত থেকে কীভাবে সুদূর স্কটল্যান্ডে এসে হাজির হল তাই নিয়ে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক কিম ওয়াগনর এক অসাধারণ গবেষণা করেছেন। তিনি যেন করোটিদের সাক্ষ্য শুনে তাদের বিলেতে আসার আগের ও পরের ইতিহাসটা খুঁড়ে বের করেছেন। ওয়াগনরের দেখানো পথে আমরাও সেই ভুলে যাওয়া ইতিহাসের টুকরো আর তার সঙ্গে ফ্রেনলজির যোগটা ঠিক কোথায় সেটা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি।

দুর্গাপাল আর বাকি ছয়জন ঠগি ছিলেন সিন্দৌস এলাকার অধিবাসী যা বর্তমান উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব লেঠেল বাহিনীতে কাজ করা, অল্পসল্প কৃষিকাজ করার বাইরে ঠগি হয়ে দস্যুবৃত্তি করা ছিল তাদের প্রধান পেশা। অসহায় তীর্থযাত্রী বা ভ্রমণার্থিদের নৃশংসভাবে হত্যা করে যে সম্পদ তাদের হাতে আসত, তার একটা ভাগ জমিদারদেরও দিতে হত। মানে এটা বেশ সমাজ-স্বীকৃত (অবশ্যই প্রকাশ্যে নয়), সংগঠিত অপরাধ-ই ছিল। এভাবেই চলছিল, কিন্তু এর মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন অংশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার পরই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় মন দিল। মধ্য ভারতে উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান ঠগি দমনে মনোনিবেশ করলেন। তাঁর কুশলী নেতৃত্বে অসংখ্যা ঠগিকে গ্রেপ্তার করা হল। তারপর লোক দেখানো বিচারের পর অধিকাংশকেই ফাঁসি দেওয়া হল, বাকিদের মধ্যে কেউ পেল দ্বীপান্তরের সাজা, কেউ যাবজ্জীবন, আবার ফিরিঙ্গিয়ার মতো ঠগি রাজসাক্ষী হয়ে অন্য ঠগিদের ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাল। ১৮৩১ সাল নাগাদ দুর্গাপাল আর বাকি ছয়জনের গ্রেপ্তার এইভাবেই হয়। যদিও তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগেই।

অভিযুক্ত ঠগিদের নিয়ে আসা হয় স্লিম্যানের কর্মস্থল অধুনা মধ্যপ্রদেশের সাগরে। বছর খানেক ধরে চলে অন্য অভিযুক্ত ঠগিদের সঙ্গে এই সাত জনের বিচার প্রক্রিয়া। বক্সা জেলেই অসুস্থাজনিত কারণে মারা যায়, কিন্তু সিন্দৌসের বাকি ছয়জন অভিযুক্তই বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়। ১৮৩২ সালের ৩০ জুনের ভোরবেলায় ছয়জনকেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। স্লিম্যানের লেখা অফিসিয়াল রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ছয়টি মৃতদেহেরই তাদের ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য করা হয়। স্লিম্যান যেটা রিপোর্টে লেখেননি তা হল, ফাঁসির সময় উপস্থিত বেঙ্গল মেডিকাল সার্ভিসের ব্রিটিশ ডাক্তার হেনরি হার্পার স্প্রাই দেহগুলো থেকে মুন্ডুগুলো কেটে রেখে দেন।

এই কাজটা স্প্রাই কেন করলেন তা জানতে অবশ্য কোনও সমস্যা হয় না। অক্টোবর ১৮৩২ সালে নিজের মা-কে লেখা একটা চিঠিতে স্প্রাই জানান যে, তিনি মুন্ডুগুলো সংগ্রহ করেছেন যাতে সেগুলো লন্ডন ফ্রেনলজিকাল সোসাইটিতে পাঠানো যায়। কিন্তু সরকারের চিফ সেক্রেটারি সুইনটনের আদেশ এসেছে যে ওগুলো এডিনবরায় জর্জ কোমের কাছে পাঠাতে হবে। এই হাফ ডজন ঠগি-মুন্ডুর আগে স্প্রাই নিজের সংগ্রহে এনে ফেলেছেন বন্দিদশায় প্রাণ হারানো বক্সার মাথাও। অতএব, সব মিলিয়ে সাতটি মুন্ডু পাঠিয়ে দেওয়া হল এডিনবরা ফ্রেনলজিকাল সোসাইটিতে। ফ্রেনলজির তত্ত্ব প্রয়োগ করে অপরাধীর, বিশেষত দেশীয় অপরাধীর মনস্তত্ত্ব বিচার করার এক সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল এডিনবরার ফ্রেনলজিস্টদের কাছে।

এই সাতটি ঠগি করোটির ওপর ফ্রেনলজিকাল পরীক্ষা চালালেন কোমের ভাগ্নে রবার্ট কক্স। কক্সের মতে এই করোটিগুলো থেকে জানা যায় যে এই অপরাধীদের মধ্যে মানুষের তামসিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন যৌন-কামনা, গোপনীয়তা, সাবধানতা, যশ লাভের আকাঙ্ক্ষা তীব্রভাবে উপস্থিত ছিল। যদিও গঙ্গা বিষ্ণু আর হোসেন আলি খানের করোটি উন্নততর; তাদের খুলি দেখে আন্দাজ করা যায় যে তাদের চরিত্রে তামসিক ও সাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে ভালোই ভারসাম্য ছিল। ব্রিটিশদের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা ছিল যে, ঠগিরা আসলে রক্তলোলুপ সিরিয়াল কিলার; মানব হত্যা করাতেই তাদের আনন্দ। কক্সের ফ্রেনলজিকাল পরীক্ষা কিন্তু অন্য কথা জানায়। উনি পরীক্ষা করে দেখেন যে, সাতটির মধ্যে কোনও করোটিতেই চরিত্রের ধ্বংসাত্মক (destructiveness) দিকটি প্রকট নয়। তাতে আন্দাজ করা যেতেই পারে যে, ঠগিরা শুধু দস্যুবৃত্তি করে লাভ করার জন্যই এই কাজ করত। গোপনীয়তার (secretiveness) অংশটি আবার উঁচু যা থেকে তাদের মানব হত্যার মোটিভটা স্পষ্ট হয়। ঠগিরা চাইত না তাদের অপরাধের যেন একজনও সাক্ষী থাকে। করোটির যে অংশে বিবেক (conscientiousness) থাকার কথা সেটা এই ঠগি করোটিগুলোতে বিশেষত দুর্গাপাল আর গুলাব খানের ক্ষেত্রে বেশ নিচু। তা থেকে সিন্ধান্তে আসাই যায় যে ঠগিরা বেশ বিবেকহীন অপরাধী ছিল। স্লিম্যান বা স্প্রাই ঠগিদের চরিত্র নিয়ে যে সব ধারণা পোষণ করতেন কক্সের ফ্রেনলজিকাল পরীক্ষা মোটামুটি সেই ধারণাগুলোকেই মান্যতা দেয়। কক্স নিজেও সেটা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন, ‘ it may be confidently affirmed, that so far as our information extends, the heads and characters of these seven ‘’Thugs’’ exactly correspond’।


 চিত্র ৫: এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা গঙ্গা বিষ্ণুর করোটির স্কেচ (ওয়াগনরের আঁকা)

বিংশ শতকের গোড়ায়, ১৯০৬ সালে এই সাতটি ভারতীয় করোটি আবার গবেষণার জগতের সামনে উঠে এল। ফ্রেনলজি ততদিনে বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। নৃতাত্ত্বিক উইলিয়াম টার্নার নির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে কক্সের সিদ্ধান্তগুলো বাতিল করে দিলেন। টার্নার পরিষ্কার বললেন, ঠগিদের এই করোটিগুলো দেখে তাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক চারিত্রক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনও ধারণাই পাওয়া যায় না। অতি উৎসাহী স্প্রাইয়ের ভারতীয় অপরাধীদের মৃতদেহ থেকে মাথা কেটে এডিনবরায় পাঠানো আর তার পরে ওগুলোর ওপর কক্সের ফ্রেনলজিকাল পরীক্ষা চালিয়ে অভিনব সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সত্তর বছরের মধ্যেই তা একেবারে নস্যাৎ হয়ে গেল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা সাতটি করোটি বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব হারিয়ে আজ শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে র‍্যাকে বসে আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর ইয়োরোপীয় অপবিজ্ঞানের রেলিক এই করোটিগুলোর যেন আমাদেরকে অনেক কিছু বলার আছে। কিম ওয়াগনরের মতো ঐতিহাসিকদের প্রচেষ্টায় করোটির সেই অব্যক্ত কথাগুলো আমাদের সামনে উঠে এসেছে। আমাদের শুনতে হবে সেই কথাগুলো।

ফ্রেনলজির রমরমা ছিল কয়েক দশক মাত্র। তার পরেও কিছু মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই বিদ্যার চর্চা চালালেও বিজ্ঞানীদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না একেবারেই। অথচ এটাও ঠিক, ফ্রেনলজি নিয়ে উৎসাহ কিন্তু একেবারে উধাও হয়ে যায়নি। রজার কুটারের মতো কেউ কেউ এখনও মনে করেন যে ফ্রেনলজি ‘science and pseudo-science, nature and culture, science and society’ এর মাঝে কোনও একটা জায়গায় আছে। অমিতাভ ঘোষের মতো লেখক তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘The Circle of Reason’ লিখতে গিয়ে ফ্রেনলজিকে নিয়ে আসেন গুরুত্বের সঙ্গে। ফ্রেনলজি বিজ্ঞান নয় তা জেনেও এই নিয়ে লিখতে লিখতে বা পড়তে পড়তে আমাদের হাত কখন যেন অজান্তেই চলে যায় আমাদের মাথার তালুতে। সেটা ঘুরতে থাকে এদিক থেকে ওদিক, খুঁজতে থাকে খুলির উঁচু-নিচু, বুঝতে চায় ফ্রেনলজির চার্ট অনুযায়ী আমাদের করোটি কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রাধান্যের ইঙ্গিত দেয়। এইভাবে বেঁচে থাকে ফ্রেনলজি আমাদের মধ্যে। 

                                                                 _________

 

তথ্যসূত্র:

(১) Chambers, Claire. Historicizing Scientific Reason in Amitav Ghosh’s The Circle of Reason.”Amitav Ghosh: A Critical Companion. Ed. Tabish Khair. New Delhi: Permanent Black, 2003.

(২) Combe, George. The Constitution of Man Considered in Relation to External Objects (American Edition). Boston: Marsh, Capen and Lyon, 1835.

(৩) রায়, সুশীল; জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কলকাতা: জিজ্ঞাসা, ১৯৬৩

(৪) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ; জীবনস্মৃতি, শান্তিনিকেতন:বিশ্বভারতী, ১৯৭৬

(৫) Wagner, Kim A. "Confessions of a Skull: Phrenology and Colonial Knowledge in Early Nineteenth-Century India." History Workshop Journal, vol. 69, 2010, p. 27-51.

(৬)Transactions of the Phrenological Society. Edinburgh: John Anderson Jun, 1824.


মন্তব্যসমূহ