যুযুধান দুই জিনিয়াস : মুখোমুখি মেঘনাদ সাহা ও চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন - অভীক মোহন দত্ত





 যুযুধান দুই জিনিয়াস : 

মুখোমুখি মেঘনাদ সাহা ও 

চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন


অভীক মোহন দত্ত


 

বয়সের ব্যবধান তাঁদের মাত্রই পাঁচ বছরের। নামডাকের ব্যবধান বিস্তর। আর দু’জনের মানসিকতায়? সে ব্যবধান বুঝি বা অনতিক্রম্য। মানসিকতা-মননের এই দুস্তর ব্যবধানই তাঁদের কিংবদন্তিসম ‘বৈরিতা’র জন্মদাতা। এই লেখায় আমরা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব পূর্ববঙ্গের শিমুলিয়া গ্রামের বৈষ্ণব সাহা পরিবারের সন্তান মেঘনাদ (নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল মেঘনাথ, মাইকেলের কাব্য পড়ে সে-ছেলে নিজেই নিজের নাম বদলে রাখে মেঘনাদ) আর তিরুচিরাপল্লির তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারের চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট পদার্থবিদ্যার আঙিনায় এসে কেমন করে হয়ে ওঠেন একে অন্যের প্রতিস্পর্ধী। আমরা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব কেমন করে-ই বা এই দুই বিশাল প্রতিভার অস্বস্তিকর সহাবস্থান ভারতীয় বিজ্ঞানজগতের স্বাভাবিক ক্রমবিবর্তনের গতিরোধ করেছে বারংবার, তীক্ষ্ণধার খড়্গের মতো দুই ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষে কীভাবে উপর্যুপরি রক্তাক্ত হয়েছে দুই জিনিয়াসের কর্মজীবন, ব্যক্তিমানস। 

 

দুই পৃথিবী 

 

রাডক্লিফের কলমের খোঁচায় ভাগ হয়েছিল অখণ্ড ভারত। বাংলা আর পঞ্জাবের মানুষের বুকে সে ঘা আজও সমান দগদগে। সাহা ও রামনের (মেঘনাদ সাহা ও চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এই নিবন্ধে এর পর থেকে সাহা ও রামন নামে উল্লিখিত হবেন, যথাক্রমে) পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ভারতীয় বিজ্ঞানজগৎকে উত্তর ও দক্ষিণের প্রাদেশিকতায় তেমনই ফেড়ে ফেলে আড়াআড়ি। সে বিভাজনও বুঝি মেলাবার নয় কখনও। কিন্তু সে অনেক পরের কথা। ১৯১৩ সালে সাহা গণিতবিদ্যায় বি এসসি পাশ করে বেরোচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে। প্রথম স্থানের অধিকারী অন্তরঙ্গ সুহৃদ সত্যেন্দ্রনাথ বোস, যিনি জীবনে কখনও কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেননি। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে এম এসসি-র জন্য ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই সাহা জানছেন, মাস্টার্সেও তাঁর কপালে প্রথম স্থানটি নেই।

শুধু প্রথম স্থান কেন? ‘নিচু’ জাতের ছেলে সাহার কপালে অনেক সময় মানুষের মতো ব্যবহারটুকুও জোটেনি। কৈশোরে স্কুলে সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিতে দেওয়া হত না। গরিব ‘নিচু’ জাতের মুদির ছেলেকে আশ্রয়দাতার বাড়িতে নিজের বাসন মেজে দিতে হত, কনকনে শীতের রাতেও। কিন্তু সে তো শহর কলকাতার থেকে অনেক দূরে, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের জোগান সেখানে কম। তাই-ই কি? ইতিহাস নীরবে দেখল মোকাম কলিকাতার শিক্ষার আঁতুড়ঘর প্রেসিডেন্সি কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র সাহা বাধ্য হচ্ছেন ইডেন হস্টেলের বারান্দায় বসে খেতে। উঁচু জাতের ছাত্রদের পঙ্‌ক্তিভোজনে তাঁর স্থান নেই। তাই সাহার চিন্তনে পদার্থবিদ্যার নানা সমস্যার পাশাপাশি যে চিরজাগরূক হয়ে থাকবে আমাদের দুর্ভাগা দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি, বিজ্ঞানীর গজদন্তমিনার থেকে বারংবার নেমে এসে তিনি বাস্তবসম্মত সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন তাদের, তাতে আর আশ্চর্য কী?

আর ওদিকে রামন তামিল আইয়ার ব্রাহ্মণ, বর্ণশ্রেষ্ঠ। কৌলীন্যের অভ্রান্ত ছাপ তার সমগ্র বংশপরিচয়ে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে। রামনের শিক্ষক পিতা ১৮৮৮ সালে বেতন পান মাসে দশ টাকা। সময়-প্রতিবেশের হিসেবে অঙ্কটা বেশ স্বাস্থ্যবান। রামনের নিজের ভাষায়— রুপোর না হলেও, তামার চামচ মুখে নিয়েই তিনি জন্মেছিলেন। যে বয়েসে তরুণ ছাত্র সাহা যুঝছেন দারিদ্র্য আর সামাজিক অনাচারের সঙ্গে, তার পাঁচ বছর আগেই রামন সে বয়েসে পরপর দু’টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ফেলছেন বিলিতি গবেষণাপত্রিকায়। শুধু তাই-ই নয়, ওই একই পত্রিকায় নিয়তির নির্বন্ধে ঠিক পাশাপাশি ছাপা হল বিশ্ববিশ্রুত পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড রালে-র প্রবন্ধ। নোবেলজয়ী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অখ্যাতনাম এই ভারতীয় যুবকটির মধ্যে বিপুল প্রতিশ্রুতির সন্ধান পেয়ে তার সঙ্গে শুরু করলেন পত্রালাপ। স্নেহভরে রামনকে তিনি সেইসব চিঠিতে সম্বোধন করছেন ‘প্রফেসর’ ওদিকে রামন তখন আসলেই মাস্টার্সের ছাত্র।

সামাজিক ও বৌদ্ধিক কৌলীন্যের এমনসব চিহ্ন বহন করে রামন ১৯০৭ সালে এসে পৌঁছোলেন কলকাতায়। উদ্দেশ্য, আশ্চর্য হলেও সত্যি, অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল পদের ভারগ্রহণ। রামনের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক চেয়েছিলেন তাঁর মেধাবী ছাত্রটি ইংল্যান্ডে গিয়ে উচ্চশিক্ষা-গবেষণার পথ বেছে নিক। সহৃদয় সেই ব্রিটিশ ভদ্রলোক বিলেতযাত্রার সমস্ত বন্দোবস্ত করে ফেললেও বাদ সাধে রামনের স্বাস্থ্য— সমুদ্রযাত্রায় তাতে বড়োসড়ো হানির আশঙ্কা। সুতরাং বিলেতে উচ্চশিক্ষা তো বটেই এমনকি ব্রিটিশরাজব্যবস্থার সোনার হাঁস আই সি এস পরীক্ষাও চলে গেল হাতের বাইরে। রামন বেছে নিলেন ‘দি নেক্সট বেস্ট থিং’ ইন্ডিয়ান ফিন্যান্স সার্ভিস। কিছুদিন আগেই বড়োভাই চন্দ্রশেখর সুব্রহ্মণ্যম যোগদান করেছেন সেই সার্ভিসে। রামনের মেধা তাঁকে পৌঁছে দিল সেই পরীক্ষার প্রথম স্থানে এবং ফলস্বরূপ তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক বিদ্যাচর্চার রাজধানী কলকাতার পোস্টিংয়ে

কিন্তু রামন যখন ব্রিটিশপ্রভুর সম্মানজনক নৌকরি নিয়ে রাজধানীতে এসে বসছেন সগর্বে, সাহা কী করছেন? ১৯০৭-এ সাহার বয়েস চৌদ্দো বছর। দু’বছর আগেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে স্কুল বয়কটের জন্য সরকারি ছাত্রবৃত্তিটি তো গেছেই, স্কুল থেকেও হয়েছেন বিতাড়িত। মেধা আর রেজাল্টের জোরে অন্য একটি স্কুলে জায়গা জুটলজুটল যেমন-তেমন একখানি বৃত্তিও। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় (আজকের মাধ্যমিকের সমতুল) পূর্ববঙ্গে প্রথম সাহা। মজার ব্যাপার ইন্টারমিডিয়েটে (বর্তমান উচ্চ-মাধ্যমিকের সমতুল) সাহা অতিরিক্ত বিষয় বাছলেন জার্মান। বিজ্ঞান পড়তে হবে তাঁকে, গবেষণা করতে হবে। আর বিশ শতকের এই প্রথমপাদে জার্মান ভাষা প্রভূত সহায়তা করে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সিংহদুয়ারটি খুলে ধরতে। লক্ষ্যণীয়— সাহা পরিবারের অনটন, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সত্ত্বেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিজ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য— সরকারি নৌকরির স্থান তাঁর দূরকল্পনাতেও নেই। ইন্টারমিডিয়েটে সাহা তৃতীয় সেবার। জার্মান পরীক্ষার ফল আশাতিরিক্ত খারাপ। হবে না-ই বা কেন, কলেজে জার্মান পড়ানোর কেউই নেই, সম্পূর্ণ স্বশিক্ষা।

ওদিকে ১৯০৭-এ রামন কলকাতায় এসে বন্ধুত্ব অর্জন করে ফেলেছেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (Indian Association for the Cultivation of Science, এর পর থেকে আই এ সি এস (IACS) নামে উল্লিখিত) প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ অমৃতলাল সরকারের এবং স্যার আশুতোষ মুখার্জির। আশুতোষের নেকনজরে সেই যে পড়লেন রামন, সে নেকনজর বহাল থাকল আরও বহু বছর। এর খেসারত একসময় দিতে হয়েছিল সাহাকে— কলকাতা ত্যাগ করে। কিন্তু সে কথায় পরে আসা যাবে। রামন তখন মেধা ও উদ্দীপনায় ফুটছেন টগবগ করে। ১৯০৭-এ বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় ছাপা হল তাঁর প্রবন্ধ। বেশি না, মাত্র বছর দুয়েক আগে যখন সাহা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ছেন, সেই ১৯০৫ সনে স্যুইস প্যাটেন্ট অফিসের এক ইহুদি করণিক আইনস্টাইন চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে নিউটোনিয়ান মেকানিক্সের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছেন। আর ঠিক দু’বছর পরে রামন নেচারে প্রবন্ধ প্রকাশ করছেন। বিষয়— আলোর উপর নিউটোনিয়ান গবেষণার উন্নততর বিশ্লেষণ। পুরস্কারও জুটছে হাতে হাতেই। আই এ সি এস-এ পছন্দমতো গবেষণা করার সম্পূর্ণ অনুমতি।

কিন্তু সরকারি মালিকরা নির্দয় বড়ো— নৌকরিতে প্রমোশন নিতে রামনকে যেতে হচ্ছে রেঙ্গুন। তারপর নাগপুর। যাওয়ার আগে অবিশ্যি রামন দেখে যাচ্ছেন আই এ সি এস কর্তৃপক্ষ তাঁর মৌলিক গবেষণায় উৎসাহিত হয়ে বিজ্ঞান প্রচার-প্রসারার্থে নিজেরাই প্রকাশ করছেন এক গবেষণা পত্রিকা— বুলেটিন অফ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। সে পত্রিকা অবশ্যই রামনের কাজগুলির উপরেই নির্ভর মুখ্যত। বছর দুয়েক মন দিয়ে রাজপুরুষের নৌকরিতে কাটিয়ে ১৯১১-তে রামন ফিরলেন কলকাতায়। নিয়তির নির্দেশে সাহা তখন কলকাতাতেই। প্রেসিডেন্সিতে গণিতবিদ্যা নিয়ে পড়ছেন তিনি সে বছরেই কলকাতা থেকে দিল্লিতে চলে যাচ্ছে পঞ্চম জর্জের ভারত সাম্রাজ্যের রাজধানী, সেখানে অপেক্ষারত এক বাঙালি, রাসবিহারী বসু। উদ্দেশ্য বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জের হত্যা।

 

উদ্যোগপর্ব

 

এতক্ষণে এটুকু দেখা গেছে যে সাহা ও রামনের সমান্তরাল দৌড়টি আদপেই অ্যাকিলিস ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতা। তফাত এটুকুই, এখানে অ্যাকিলিস দৌড় শুরু করছেন এগিয়ে থেকে। অবিশ্যি আমরা দেখতে পাব পরবর্তী বছরগুলিতে সে দৌড়ের গতিপ্রকৃতি পাল্টে গিয়ে সে একপ্রকার ডুয়েল হয়ে উঠেছে। ১৯১০/১১-১৯১৫— এই সময়টুকু সাহা কলকাতায় কাটাচ্ছেন ছাত্রজীবন। প্রথমে বি এসসি ও তারপর এম এস সি। সামাজিক প্রতিবন্ধকতাই শুধু নয়, সাহা প্রাণপণ লড়াই করছেন আর্থিক অনটনের সঙ্গেও।

বাবা বুড়ো হয়েছেন, মুদির দোকানের আয় বিশেষ নেই। ওদিকে অনুজ কানাইলালের পড়াশোনার দায়িত্বও অগ্রজ স্বেচ্ছাবৃত হয়ে তুলে নিয়েছেন নিজস্কন্ধে। পড়াশোনার পাশাপাশি অগত্যা দিনরাত এক করে ছাত্র পড়ানো শুরু হয়। পাশাপাশি চলে ইডেন হস্টেলের উঁচুজাতের নানা অত্যাচার। সাহা অবিশ্যি কঠিন ধাতের মানুষ। ছেলেবেলা থেকে জাতের এসব বজ্জাতিতে অভ্যস্ত সাহা উপেক্ষাকেই অস্ত্র করে নিশ্চুপ থাকেন সর্বদা। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা খুব খুঁচিয়েও জানতে পারে না তাঁর শৈশব কৈশোরের বঞ্চনা-লাঞ্ছনার ইতিহাস। সাহা ওদিকে আশ্রয় খুঁজে নেন বিজ্ঞানপাঠে-চর্চায়। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রেসিডেন্সির ক্লাস তাঁকে একপ্রকার প্রশান্তি এনে দেয়। বন্ধু সত্যেন— সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সঙ্গে বিজ্ঞান আলোচনায় তিনি আশ্রয় খুঁজে পান একরকম। তবে সব থেকে বেশি সুখ তাঁর হয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করে। দৃঢ়চেতা দেশভক্ত আচার্য রায়ের ঋষিকল্প ব্যক্তিত্ব, অনাড়ম্বর জীবনযাপন (আচার্য রায় ছিলেন ধনাঢ্য জমিদার সন্তান, কিন্তু তাঁকে দেখে বা তাঁর সঙ্গে কথা বলে তা বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় ছিল না), স্বার্থহীন বিজ্ঞানসাধনার আদর্শ সাহাকে শুধু মুগ্ধই করল না, তাঁকে করে তুলল আচার্যের একনিষ্ঠ ভক্ত। প্রফুল্লচন্দ্রও ভারী স্নেহ করেন সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি ছেলেছোকরার দলটিকে। তাঁদের নিষ্পাপ উজ্জ্বল মুখে তিনি দেখতে পান ভারতীয় বিজ্ঞানজগতের ভবিষ্যৎ, সৎ-আদর্শবান-চরিত্রবান কয়েকটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখ। আচার্য রায়ের মুখ থেকে সাহা শোনেন সমসাময়িক বিজ্ঞানগবেষণার হালহকিকত, শোনেন দেশবিদেশের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কাহিনি

এর মধ্যেই ঘটে গেল মর্মন্তুদ এক ঘটনা। সালটা ১৯১৩। বি এস সি অন্তিম বর্ষ। হস্টেলের সরস্বতী পুজোর মণ্ডপে প্রবেশ করতে দেওয়া হল না সাহাকে। সাহা বরাবরের মতোই নির্বিকার। কিন্তু অন্তরঙ্গ সুহৃদদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল এইবার। প্রিয় মিত্র জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে একদল ছেলে হস্টেল ভেঙে বেরিয়ে এল, সঙ্গে নিল সাহাকেও। নতুন ঠিকানা কলেজ স্ট্রিটের ছানাপট্টির একটি মেস। এই মেসে থাকার সময়েই আই এ সি এস-এর একটি আলোচনা সভায় সাহা প্রথমবারের দেখলেন দীর্ঘদেহী সেই দক্ষিণি ভদ্রলোককে, মূল বক্তা সেই সাদা তেকোনা পাগড়ি পরিহিত মানুষটির প্রশ্নের ঠেলায় ব্যতিব্যস্ত। পৃথিবী এই প্রথম দেখল সাহা ও রামনকে একই ছাদের তলায়। রামন এরমধ্যে পেশাদারি জীবনে প্রভূতরূপে প্রতিষ্ঠিত। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী তিনি। সমানতালে চলেছে গবেষণা। বছর দুয়েকের মধ্যে সাহা এম এসসি পাস করে বেরোচ্ছেন ইউনিভার্সিটি থেকে। তার আগেই রামনকে আশুতোষ আহ্বান জানিয়েছেন সদ্যোজাত সায়েন্স কলেজের সম্মানজনক ‘পালিত প্রফেসর’ পদটিতে যোগ দেওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কয়েকজন যদিও তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন তাতে। একে তো রামনের কোনও ডক্টরেট ডিগ্রি নেই, দ্বিতীয়ত তিনি কোনও প্রশিক্ষণের জন্য কখনওই বিদেশভ্রমণ করেননি। আগেই বলা হয়েছে রামন আশুতোষের নেকনজরে— আশুতোষ সাম্মানিক ডি এসসি বা ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রির বন্দোবস্ত করে দিলেন রামনের জন্য। প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে রামনের নিয়োগ কিছুদিন স্থগিত থাকলেও ১৯১৭-তে পালিত প্রফেসর পদে রামন যোগ দেন সাড়ম্বরে। তার আগের বছরেই সাহা সায়েন্স কলেজে যোগ দিয়েছেন পদার্থবিদ্যার লেকচারার হিসেবে। দু’টি তীক্ষ্ণধার অসির ঠিকানা এখন একটিই কোষ।

বললুম বটে দু’টি তীক্ষ্ণধার অসি, কিন্তু তাদের বহিরঙ্গের তফাত চোখে পড়ার মতোই। রামন রীতিমতো উঁচু সরকারি পদ ছেড়ে অনেক কম বেতনে অধ্যাপনায় যোগদান করেছেন এই কড়ারে, যে, তাঁকে গবেষণার কাজে নিযুক্ত থাকতে দিতে হবে এবং অকারণে ছাত্র পড়ানো বা শিক্ষকতার মতো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের কাজে নিযুক্ত করা যাবে না। সেখানে সাহা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নিয়মানুসারে উপযুক্তই নন, ১৯০৫ সালের পুলিশ ডায়েরিতে তাঁর নাম এখনও জ্বলজ্বল করছে। প্রথমে গণিত বিভাগে যুক্ত হলেও পরে সাহা চলে যাচ্ছেন সায়েন্স কলেজের ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগে। রামন তখন নিজের গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত, আশুতোষের সম্পূর্ণ সমর্থন তাঁর দিকে। ওদিকে সাহাকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সিলেবাস ও প্রশ্নপত্র তৈরি নিয়ে, ছাত্র পড়ানো নিয়ে। পদার্থবিজ্ঞানের উঁচু ক্লাসের বিষয়গুলিকে আত্মীকৃত করতে করতে সাহা সময় পাচ্ছেন না নিজস্ব গবেষণার। তবু তার মধ্যেই খুঁজে নিচ্ছেন নিজের ভবিষ্যৎ গবেষণাপথটিকে। বিশুদ্ধ গণিত ছেড়ে এসে তিনি প্রথমে ঝুঁকছেন তাত্ত্বিক ও পরে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানের দিকে। আর সেখানেই ফলিত পদার্থবিজ্ঞানী রামনের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষের পরিসরটি প্রশস্ত হচ্ছে।

 ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে কাজ করায় মুশকিল আছে তখন সায়েন্স কলেজে। প্রথমত যন্ত্রপাতি কেনার জন্য পর্যাপ্ত টাকা নেই কলেজের হাতে— ইংরেজের পরোক্ষ নির্দেশ অমান্য করে ভারতীয় অধ্যাপকদের উচ্চপদে নিয়োগ করার জন্য সাহেবরা প্রতিশোধ নিচ্ছে আশুতোষ তথা ভারতীয় বিজ্ঞান-উদ্যমের উপরে। যেটুকু টাকার সংস্থান হয়, যন্ত্রপাতি কেনা হয়, রামন তার সিংহভাগটাই কুক্ষিগত করেন নিজের ব্যবহারের জন্য। সাহা বা অন্যান্য অল্পবয়েসি অধ্যাপকরা বিক্ষুব্ধ হলে তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় রামনের পদাধিকার ও সিনিয়রিটি। এক্ষেত্রেও আশুতোষ রামনের পক্ষেই। আবার ওদিকে সাহা নিজেও কর্তৃপক্ষের বিশেষ নেকনজরে নেই তাঁর বিভিন্ন ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ কীর্তিকলাপের জন্য।

১৯১৭ সালে সায়েন্স কলেজে যোগদান করার ঠিক পরপরই লর্ড চেমসফোর্ড গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সমীক্ষায় লিখিতভাবে সাহা জানাচ্ছেন— ‘যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে আবাসিক করে তোলার কথা ভাবা হয় এবং যথাযথ হস্টেলের ব্যবস্থা করা হয় তা হলে ‘ডেমোক্র্যাটিক ক্লাস’ বা গণতান্ত্রিক শ্রেণির (আমি তাদেরই গণতান্ত্রিক শ্রেণি বলে অভিহিত করছি, যাদের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বলা হয়) কথা ভাবতেই হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে লাগোয়া হস্টেল রয়েছে, তাতে তথাকথিত উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের মৌরসিপাট্টা চলছে। সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছে কায়স্থ ও বৈদ্য ছাত্রেরা। কোনও গণতান্ত্রিক শ্রেণির ছাত্রকেই ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ ছাত্র এক ঘরে মেনে নেয় না বা একসঙ্গে খেতে বসলেও আপত্তি জানানো হয়।’  কড়া প্রশাসক আশুতোষের যে এসব কার্যকলাপ খুব পছন্দ তা মোটেই নয়। ব্রিটিশের দাক্ষিণ্যে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর হ্যাপা কম নয়, তার উপর এসমস্ত লিখিত ‘প্রতিবাদ’, যা ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চোখে পড়বেই, অবাঞ্ছিত সমস্যা ডেকে আনতে পারে— তাও তাঁর জানা আছে। ‘সুসভ্য’ ব্রিটিশজাত তাদের ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা নিয়ে গর্ব করে বেড়ালেও ‘অসভ্য’ কালা-আদমিদের থেকে তা নিয়ে লেকচার শোনা ‘প্রভু’দের নিতান্ত নাপসন্দ। 

এই গোটা সময়টা ওদিকে আশুতোষের প্রিয় রামন তন্নিষ্ঠ গবেষণায় নিমগ্ন। চারপাশের রাজনীতি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বিক্ষুব্ধ সমাজ তাঁর বিজ্ঞানচর্চার দেওয়াল টপকে উঁকি দিতে পারে না। যদিও পরে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রামন অনুৎসাহী নন তো বটেই, বেশ দক্ষ খেলোয়াড়। রামন আপাতত নিশ্চিন্ত মনোযোগে তরঙ্গবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করছেন, প্রকাশিত হচ্ছে একের পর এক মৌলিক গবেষণাপত্র। এই সময় শব্দতরঙ্গের উপর করা তাঁর বিভিন্ন কাজ দুনিয়ার সেরা বিজ্ঞানীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু সাহার গবেষণার অবস্থা যে খুব একটা সুবিধার— তা নয় মোটেই। যেমন আগে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকাকড়ির অবস্থা সুবিধার নয়— একটি সামান্য অয়েল পাম্প কিনতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন সাহা। কিন্তু নিয়তি সাহার জন্য এই সময়টিই (১৯১৯-১৯২১) নির্দিষ্ট করে রেখেছিল তাঁর প্রতিভার সর্বোচ্চ স্ফুরণের জন্য। বিশুদ্ধ গণিতের ছাত্র সাহা এই সময় তাঁর প্রতিভা আর ধী-এর সর্বোত্তম প্রয়োগে ভৌত রসায়ন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব আর পরমাণুবাদের অভূতপূর্ব সমাহারে বিশ্লেষণ করছেন নক্ষত্রমণ্ডলীর প্রকৃতি। নিলস বোর, জেমস ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বকে ব্যবহার করে সাহা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যায় এনে দিচ্ছেন নতুন দিগন্তের খোঁজ— American Astrophysical Journal-এ ১৯১৯ সালে আত্মপ্রকাশ করছে বিখ্যাত ‘সাহা সমীকরণ’। এই সময়ে প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলি মেঘনাদের সামনে এনে দিল ইউরোপে গবেষণা করার সুযোগ। বিখ্যাত Thermal Ionization বা তাপীয় আয়নন তত্ত্বের উপর প্রকাশিত প্রবন্ধটি সাহাকে এনে দিল বিখ্যাত গ্রিফিথ পুরস্কার এবং তিন বছর ইউরোপে গবেষণা করার সুযোগ। কিন্তু প্রথম যুদ্ধের জন্য ইতিমধ্যেই এক বছর নষ্ট। কালবিলম্ব না করে সাহা রওনা দিলেন লন্ডন, জাহাজে তাঁর সহযাত্রী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

ইউরোপের অভিজ্ঞতা সাহার পক্ষে বিশেষ সুখকর হয়নি। দু’-তিনটি দেশে তিন-চারজন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীর গবেষণাগার ঘুরে সাহা বুঝলেন তাঁর তাত্ত্বিক কাজ নিয়ে সকলে বেশ উৎসাহী হলেও সেসবের প্রত্যক্ষ ফলিত প্রমাণভিত্তিক গবেষণা করা খুব একটা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত মহাযুদ্ধের পর ইউরোপের বিজ্ঞানজগৎ বেশ খানিকটা ঘেঁটে রয়েছে, বহিরাগত পরাধীন দেশের এক নাগরিককে সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় কাজ করতে দেওয়া নানা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তার উপরে ছিল প্রতিষ্ঠিত প্রৌঢ় বিজ্ঞানীদের একপ্রকার অনীহা, প্রায় উপেক্ষাই— সাহা তখন বিজ্ঞানজগতের নিতান্তই অনামী ছোকরা নভিস। আমরা দেখতে পাই, ইউরোপ প্রবাসের একেবারে শেষ দিকে আচার্য রায়কে নিরুৎসাহ সাহা ব্যক্তিগত পত্রালাপে লিখছেন— ‘ইওরোপের বিভিন্ন স্থান ঘুরে, নানান ব্যক্তির সান্নিধ্যে এসে দেখছি, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এক মনে এক ধ্যানে বিজ্ঞান ও দেশের সেবা করতে পারে এরূপ লোকের সংখ্যা ইওরোপেও কম।’

সাহার হৃদয়ে তখনও স্বদেশ, সর্বদাই। এইখানেই বিজ্ঞানী রামনের সঙ্গে বিজ্ঞানী সাহার মূল প্রভেদ।

১৯২১-এ সাহা ফিরলেন দেশে, হৃতোৎসাহ। লাভ বলতে এইটুকু, সাহা জেনে এসেছেন— রাল্‌ফ ফাউলার, এডওয়ার্ড মিলনে প্রভৃতি বিজ্ঞানীরা ইউরোপের বিজ্ঞানজগৎ কাঁপানো গবেষণাগুলি গড়ে তুলছেন তাঁরই কাজের উপর ভিত্তি করে। ওই পরোক্ষ স্বীকৃতিটুকুই তাঁর প্রাপ্তি। ফেরার আগেই সাহা জেনে গেছেন সেখানেও খুব একটা ভালো খবর অপেক্ষা করে নেই। ইউরোপে থাকতেই আশুতোষ সাহাকে খয়রা নেটিভ এস্টেট প্রতিষ্ঠিত ‘খয়রা প্রফেসর’ পদে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ফেরার জন্য তাড়াও দিচ্ছেন পরোক্ষে। মেঘনাদের এখন বিদেশে গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিচিতিও বেড়েছে বেশ অনেকখানি। তিনি মাসে পাঁচশো-র বদলে বেতন চাইলেন আটশো টাকা সঙ্গে নিজস্ব গবেষণাগার গড়ে তোলার জন্য পাঁচশো পাউন্ড। আশুতোষ অত টাকা দিতে পারবেন না। কোনও বিকল্পের সন্ধান না পেয়ে সাহা রাজি হলেন।

ফিরে এসে সাহা দেখলেন রামনের পদোন্নতি ঘটেছে। তিনি এখন বিভাগীয় প্রধান। পদার্থবিদ্যা বিভাগে তিনিই মোটামুটি শেষ কথা, আর আশুতোষও এখনও রামনপন্থীই মূলত। সমিধ প্রস্তুত ছিল, অগ্নিসংযোগে বিলম্ব হয়নি। সাহার নতুন গবেষণার এক্স-রে সংক্রান্ত পরীক্ষা চলার কথা সারা রাত ধরে। সেই মতো পরীক্ষা চালু করে তিনি বাড়ি ফিরলেন। পরদিন সকালে এসে দেখলেন রামন সে-ঘর দিব্যি তালাবন্ধ করে চাবিটি নিজে নিয়ে রেখেছেন, ওদিকে সাহার পরীক্ষার এত জোগাড়যন্ত্র, সম্পূর্ণ পরিশ্রম— বিশ বাঁও জলে। দুই বিশ্রুত বিজ্ঞানী মনোমালিন্যে জড়িয়ে পড়লেন, স্যার আশুতোষ মুখার্জির সামনেই। আশুতোষ রামনকে দিয়ে ঘর খোলালেন, দেখেশুনে চাবি রাখতে দিলেন সাহাকেই। সঙ্গে সতর্কবাণী— কাজ করতে হলে রামনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে সাহাকে। আশুতোষ তখনও সাহার প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট নন। গবেষণাগারের জন্য পাঁচশো পাউন্ড চাওয়ার সময় থেকেই। তার উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, ছাত্রদের দলে আছড়ে পড়া অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ— যা আশুতোষকে প্রশাসক হিসেবে বেশ বিব্রত করছে, সাহা ভিতরে ভিতরে সেই আন্দোলনের সমর্থক। সে-কথা জানেন বাংলার বাঘ। রামনের এসব ঝঞ্ঝাট নেই। আশুতোষ তাই প্রকাশ্যেই সর্বদা রামনের দিকে ঝুঁকে থাকেন।

কলকাতা ক্রমে সাহার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে। বন্ধু জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ চলে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতায় কাজ করার সুবিধা নেই, যেটুকু আছে তার জন্যও দরকার রামনের অনুগ্রহ। ওদিকে বিলেতের বিজ্ঞানীরা তাপীয় আয়ননে-র কাজটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন— সাহার তত্ত্বের ফাঁকফোকর ধরা পড়ছে। সাহা একটা নতুন আরম্ভ খুঁজে পেতে চান। তাঁর কাছে আমন্ত্রণ আসে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের। সাহা রাজি হয়ে যান।

 

মহারণ 

 

কলকাতা আর রামনের থেকে বহুদূর চলে এলেও যুদ্ধ জারি ছিল। যত দিন গেছে, সে সংঘর্ষের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে উত্তরোত্তর। এলাহাবাদে এসে সাহা দেখলেন, মৌলিক গবেষণার জন্য সেখানকার অবস্থা কলকাতার থেকেও খারাপ। সত্যি কথা বলতে কী— বিশ্ববিদ্যালয়টি তখন কেবল শ্রেণিশিক্ষার কেন্দ্র; গবেষণা, উচ্চতর পাঠ এসব সেখানে তখনও দূরকল্পনা। বইপত্র কেনার জন্য টাকা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় আপিস থেকে উত্তর আসে— ‘এযাবৎ যা বই কেনা হয়েছে, সব কি পড়া হয়ে গেছে আপনার? যদি না হয়— তা হলে নতুন বই কেনার যৌক্তিকতা কোথায়?’ একবার তো আরও মজা হল। সাহা নিজস্ব গবেষণাগারে একটি বিশেষ রকম পরীক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজনীয় বারোটি পোস্ট অফিস বক্স (Post Office Box— একপ্রকার রোধমাপক যন্ত্র) কেনার টাকা চেয়ে পাঠালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে। উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয় চিঠি পাঠাল একটিমাত্র গবেষণাগৃহের জন্য এতগুলি পোস্ট বক্স (Post Box— ডাক বাক্স) কেন দরকার, তার কারণ আগে দর্শানো হোক। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও লড়াই চালিয়ে যাওয়া সাহার স্বভাবে-রক্তে। তিনি অক্লান্তভাবে জোগাড় করার চেষ্টা করেন গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা। চিঠি লেখেন দেশে-বিদেশে চেনা-আধচেনা লোকেদের কাছে। 

রকফেলার ফাউন্ডেশনের তৎকালীন বিজ্ঞান বিষয়ক কর্ণধার বিশ্রুত পদার্থবিদ রবার্ট মিলিকান তেমনই একজন। কিন্তু মিলিকান সাহাকে চেনেন না ভালো। সাহার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য তিনি ধরলেন সে-সময় মিলিকানের কর্মস্থল ক্যালটেকে স্বল্পকালীন গবেষণার জন্যে আসা এক ভারতীয় বিজ্ঞানীকে।

সে বিজ্ঞানী— রামন।

হ্যাঁ, রামন অবশেষে তাঁর স্বাস্থ্যজনিত বাধা কাটিয়ে কালাপানি পার হতে পেরেছেন। তার সঙ্গে কিছু পেশাদারি বাধ্যবাধকতাও ছিল। বিদেশে গবেষণার অভিজ্ঞতা নেই এমন কাউকে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে মেনে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনেকেই তখনও নাচার। অগতির গতি সেই আশুতোষ। তাঁর উৎসাহেই তিন বছর আগে রামন ঘুরে এসেছেন ইউরোপ। ১৯২১-এ। কিংবদন্তি বলে, ভূমধ্যসাগরের জলের আশ্চর্যনীলের দিকে তাকিয়েই তাঁর মনে বিখ্যাত রামন এফেক্টে-এর ধারণাবীজটি অঙ্কুরিত হতে শুরু করে। আজ এই তিন বছর পরে তিনি আবার পশ্চিমে। মিলিকানের প্রশ্নের উত্তর তিনি জানান— তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হিসেবে সাহার যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু নিরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যায় সাহার দক্ষতা তেমনটি নয় মোটেও। তাই যদি হত, তবে সাহা দেশেই প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করে উঠতে পারতেন সহজেই, বিদেশি সংস্থার কাছে হাত পাতার প্রয়োজন ছিল না। সাহা রকফেলার ফাউন্ডেশন থেকে কোনও অর্থসাহায্য পেলেন না সে-যাত্রা। 

রামন ওদিকে তাঁর এফেক্ট নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। পরবর্তী চার-পাঁচ বছরে তাঁর সে-কাজ সমাপ্তির পথে। ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে সাম্মানিক ডি এস সি নিতে কলকাতায় এলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সমারফেল্ড। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির সাহা-রামন দু’জনেই। দু’জনেই উষ্ণ হাসি হেসে স্বাগত জানাচ্ছেন সমারফেল্ডকে। নিয়তির পরিহাস। কিছু বাদেই সে-হাসিটুকু অন্তর্হিত হল দু’জনের মুখমণ্ডল থেকেই। আই সি এস-এর বিশাল হলঘরে সমারফেল্ডের সামনে রামন ব্যাখ্যা করলেন নিজের কাজ। বিপুল সাড়া ও হাততালির মধ্যে সুর কাটল সাহার একটি মন্তব্যে। সাহার বক্তব্য এই কাজের গোড়াপত্তন ১৯২৩-এই শুরু হয়ে গেছে, আর এখন রামন সেটিকে সর্বতভাবে প্রতিষ্ঠা করে প্রমাণ করছেন রামনের মনে হল সাহা তাঁর কাজকে খাটো করে দেখাতে চান সমারফেল্ডের তথা পশ্চিমা বিজ্ঞানজগতের সামনে। এখানে একটা কথা বলে নিতে হবে, রামন এফেক্ট নিয়ে রামন ও সহযোগী কে এস কৃষ্ণণের একটি গবেষণাপত্র সে-বছরই অর্থাৎ ১৯২৮ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়। সাহা সেই প্রবন্ধপ্রদত্ত ব্যাখ্যা মেনে নিতে অস্বীকৃত হন এবং তার বিরোধিতা করে একটি প্রত্যুত্তরনির্ভর প্রবন্ধ প্রকাশ করেন নেচার পত্রিকায়। রামন সে-কথা ভোলেননি।

 কলকাতায় ১৯২৮-এর অক্টোবর মাসের সেই আলোচনা সভায় ঠিক কী হয়েছিল, সে বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন এটি নিতান্তই নিরামিষ একটি বৌদ্ধিক তর্ক। কারও মতে সমারফেল্ডের সামনে সেই তর্ক শেষপর্যন্ত পর্যবসিত হয়েছিল উচ্চকিত কথাকাটাকাটিতে। কেউ বা এমন ইঙ্গিতও দিয়ে রাখছেন যে রামন তখন গবেষণাজীবনের মধ্যগগনে দীপ্যমান সূর্য আর সাহা নিতান্তই অস্তাচলগামী দিনমণি। রামনের কাজ নিয়ে সারা পৃথিবীতে কথা হচ্ছে, সাড়া পড়ে গেছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। ওদিকে সাহা এলাহাবাদে নিযুক্ত হওয়ার পর পথপ্রদর্শক নতুন কাজ তেমন করতে পারেননি, তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাপীয় আয়নন-এর মূল রূপটিও ক্রমে গুরুত্ব হারাচ্ছে। সুতরাং সাহার এমত প্রতিক্রিয়া বহুলাংশে হতাশাপ্রসূত। সমারফেল্ডের উপস্থিতিতে সে-দিন যা-ই ঘটে থাকুক-না কেন, সে ঘটনার কার্যকারণ যা-ই হোক-না কেন— এটুকু নির্দ্বিধায় বলাই যায়, সে-দিন ভারতের বিজ্ঞানজগতে যে বিভাজনের সূত্রপাত হয়েছিল, আজও তার চিহ্ন প্রকট, প্রবলভাবেই।

 

বিভাজন 

 

দু’বছর যেতে না যেতেই সাহা আর রামন দু’জনেই আবিষ্কার করলেন, তাঁরা ফের একবার অজান্তেই একে অন্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন উপলক্ষ্য ১৯৩০-এর নোবেল পুরস্কার। প্রাথমিক ঝাড়াইবাছাইয়ের পর শেষপর্যায়ে তিনজনের নাম বেছে নিলেন বিচারকরা। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, মেঘনাদ সাহা এবং রবার্ট উইলিয়ামস উড। উডের কাজ নিয়ে বিচারকদের নতুনকরে ভাবার বিশেষ কিছু ছিল না। উড পূর্বেও বহুবার এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত এবং প্রত্যাখ্যাতও। সে-বছরেও তাঁর কাজ মুখ্যত পূর্বলব্ধ ফলাফলের সংযোজন-বিয়োজন। সুতরাং বিচারকদের টেবিলে বেছে নেওয়ার জন্য শেষমেশ পাশাপাশি পড়ে রইল দু’খানি ফাইল। একখানির উপর সাহা ও অপরটির উপর রামন লেখা।

এই ২০২১ সালেও ইন্টারনেটে খুঁজলে পাওয়া যায়— ১৯৩০ সালের ১০ ডিসেম্বর তাঁর স্বাগতিক ভাষণে নোবেল কমিটির (পদার্থবিদ্যা) চেয়ারম্যান অধ্যাপক প্লিয়েল (Pleyel) বলছেন, ‘ইয়োর ম্যাজেস্টি, ইয়োর রয়্যাল হাইনেসেস, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, অ্যাকাদেমি অফ সায়েন্স এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, আলোকবিচ্ছুরণ এবং রামন এফেক্ট সংক্রান্ত গবেষণাকর্মের জন্য ১৯৩০ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন।’

সাহা পরাজিত। এবার প্রকাশ্য বিশ্বের দরবারে।

নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে সাহার এই পরাজয়, অন্তত ১৯৩০ সালে অবশ্যম্ভাবী ছিল। রামন এফেক্ট-এর সমতুল আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানের বিশেষত প্রায়োগিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে কমই হয়েছে। তবে ইতিহাস এও বলছে যে, সাহা এরপর আরও তিন-তিনবার মনোনীত হয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারের প্রাথমিক তালিকায়। ১৯৩৬, ১৯৩৯, ১৯৪০— প্রতিবারই সাহাকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। নোবেল কমিটির কাছ থেকে ১৯৩৬-এ ভারতের একমাত্র নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হিসেবে রামনকে অনুরোধ করা হয়— প্রাথমিক তালিকার জন্য কয়েকজন উপযুক্ত বিজ্ঞানীর নাম মনোনীত করতে। রামন জানেন এইবার সাহা বেশ উঠে পড়ে লেগেছেন নোবেল কমিটির গোচরে নিজের নামটি আরও প্রকটভাবে তুলে ধরতে। রামন কয়েকটি বিদেশি নামের তালিকা করে কমিটিকে পাঠালেন।

স্বাভাবিকভাবেই সে তালিকায় সাহার নাম অনুপস্থিত। রামন কিছুই ভোলেননি।

এমন করেই চলছিল। এবার আর কোনও আড়াল নেই। দু’জনেই প্রস্তুত, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বদ্ধপরিকর। এবং দু’জনকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে গড়ে উঠছে তৎকালীন ভারতীয় বিজ্ঞানীদের দু’টি বিবাদমান গোষ্ঠী। রাজা যা বলে থাকেন পারিষদগণ তার হাজারগুণ কপচান— এ পৃথিবীর দস্তুরই তাই। সুতরাং এই দুই গোষ্ঠীর সক্রিয় প্রচেষ্টায় সাহা ও রামনের মধ্যে ব্যক্তিগত সদ্ভাব মেরামতির যেটুকুও সম্ভাবনা ছিল, তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে শুরু করল। লক্ষণীয়, সাহা বা রামন কিন্তু এখনও বিজ্ঞানী হিসেবে একে অন্যের উপর শ্রদ্ধাশীল— অপরজনের কাজের মূল্যায়নে দু’জনেই বারংবার উল্লেখ করেছেন সে-কথা। এতৎসত্ত্বেও, দু’জনেই অপরের মানসিকতা, উদ্দেশ্য ও অ্যাজেন্ডা নিয়ে অতিমাত্রায় সন্দিহান। পারস্পরিক বিশ্বাসের লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই সেখানে। ১৯৩২-এ রামন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর (Indian Institute of Science-এর পর থেকে আই আই এস সি (IISc) বলে উল্লিখিত) প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করার তোড়জোড় করছেন— কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে মেঘনাদ মন্তব্য করেন রামনের উচিত দেশীয় অধ্যক্ষ হিসেবে বেতন কিছু কম গ্রহণ করা। তখন অধ্যক্ষের বেতন তিনহাজার (ভারতীয় অধ্যক্ষ তখনও দেখেনি আই আই এস সি) আর একজন দেশীয় অধ্যাপকের বেতন বারোশো টাকা। রামন এর মধ্যে খুঁজে পেলেন ‘বাঙালি ষড়যন্ত্র’ রামনপন্থীরা মেঘনাদকে মনে করালেন আচার্য জগদীশ বসু একদা ইংরেজদের থেকে কম বেতন নিতে অস্বীকার করেছিলেন।

ওদিকে ১৯৩২-৩৩-এ রামন আই আই এস সি-তে যাওয়ার আগেও নানারকম প্যাঁচপয়জার খেলছেন। চলে যাওয়ার আগে বিশেষ একটি পদ সৃষ্টি করে তিনি সেই পদে বসিয়ে যেতে চান নিজের সহযোগী কে এস কৃষ্ণণকে। ওদিকে সাহা তখন কলকাতায় আসবেন ভাবছেন, আশুতোষপুত্র শ্যামাপ্রসাদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি সাহাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পুনর্বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে। সাহা রাজি, কিন্তু আই এ সি এস-এর যন্ত্রপাতির ব্যবহারের নিশ্চয়তা চান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় কেনা ওইসব যন্ত্রপাতি দিয়ে রামন এতদিন আই এ সি এস-এর গবেষণাগার ভরিয়েছেন। রামনের নিজের ছেড়ে যাওয়া শূন্যস্থানে আই এ সি এস-এ কৃষ্ণণকে বসানোর পরিকল্পনা শুনে স্বভাবতই সাহা অগ্নিশর্মা। আচার্য প্ৰফুল্লচন্দ্র রায়কে তিনি লিখেই ফেললেন, ‘অধ্যাপক রামন Association-এর একটা chair create করিয়া তাহাতে একজন মাদ্রাজী অধ্যাপক নিযুক্ত করিতে চান, যাহাতে এখানে কোনওকালে বাঙালীরা আর মাথা তুলিতে না পারে। এই ব্যাপারটা যদি বাঙ্গালাদেশের নেতারা নিবারণ করিতে না পারেন, তাহা হইলে তাহাদিগের জন্য দড়ী ও কলসীর ব্যবস্থা করাই সমীচীন। এর চেয়ে বেশি strongly আর কী লিখিব?’

নানা ঝামেলার পর একরকম লাঞ্ছিত হয়েই রামন কলকাতা ত্যাগ করলেন। সে-কাহিনির বিস্তারে যাওয়ার প্রয়োজন এ নিবন্ধে নেই। ১৯৩৩-এ ব্যাঙ্গালোরে আই আই এস সি-র দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর ভারতীয় বিজ্ঞানজগতে বিন্ধ্য বরাবর উত্তর-দক্ষিণ বিভাজনটি আরও প্রকট ও কুৎসিত রূপ ধারণ করল। এর আগেই ১৯৩১ নাগাদ সাহার নেতৃত্বে এলাহাবাদে ইউ পি অ্যাকাদেমি বা এলাহাবাদ অ্যাকাদেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সমগ্র ভারতীয় বিজ্ঞানজগতের মাথাদের একটি সংগঠনের ভিতর একত্রিত করার জন্য দরকার ছিল, বৃহত্তর একটি বিজ্ঞানগোষ্ঠী। আশ্চর্যের কথা, সাহা ও রামন উভয়েই তখন একটি জাতীয় বিজ্ঞানী সংগঠনের কথা ভাবছেন। ১৯৩৪-এর বিজ্ঞান কংগ্রেসে সাহার নেতৃত্বে এলাহাবাদ অ্যাকাদেমি সে-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করছে, যাতে রামনও আছেন। এই কমিটির কাজ একটি জাতীয় অ্যাকাদেমি গঠনের তদারকি।

১৯৩৪-এর এপ্রিলে রামন অকস্মাৎ এই কমিটির কাজে প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করে ইস্তফা দিলেন। সমিতি তাঁকে পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে চিঠি দিলে রামনের তরফে কোনও সাড়া না এলেও, কিছুদিন পর সংবাদপত্র বাহিত হয়ে একটি খবর আসে— রামন নিজেই একটি অ্যাকাদেমি স্থাপন করেছেন। তার পোশাকি নাম ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাদেমি অফ সায়েন্স’ হলেও লোকে তাকে চিনছে ব্যাঙ্গালোর অ্যাকাদেমি বলে। অর্ধবর্ষকালব্যাপী টানাপোড়েনের পর দুই অ্যাকাদেমির পারস্পরিক সমঝোতায় একটা সমাধান সূত্র বেরোল— নতুন একখানি জাতীয় অ্যাকাদেমি স্থাপিত হবে, প্রস্তাবিত নাম— ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সেস। এলাহাবাদ ও ব্যাঙ্গালোর অ্যাকাদেমিরাও অবশ্য পাশাপাশি রইল বহাল তবিয়তে। সাহা ব্যাঙ্গালোর অ্যাকাদেমিতে যোগ দিতে অস্বীকৃত হলেন, রামনও নিজের পদত্যাগপত্র বহাল রাখলেন। সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে কেউই রাজি নন।

দুঃখের বিষয়, এই সর্বনাশা বিভাজন যে ভারতীয় বিজ্ঞানের ঐকতানটিকে স্তব্ধ করে দিল শুধু তাই নয়, পশ্চিমের চোখে ভারতীয় বিজ্ঞানউদ্যম সম্পর্কে একটা সংশয়ও তৈরি করল। স্বনামধন্য ম্যাক্স বর্ন পর্যন্ত এই সময় আক্ষেপ করে লিখছেন, ‘ভারতবর্ষে এখন দু’টি বিজ্ঞান অ্যাকাদেমি। এত বৃহৎ একটি রাষ্ট্রের পক্ষে সংখ্যাটা হয়তো খুব বেশি নয় কিন্তু সমস্যা হল এরা একে অন্যের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। উত্তর ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সাহার এবং দক্ষিণিরা রামনের নেতৃত্বে এখানে বিবদমান।’

 

হেরাক্লেস ও প্রমিথিয়াস: সাহা-রামন ‘শ্রেণি’সংগ্রাম

 

বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান ঐতিহাসিক ডেভিড ডি ভোরকিন সাহা-রামন দ্বন্দ্বের নির্যাসটুকু চমৎকার বর্ণনা করেছেন— ‘সাহা আর রামন কখনওই সুসম্পর্ক বজায় রেখে উঠতে যে পারেননি, তার পিছনে দায়ী দু’জনের বিপ্রতীপস্থানিক অতীত ও রাজনৈতিক বোধ-বিশ্বাস। রামনের মতো সাহা কখনওই ব্রিটিশরাজের সঙ্গে নিরঙ্কুশ সদ্ভাব রেখে চলতে পারেননি। পারেননি অভিজাত শ্রেণির মনোভাবকে রামনের মতো আপন করে নিতেও। ফলত ঔপনিবেশিক ভারতের শাসকশ্রেণি তথা নীতিনির্ধারকদের কাছে সাহার উপস্থিতি বরাবরই একটি অস্বস্তিকর ঘটনা হয়েই থেকেছে।’

ভিন্নভাবে দেখতে গেলে রামন আর সাহা যেন গ্রীক পুরাণের দুই চরিত্র, হেরাক্লেস ও প্রমিথিয়াস, যথাক্রমে।

মধ্যস্বত্বভোগীর সন্তান রামন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী, আর সে-মেধার ব্যবহারের পন্থাটি তীব্র একমুখীন। অভীষ্টসাধন। সমকালীন সমাজ-পরিবেশ-রাষ্ট্র কিছুই রামনকে আলোড়িত করে না, মন্ত্রের সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ তিনি নিতে রাজি। তাই ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্যের প্রশ্নই ওঠে না, কড়া প্রশাসক আশুতোষের তিনি নয়নমণি। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ‘লবিইং’ করতে তাঁর দ্বিধা নেই, সাম-দান-দণ্ড-ভেদে গবেষণার জন্য অর্থ জোগাড়েও তিনি কুণ্ঠিত নন। রামনের ধর্ম পদার্থবিজ্ঞান। রামনের লক্ষ্য অমর হয়ে প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানীদের অলিম্পাসে স্থান অর্জন করে নেওয়া হেরাক্লেসের মতো। সে-অভীষ্ট রামনের সিদ্ধ হয়েছিল।

কালের অলঙ্ঘ্য নিয়মে রামন ও সাহা দু’জনেই যখন পরবর্তী প্রজন্মকে জায়গা ছেড়ে সক্রিয় গবেষণা থেকে সরে গেলেন, তাঁদের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের পরিসরটুকু স্বাভাবিক নিয়মেই বিলুপ্ত হল। রামন ততদিনে ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর গরিমায় প্রতিষ্ঠিত। সেই গরিমাকেই সম্বল করে তিনি জীবনের শেষপর্যায়ে শিক্ষকতা ও মেন্টরিং নিয়ে কাটিয়ে গেছেন শান্ত জীবন।

ওদিকে সাহার প্রকৃতি ভিন্ন। তাঁর প্রকৃত সংঘর্ষ ব্যক্তি রামনের থেকেও বেশি ছিল রামনের শ্রেণির সঙ্গে। প্রান্তিক অবহেলিত মানুষের প্রতিনিধি সাহা বৈজ্ঞানিক অর্জন, সামাজিক প্রতিষ্ঠায় রামনের থেকে অনেক পিছিয়ে। সুতরাং লড়াই। এই লড়াই ছিল সাহার অন্তর্নিহিত প্রকৃতির মূল উপাদান। এই লড়াই তিনি করেছেন শাসকের অনাচারের বিরুদ্ধে, প্রশাসনিক অচলায়তনের বিরুদ্ধে, রামনের প্রভাব-প্রতিপত্তির অন্যায় প্রয়োগের বিরুদ্ধে, পরবর্তীতে রামনের শ্রেণির উত্তরসূরী ভাটনগর-সারাভাইয়ের এমনকি নেহেরুর অবহেলার বিরুদ্ধে। এই লড়াইতে তাঁর নিজের কোনও স্বার্থসিদ্ধির সন্ধান নেই, শুধু রয়েছে বিজ্ঞানের সঠিক প্রয়োগ ও শিক্ষার সার্বিক প্রসারে অভিজাত শ্রেণির মুষ্টিমুক্ত করে ‘গণতান্ত্রিক’ শ্রেণির কাছে মুক্তচিন্তা, উন্নত সমাজের চাবিকাঠিটি পৌঁছে দেওয়া। প্রমিথিয়াসের মতো। উচ্চাসীন সমাজের প্রতিপত্তি তাই সাহাকে বারংবার বক্রচঞ্চু ইগলের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে। তবে এ গল্পে হেরাক্লেস শেষ পর্যন্ত প্রমিথিয়াসকে মুক্ত করেননি, বরং উদাসীন থেকেছেন দেবতাদের ভিড়ে।

অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে আবার সাহা-রামন ‘শ্রেণি’সংগ্রামটি মানবসমাজের চিরন্তন সত্য। এ ভূখণ্ডেও সেই দ্বন্দ্বটি ইতিহাসের মতোই প্রাচীন, সময়ের মতোই চিরপ্রবহমান। সে-দ্বন্দ্ব ‘ভারতবর্ষ’ ও ‘ইন্ডিয়া’র।

 

 তথ্যসূত্র :

১) অবিনাশ মেঘনাদ সাহা : বিজ্ঞান সমাজ রাষ্ট্র— অত্রি মুখোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ 

২) মেঘনাদ সাহা— গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, খোয়াবনামা 

৩) মেঘনাথ থেকে মেঘনাদ— অর্ঘ্য মান্না, আনন্দবাজার পত্রিকা 

৪) মেঘনাদ সাহা, একজন বিজ্ঞানী ও বিপ্লবী— Vikaspedia 

৫) History of the Calcutta School of Physical Sciences— Purabi Mukherji, Atri Mukhopadhyay, Springer

৬) Sir C. V. Raman and the story of the Nobel Prize— Rajinder Singh, Falk Riess, Current Science 

৭) Journey into Light: Life and Science of C V Raman— G. Venkataraman, Indian Academy of Sciences

৮) Quantum Physics and the Stars (IV): Meghnad Saha’s Fate— David H. DeVorkin

৯) Wikipedia

১০) The Quantum Indians: film on Meghnad Saha, Bose and Raman-Docufilm by Raja Choudhury, Youtube



______________________________________________________________________________

আকর্ষণীয় ছাড়সহ অভীক মোহন দত্ত-রচিত বই কবীশ্বরী || নক্ষত্রপ্রভাএবং দুই মলাটের দুনিয়া দুই মলাটের দুনিয়া সংগ্রহ করুন এই লিংক থেকে:




মন্তব্যসমূহ