প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর

 


রানি দুর্গাবতী


প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান

 

তমোঘ্ন নস্কর

 

 

পর্ব ৪: মা দুর্গা

 

“ওঁক...” চিৎকারটা শুনেই হাতিটাকে আড়াল করে পিছনে ঘুরল মাহুত। একখানা তির এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে সওয়ারির কান! মাথা চাপড়ে হায় হায় করে উঠল সে, “মা, তুমি, তুমি হাতি থেকে নেমে যাও। অন্য কাউকে তোমার জায়গা দাও। ওরা শ্রমণকে চিহ্নিত করেছে! সব তির আমাদের লক্ষ করেই ছোড়া হচ্ছে।”

আঘাত প্রাথমিক সামলে ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট স্বরে বললেন সওয়ারি, “যুদ্ধ করতে এসে ফেরার পথ থাকে কি? তিরন্দাজদের লক্ষ করো। আরও একটু সামনে নিয়ে চলো শ্রমণকে। ওদেরকে পেড়ে ফেলা অবধি আমার পতন নেই...”

মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল আর একখানি তির এসে আমূল বিদ্ধ হল সওয়ারির কণ্ঠে! জ্ঞান হারাতে হারাতে দেখলেন তাঁর ছত্রভঙ্গ সেনাদল, পাশের হাতিতে প্রাণপণে লড়ে যাওয়া পুত্র নারায়ণ... নারায়ণ চিৎকার করছে, “মা আ আ...” আর শুনতে পেলেন না। চোখ বুজে এল তাঁর।

 

***

আগের বছর (১৫৬১-এর বর্ষা), চৌরগড়

 

প্রাসাদশেষে চিন্তিতমুখে দাঁড়িয়ে আছেন রানি দুর্গা। নজর দূরে জঙ্গলের দিকে। বর্ষার মেঘগর্জনের মতোই দূর থেকে এই ঘন ঘন বজ্রনির্ঘোষ ভেসে আসছে সেদিক থেকে।

অবাক হয়ে ভাবছিলেন, মুঘলরা কী এমন অস্ত্র এনেছে, যে-অস্ত্র আকাশের বজ্রের মতো ভীষণ শক্তিশালী! মালোয়ার বাজ বাহাদুর তেমন শক্তিশালী নন। ভীষণ ভোগ-ব্যসনপ্রিয় রাজা কিন্তু তা হলেও এরকম মুহূর্তের মধ্যে ধুলো উড়ে যাওয়া, তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। চর মারফত খোঁজখবর পেয়েছেন, মুঘলরা অগ্নিস্রাবী এক অস্ত্র এনেছে, তারই ওই ভীষণ আওয়াজ!

 

বাজ বাহাদুর তাঁর অন্যতম শত্রু ছিল। প্রতিবেশী রাজাটি ভেবেছিল, গোণ্ড রাজা মারা যাওয়ার পর অসহায় রানি যুবরাজকে আড়াল করে সিংহাসন সামলাচ্ছেন। এঁকে খুব সহজেই পরাস্ত করা যায়।

ফি-বছর ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল তাঁকে। প্রতিবারই সমুচিত জবাব দিয়েছেন। তাই আজ তাঁর খুশি হওয়ার কথা, বাজ বাহাদুরের সম্পূর্ণরূপে পতন হয়েছে। কিন্তু কেন জানি, তিনি অতটা খুশি হতে পারছেন না।

শুধুমাত্র দেশ দখল বা নিজেদের পরিধি বানানো পরদেশি মুঘলদের লক্ষ্য নয়। মাণ্ডু দখল করে রানি রূপমতীর দিকেও নাকি ওরা হাত দিতে গিয়েছিল। রানি রূপমতী জওহর করে নিজের সম্মান রক্ষা করেছেন। কিন্তু অগণিত অসহায় নারী পশুগুলোর খপ্পরে...

চাপা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল রানির বুক ঠেলে, “হে নৃসিংহদেব, রক্ষা করো। ”

 

***

১৫৬৪, প্রাক বর্ষাকাল, চৌরগড়

 

রানি বহুদিন পরে নৃসিংহদেবের দিঘিতে এসে বসেছেন। চৌরগড়ের কেল্লা-নগরীর ঊর্ধ্ব অঞ্চলে বিরাট আঙিনার এক প্রান্তে এই দিঘি।

একথা-সেকথা ভাবতে ভাবতে জলে চোখ পড়ল তাঁর। জলে নিজের ছায়ায় চোখ পড়তেই সর্বাঙ্গ রিরি করে উঠল... আসফ খান, ওই মুঘল-বাঁদর তাঁকে কামনা করে! নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে জলেই আগুন জ্বালাতে ইচ্ছা করছিল তাঁর। ছারখার হয়ে যাক এ নারী-লালিত্য...

রেওয়া ধ্বংসের পর আসফ খানের নজর পড়েছে তাঁর রাজত্বের দিকে। তবে মূল লক্ষ্য রানি দুর্গাবতী। আসফ খান তাঁকে আত্মসমর্পণের পত্রও লিখেছে! পত্রের ছত্রে ছত্রে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তার দুর্বলতা ও সুপ্ত কামনার কথা... পুরো পত্র দূতকে দিয়ে পড়াতে পারেননি তিনি, “ছিঃ।”

 

বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল বছর কুড়ি আগের কথা, রাজপুত বংশের সুন্দরী দুর্গাবতী এক কথকের মুখে শুনেছিলেন দলপতি সিংহের কথা। দলপতি নৃসিংহপুত্র, বাহুতে অমিত বিক্রম, ললাটে সূর্য হাসে। এক কোপে ঘোড়ায় বসা আরোহীর মুণ্ডচ্ছেদ করতে পারেন।

তিনি নাকি পাঁকের মতো, রোদ্দুরের তাতে শক্ত আবার জল পড়লে নরম। ঠিক যেমন একই দেহে কানহা আর নৃসিংহ; এও ঠিক তেমন। গোণ্ডদের যুবরাজ ঘুরে বেড়ান ছদ্মবেশে, বৃদ্ধ পথিককে চাপাটি খাওয়ান। বধূদের দলকে কুয়ো থেকে জল তুলে দেন। বুড়ি মায়ের বাড়ি আনাজ পৌঁছে দেন। এই এমন বীরই তিনি চেয়েছিলেন।

চুপিচুপি গিয়েছিলেন গাঁওভরের মেলায়, সেখানে নাকি লুকিয়ে অংশ নিয়েছেন গোণ্ড বীর। দেখলেন তাঁকে, ভারী অসি দিয়ে চোখ বেঁধে রেশমি সুতো কাটলেন চর্ম স্পর্শ না করে।

সেই দিনই মন দিয়ে ফেলেছিলেন দলপতি সিংহকে। কিন্তু মন দিলেই তো হবে না। দলপতি সিংহ বা তাঁর পিতা সংগ্রাম সিংহ যত বড়োই বীর এবং কিংবদন্তি হোন না কেন বংশমর্যাদায় তাঁরা রাজপুত নন। জাতিতে গোণ্ড অর্থাৎ উপজাতি সম্প্রদায়। আর দুর্গাবতী যেজাভুক্তির চান্দেলা বংশীয় চন্দ্রচিহ্ন লাঞ্ছিত রাজপুত!

গোপনে পত্র প্রেরণ করেছিলেন দলপত সিংহ। তখন অবশ্য যুবরাজ নন, তিনি রাজা। রাজাকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে হরণ করার জন্য। অবশ্য, এই হরণ-বিবাহে সে-সময়ে আলাদাই এক বীরত্ব ছিল। পৃথ্বীরাজের গাথা রাজপুত রমণীরা মনে মনে লালন করতেন। শ্বশুর শালিবাহনকে পরাজিত করে তাঁকে এই রাজ্যের ‘রানি মা’ করে তুলে এনেছিলেন তিনি। জয় করেছিলেন মাহোবা রাজ্যের অহংকার দুর্গাকে।

তারপর সব ঠিক হল। কোল আলো করে নারায়ণ এল। সে এক সুখের সংসার। ভেবেছিলেন, কিন্তু ক’দিনের ওই বিষজ্বর...

 

আজ দলপতি নেই কিন্তু তা বলে তাঁর অধিকার, দায়িত্ব কমে যায়নি। তিনি যেমন নারায়ণের মা তেমন গোণ্ডের সকল প্রজা তাঁর সন্তান। দুর্গা এই রাজ্যে নিজের ইচ্ছায় এসেছেন, যাবেনও নিজের ইচ্ছায়। মাথা নিচু করে নয়, উঁচু করে...

 

আচমকাই একটা বল্লম এসে পড়ল জলে। জলছবিটা ভেঙে গেল। সেইসঙ্গে চিন্তাজালও ভঙ্গ হল। তার পিছন পিছন দৌড়ে এল নারায়ণ, “মা, সেই দূরে কেল্লার আভা দানে থেকে ছুড়েছে। এতটা এলো! মুঘলাই বারুদকে পিছু ঠেলে দেব আমরা...”

উঠে দাঁড়ালেন দুর্গাবতী , হাঁক ছাড়লেন, “অধর...”

দেওয়ান অধর সিংহ এসে দাঁড়াতেই বললেন, “এখুনি পত্র লেখো। পাঠিয়ে দাও রাজা ও জমিদারদের। তাদের মা নারায়ণজননী দলপত সিংহ-পত্নী দুর্গাবতী তাদের বাহু ও শ্রম যাচনা করছে।”

“মান ঠাকুর, অর্জুন দাসকে নিয়ে আসুন মন্ত্রণাকক্ষে।”

 

***

নিজের সৈন্যদের কসরত দেখছিলেন রানি। বেশ বুঝতে পারছিলেন, এ এক অসম লড়াই। কিন্তু এ লড়াইটা তাঁকে লড়তেই হবে। না হলে রেওয়া, মালয়ার মতো তাঁর গোণ্ডও ভেসে যাবে, প্রাণ থাকতে এ তিনি হতে দিতে পারেন না।

হে নৃসিংহদেব আলো দাও...

 

***

১৫৬৪, জুন মাস, বর্ষাকাল, নারাই প্রান্তর

 

আসফ খান কিশোর বাদশাহ আকবরের থেকে অনুমতি নিয়ে দশ হাজারের সামরিক বাহিনী পেয়েছে।

রানি দুর্গাবতীর সম্মিলিত বাহিনী দুহাজার। তার উপর সেই বাহিনী সম্পূর্ণ সামরিক নয়। বেশিরভাগই কৃষক। তাদের মূল পেশা কৃষি, সময়ে রাষ্ট্রের জন্য তারা অস্ত্র ধরে। নিজেদের অস্ত্র, ঘোড়া তারা নিজেরাই বহন করে নিয়ে আসে।

সেনাপতি অর্জুন দাস সবথেকে বড়ো এবং শিক্ষিত রেজিমেন্টটা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন সংকীর্ণ পর্বতমাঝে। দু’দিকে পাহাড়ের গায়ে গা মিশিয়ে রইলেন রানি নিজে ও পুত্র বীর নারায়ণ।

সে এক অসম যুদ্ধ। অসম সাহসিকতায় ভর করে গুটিকয় মানুষ পুরাতনী অস্ত্র নিয়ে মোকাবিলা করে গেল বিপুল মুঘল সেনাবাহিনীর। একদিকে নর্মদা অন্যদিকে গৌর নদী থাকার কারণে মুঘল বাহিনী প্রথমে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না।

বিপদ বুঝে আসফ খান মাঝারি হাওদা দাগা শুরু করলেন। অগ্নিস্রাব করতে লাগল শত শত হাওদা... আড়াল নেওয়ার অবকাশ পেল না মানুষগুলো।

অর্জুন দাসের পাঁচশত সেনানি মা নর্মদেশ্বরীর বুকেই অন্তিম শয়ান নিল।

সংকীর্ণ নারাই-এর প্রান্তর উন্মুক্ত হল, পিলপিল করে প্রবেশ করল মুঘলবাহিনী। অবশিষ্ট দলটাকে ঠেলতে ঠেলতে ক্রমশ নগরে প্রবেশ করাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু আচমকাই ধূমকেতুর মতো দু’দিক দিয়ে নেমে এল রানি আর বীর নারায়ণের বাহিনী। সাঁড়াশি আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ল মুঘলবাহিনী। সেই দিনের মতো তারা পিছু হঠল।

এই প্রথম নিজেকে নারী বলে আক্ষেপ হচ্ছিল তাঁর। যদি তিনি পুরুষ হতেন তা হলে হয়তো সর্দারদের সিদ্ধান্ত এমন করে মেনে নিতে হত না। রাজনীতি, কূটনীতিতে নারীকে মুক্তহস্ত দিলেও যুদ্ধ কেবলমাত্র বীরপুরুষের কাজ বলে মনে করে। তাই এই অসমসাহসী লড়াইয়ের পরেও আজ সর্দারদের চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম মেনে নিতে হল।

চেয়েছিলেন, রাতের অন্ধকারে ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে গেরিলা আক্রমণ করতে, কিন্তু সর্দাররা চাপিয়ে দিল রাতের অন্ধকারে সম্মুখ সমর! রাত্রি গভীর হলে তারা সম্মুখভাগ থেকে আক্রমণ করবে। দম বন্ধ হয়েছিল মন্ত্রণাকক্ষের ভিতর। বাইরে বেরিয়ে এলেন রানি।

মন্ত্রণাক্ষের বাইরে অস্থায়ী ছাউনিগুলিতে কেবল হাহাকার! ‘মা’ হিসেবে নিজের সন্তানসম প্রজাদের এই হাহাকার বড়ো পীড়া দিচ্ছিল। দূরে কেল্লার দিকে তাকালেন। সাতপুরার গায়ে গায়ে গ্রামগুলিতে আজ আলো নেই। কেবল মন্দিরগুলিতে টিমটিম করে জ্বলছে সন্ধ্যাপ্রদীপ। চোখ বুজে এল তাঁর, হয়তো এই শেষ...

 

***

রক্তাক্ত ক্লান্ত সেনাদলের বিষ্ণুযশ ছাউনি থেকেই পেলেন রানি। তা হলে পন্থা ভুল ছিল না। তবে, সেনাদলের অনেকখানি শক্তিক্ষয় হল। কারণ রাতেও ওই বন্দুক নামক অস্ত্রটির নির্ঘোষ শুনেছেন।

 

***

ডান দিক থেকে শ্রমণের পিঠে রানি আর ধনুকবাহিনী তীব্র আক্রমণ চালাল। মধ্যিখানে দেওয়ান অধর মুখোমুখি আঘাত হেনেছে। বাম দিক থেকে পুত্র বীরনারায়ণ ধনুক ও বর্শাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করে চলেছে।

ভোরের আলো ফুটতেই, পাখির ডানার মতো এই ত্রিফলা আক্রমণের ছক কষেছিলেন রানি ও তাঁর সর্দাররা। রাতের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই মুখোমুখি সংঘর্ষে ছত্রখান করা হবে মুঘলদের, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।

দ্বিপ্রহরের আগে তৃতীয়বারের মতো মুঘলবাহিনীকে পিছন দিকে ঠেলে দিল, তাঁদের সম্মিলিত বাহিনী। সন্ধ্যা নামবে আরও কিছুক্ষণ পর। তা হলেই আবার সুযোগ পেয়ে যাবেন তাঁরা। বর্ষার এই স্রোতস্বিনী নদীর মধ্যবর্তী সাতপুরার এই গিরিখাত তাঁদেরকে যে সুবিধা দেবে তা গতকালই বুঝে গিয়েছেন।

তার আগেই হল ভীষণ বজ্র নির্ঘোষ! মেঘ ডাকল নাকি! চমকে উঠল সবাই, ততক্ষণে হাহাকার আর আর্তনাদ জেগেছে। ডানপাশ থেকে দাউদাউ করে জ্বলছে মানুষ। অবাক বিস্ময়ে দেখলেন রানি, টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে তাঁর সাধের রণহস্তীগুলি, আর মানুষ; তাদের চেনার উপায় নেই।

এই তবে সেই বজ্র, যার নির্ঘোষ মালওয়ার প্রান্ত থেকে সাতপুরার পর্বতশ্রেণি পেরিয়ে তাঁর কানে এসে ধাক্কা মারত!

ধুরন্ধর সমরকুশলী আসফ খান বুঝেছিল, সন্ধ্যা হলে আবার গতকাল রাত্রের অভিজ্ঞতা হবে। বাদশা হওয়া আকবর ভারী অস্ত্রের যথাসম্ভব কম অপচয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাই সে এতক্ষণ চুপ ছিল। কিন্তু এবার আর থাকল না। হাওদা ছেড়ে ভারী ও মাঝারি তোপ দাগা শুরু করল।

উপুর্যপরি আঘাতে ছত্রখান হয়ে গেল রানির সৈন্যদল। তাদের আড়ালও অপসৃত হল। উন্মুক্ত হয়ে গেল তারা। একের পর এক সর্দাররা শয্যা নিল। তবুও বীর বিক্রমের লড়ে চলছিলেন মা ও ছেলে। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, নিজেদের সীমানায় পরদেশি মুঘলদের পা রাখতে দেবেন না। ধনুকে অগ্নিবাণ সংযোজন করে মাহুতকে আদেশ দিলেন, “শ্রমণকে এগিয়ে নিয়ে চলো। ওদের ওই অস্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে।”

আর ঠিক সেই সময় একখানি তির এসে বিদ্ধ হল রানির কর্ণমূলে। মাকে আড়াল করার জন্য ছুটে আসতে চাইল বীর নারায়ণ। কিন্তু তাকেও ঘিরে ধরেছে মুঘলবাহিনী।

চিৎকার করে বলতে চাইল ছেলে, “মা তুমি হাতির পিঠ থেকে নেমে যাও। আড়াল নাও।”

কিন্তু রানি বীরের প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন। অঙ্কুশ দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেন, “সম্মুখে এগিয়ে চলো শ্রমণ। আজ তোমার ও আমার অগ্নিপরীক্ষা...

না, বেশিদূর যেতে হল না। তার আগেই একটি তির এসে বিদ্ধ হল কণ্ঠের পাশে। তীব্র যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালেন রানি।

 

***

যখন জ্ঞান ফিরল, আশেপাশে আর কেউ নেই। তাঁর পুত্র নারায়ণকেও দেখা যাচ্ছে না। বামদিকে তখনও ঘোর সংগ্রাম চলছে। শ্রমণের মাহুত কি জীবিত আছে? তা-ও বোঝা যাচ্ছে না...

শুধু বুঝতে পারলেন মুঘলবাহিনী তাঁর অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। শ্রমণ হেঁটে চলেছে মন্থর গতিতে, সম্মুখভাগে... ঝাপসা দৃষ্টিতে সবুজ পতাকাওয়ালা ছাউনি ধরা পড়ল। আসফ খানের হস্তী! অর্থাৎ জীবিত ধরা পড়বেন তিনি!

না, আর দেরি করলেন না রানি। আত্মসমর্পণ কোনওমতে নয়, প্রায় অসাড় হয়ে আসা হাত দিয়ে কটিদেশ থেকে অতি কষ্টে বের করে আনলেন ছুরি। চেপে প্রবেশ করালেন আপন কণ্ঠমধ্যে...

 

জব্বলপুরের আকাশে তখন তেড়ে বৃষ্টি নেমেছে। মুঘলরা তাদের তোপ বন্ধ করল। সাঁইসাঁই বাতাস উঠল আষাঢ়ের। যেন মা নর্মদা নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন। এ বাতাস যেন সেই আর্তনাদ, মাথা কুটছে সাতপুরার গিরিকন্দরে...

১৫৬৪, ২৪ জুন চিরস্থায়ী হল সেই রক্তঝরা আত্মবলিদানের স্মৃতি বুকে নিয়ে। হ্যাঁ, আজ ২৪ জুন বলিদান দিবস হিসাবেই উদ্‌যাপিত হয়। এভাবেই ইতিহাস মনে রেখেছে বীর মা দুর্গাবতীকে।


______________________________________________________________________________

প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলি পড়ুন:

প্রথম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post.html

দ্বিতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_13.html

তৃতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_20.html

 

মন্তব্যসমূহ