প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর
প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান
পর্ব ১: কিউলি
দেবী
তমোঘ্ন
নস্কর
তোর সাধ্য কী রে আমায় জ্বালাবি?
আমি তো অগ্নিশুদ্ধ,
আমার কান্নায় জন্ম
আমার হাসিতে মুক্তি…
অক্টোবর,
১৭৮০ (বিজয়া দশমীর দিন)
শাড়ির আঁচল কষে বাঁধা। কিউলির উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ যেন আরও একটু উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আজ। যেন শৃঙ্গার
করেছেন। সব চাইতে উজ্জ্বল লাগছে তাঁর টানাটানা চোখ দুটো। দাঁতে দাঁত চেপে
ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করলেন কিউলি। পিছনে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেল্লার ভারী কাঠের
পাল্লা দুটো।
বাইরে হাতে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর আটজন সহচর। আটজন সেরা যোদ্ধা, যারা আজ আত্মবলিদানের জন্য বদ্ধপরিকর।
দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে ভারী বুটজুতোর
আওয়াজ। লোহার নাল বসানো জুতোর কম্পনে থর থর করে কেঁপে উঠছে মাটি। পাল্লার এক চিলতে
ফাঁক থেকে দেখলেন, কোশমুক্ত চার জোড়া
তলোয়ার ঘাড়
সোজা করল শেষ লড়াইয়ের জন্য। যেভাবেই হোক ভিতরে তাদের সর্দারনিকে তারা রক্ষা করবেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শক্ত করলেন চোয়াল। দৃঢ়
হাতে টেনে দিলেন পাল্লা। ভারী
খিলটা তুলে দিলেন।
আর সেই মুহূর্তেই
দরজায় বাইরে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুরু হল। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে শুনলেন অস্ত্রের
সেই উন্মাদনা। আহ্, এই উত্তেজনা। আর শোনা হবে না
কোনওদিন। ধীর প্রত্যয়ী পায়ে এগিয়ে গেলেন ঘরের ভিতরে… নকশাটা মাথায় গেঁথে নিয়েছেন।
***
কয়েক মুহূর্ত পরেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে
কেঁপে উঠেছিল গোটা কোতোয়ালি। কেঁপে গিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত।
***
ভাবছেন কে ইনি? ভিরামাঙ্গাই কিউলি পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা
সুইসাইড বোম্বার তথা প্রথম মহিলা শহিদ। দাক্ষিণাত্যের শিবগঙ্গা রাজবংশের রাজমাতা ‘রাজমাতা ভেলু নাচিয়ার’-এর সেনাধ্যক্ষ কিউলি
দেবী।
তদানীন্তন ভারতবর্ষের বর্ণাশ্রমের কঠিন নিষ্পেষণ হতে বেরিয়ে আসা এক উজ্জ্বল রত্নের
নাম কিউলি। হতদরিদ্র মুচি পরিবারের সন্তান ছিলেন কিউলি। আর তাই সংগ্রাম তাঁদের নিত্য সহচর। শৈশবে দেখেছিলেন, খেত নষ্ট করতে আসা ষাঁড়ের সামনে লাঠি হাতে রুখে দাঁড়াচ্ছেন তাঁর রোগা
মা। একসময় ষাঁড় পিছু হটছে, তাঁর মায়ের লাঠির সম্মুখে। সেই থেকেই নিজের ভিতরে লড়াইয়ের স্পৃহাটাকে
জাগিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
এরপর প্রাচীন শিলামবম-এর শিক্ষা
নেন৷ এই জুজুৎসু একেবারেই ভারতবর্ষের নিজস্ব এবং প্রাচীন। মনে করা
হয় এর থেকেই বাকি দেশের জুজুৎসুর প্রচলন হয়েছে। এবং নারী হওয়ায় রানি ভেলু
নাচিয়ারের প্রাসাদপ্রহরী দলে সাধারণ সৈনিক হিসেবে নিযুক্ত হন।
রামানাথাপুরমে ‘রামানদ
এস্টেট’ ভারতের
শেষ সীমা ঘেঁষা একটি ক্ষুদ্র জমিদারি রানি ভেলু নাচিয়ারের।
অবশ্য স্বাধীন রাজ্যের রাজাদের মতো
তাঁদের ঠাঁটবাট। এখানে রাজা বা জমিদারদের সেথুপতি বলা হয়। কারণ এঁদের রাজত্বেই
অবস্থান কিংবদন্তির রামসেতুর। সেই সেতুর থেকেই এই নাম।
এই বংশেরই রাজা বিজয়া রঘুনাথার একমাত্র
কন্যাসন্তান ভেলু। রাজা তাঁকে মনের
মতো করে তৈয়ার করেছিলেন। লাঠিখেলা (শিলামবম) থেকে ভালারি, অসিযুদ্ধ থেকে
বন্দুক চালানো সব শিখেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয় মাতৃভাষা ছাড়াও উর্দু, ইংরেজি এবং ফরাসিতে দখল ছিল তাঁর।
পরিণত বয়সে শিবগঙ্গা রাজত্বের রাজা মুথুভাদুগানাথা
উদয়া থেভরের সঙ্গে বিবাহ
হয় তাঁর। বিয়ের ক’মাস পরে কোল আলো করে আসে কন্যাসন্তান
ভেলাচ্চি। সেই সময় তাঁর নজরে আসে কিউলি দেবী। সেই সময় কিউলি সামান্য একজন প্রাসাদপ্রহরী।
তবে এর দরুন বহু রাজকর্মচারীকে সম্মুখ হতে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।
রানি ব্রিটিশদের যুদ্ধকৌশল শেখার জন্য একজন
নতুন অস্ত্র-প্রশিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ছাউনির পলাতক সৈনিক। সবই
ঠিক ছিল, নতুন
নতুন আদব-কায়দা দেখিয়ে রানির মনও জয় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন
যেন কিউলির তাঁকে ভালো
লাগত না। কিন্তু এমন একজন সম্মাননীয় মানুষের নামে প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ
আনা যায় না। তাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। একদিন হাতেনাতে তাঁকে ধরে
ফেললেন। সেই প্রথম রানির নজরে এলেন তিনি। রানি সেদিনই
বুঝেছিলেন, এই
মেয়ে কেবল সাধারণভাবে খেয়ে-পরে
থাকার জন্য জন্মায়নি…
নিম্নবর্গীয় রক্ষীটিকে নিজের বিশেষ দেহরক্ষী-পার্শ্বচর করে নিয়েছিলেন রানি ভেলু
নাচিয়ার।
১৭৭২ সালে নিজের করদ রাজ্যের দাবিদাওয়া নিয়ে আরকোটের নবাবের সঙ্গে সংঘাত বাধে থেভরের। যেমনটা বেধেছিল আমাদের বারো ভুঁইয়া আর মুঘলদের মধ্যে। যুদ্ধক্ষেত্রে কোনওমতে সামাল
দিলেও, একরাতে আচমকাই শিবগঙ্গার প্রাসাদ-নগর আক্রমণ করে ব্রিটিশ ও আরকোটের মিলিত
বাহিনী। সে রাতে রানিও রাজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কৈকেয়ী হয়ে।
কিন্তু রাজা বা শিবগঙ্গা কাউকেই বাঁচাতে পারেননি। কোনওমতে পালিয়ে আসেন প্রাণ বাঁচিয়ে।
কন্যার হাত ধরে, অবশিষ্ট কিছু সেনা নিয়ে দিনদুগলে পালিয়ে এলেন রানি।
অসাধারণ বুদ্ধিমতী ছিলেন রানি ভেলু
নাচিয়ার। তিনি জানতেন, এই ভাঙা দল নিয়ে ব্রিটিশদের আক্রমণ
করার অর্থ মৃত্যু। এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাই গোপনে চালিয়ে গেলেন চেষ্টা।
প্রথম দিন থেকেই তাঁর মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন
মারুথু ভাইয়েরা (পেরিয়া ও চিন্না মারুথু)। কিন্তু সুসংগঠিত
আক্রমণের জন্য আরও আরও লোকবল চাই। বিখ্যাত এই ভাইদের
কথা অন্য পর্বে বিশদে আলোচনা করা যাবে।
রানির
এই দৃঢ় স্বাধীনচেতা মনোভাবে আকৃষ্ট হন আর-এক নবাব। অস্ত্র আর সৈন্যের আশ্বাস নিয়ে
এগিয়ে আসেন ব্রিটিশদের ত্রাস, মহীশূরের নবাব হায়দার আলি।
শুরু হয় ছক কষা। পেরিয়ে গেছে আট বছর,
শিবগঙ্গার নাম বদলে করা হয়েছে হুসেন নগর। তবে রানি একেবারে চুপ ছিলেন না। কিউলি দেবী ততদিনে রানির অনেক কাছে চলে এসেছেন। তাঁর গরিলা বাহিনীর
সেনাপতি তিনি। কখনও চোরাগোপ্তা, কখনও ক্ষিপ্র আক্রমণে নাস্তানাবুদ
করে দিতে থাকেন ব্রিটিশদের। যেখানে ব্রিটিশদের অত্যাচার
সেখানেই খড়্গ নেমে আসছিল রানির, কিউলি দেবীর হাত ধরে।
কিউলি গড়ে তুলেছেন সুগঠিত গুপ্তচর দল।
নানাভাবে, নানা ছদ্মবেশে তারা ব্রিটিশদের ভিতরে ঢুকে পড়ত এবং অনেক
অত্যাচার সহ্য করেও দিনের পর দিন পড়ে থেকে কেল্লার ভিতরের নকশা তুলে আনার কাজ করেছিল৷
কোম্পানির কেল্লা এবং মালখানার নকশা তাঁদের হাতে এলে, ছক কষা শুরু হয়।
একেবারে ভিত হতে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য কেবল
আচম্বিত আক্রমণই নয়, একখানা বিস্ফোরণের প্রয়োজন ছিল। তবেই সেই আওয়াজ গিয়ে পৌঁছোবে সুদূর
ইংল্যান্ডে। কিন্তু অল্প কিছু বারুদে তা সম্ভব নয়। তার জন্য মালখানার স্তূপীকৃত
গোলা-বারুদকেই জ্বালানি করতে হবে।
তৈরি হয় পরিকল্পনা। এই কাজের জন্য দরকার ছিল
আড়াল। ব্রিটিশরা রাজত্ব কেড়ে নেওয়ার পর কেবলমাত্র বিজয়া দশমীর দিনটাতেই কেল্লায় জনসাধারণকে পূজা দিতে ঢুকতে দেওয়া হত।
এটাই সুযোগ।
কিন্তু দেখা গেল, এইবারে
যেন সাংঘাতিক তৎপরতা। কিছুতেই কেল্লায় প্রবেশ করা যায় না। তবুও অনেক কষ্টে কেল্লায়
প্রবেশ করেন কিউলি দেবী আর তাঁর
ছোট্ট মহিলা বাহিনী। অতর্কিত আক্রমণে সৈন্যবাহিনীকে দিশাহারা করে, বাইরের দু’টি ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করেন কেল্লার মূল
ফটকে।
নিজের সৈন্যদের মধ্যে তখন মাত্র আটজন
বেঁচে রয়েছে। ব্রিটিশ সৈন্যরা ঘিরে ধরেছে তাদের। আটজন প্রাণপণে
ফটক আড়াল করে রইল। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন কিউলি দেবী। সর্বাঙ্গে ঘি, তেলের
লেপন আর হাতে মশাল নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে ঢুকে পড়েন মালখানায়। ভাবতে পারেন, কী আত্মত্যাগ!
তারপর বিস্ফোরণের শব্দে যখন সচকিত হয়ে উঠল সমস্ত চরাচর, হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল রানির বাকি বাহিনী।
রানি ভেলু নাচিয়ার কণ্টকমুক্ত
করতে পেরেছিলেন নিজের সিংহাসন। আরও ১৫ বছর স্বাধীনভাবে রাজত্ব করে দেহ রেখেছিলেন রানি ভেলু
নাচিয়ার। ইতিহাস কি মনে
রেখেছে রানি ভেলু
নাচিয়ার আর প্রথম মহিলা সুইসাইড বোম্বার কিউলি দেবীকে?
ভারতীয় ডাক বিভাগ রানি ভেলু
নাচিয়ারের সম্মানার্থে স্ট্যাম্প প্রকাশ করে।
আজকের ভারতবর্ষ ঋণী এই সকল মহীয়সীদের কাছে। না, এ ঋণ শোধযোগ্য নয়। বিস্মৃতি আমাদের ঠেলে নামিয়ে দিচ্ছে অন্ধকারে। তাই, আবার আসব পরের পর্বে, আমাদের সীমিত সামর্থ্যে স্মৃতি তর্পণের উদ্দেশ্যে।
তথ্যঋণ
১) ‘First Woman Suicide Bomber of India against British
during Freedom Struggle’, myIndiamyGlory
২) ‘FIVE Unsung Women Martyrs of Indian Freedom Struggle’,
myIndiamyGlory
৩) ‘Of valour and victory’,
The Hindu. Chennai, India. 26 July 2013
৪) ‘Kuyili
History’
৫) MV,
Amudha. ‘Kuyili:
The Dalit Commander Whose Sacrifice Remains An Unsung Tale’, feminisminindia.com
৬) Velu
Nachiyar & Kuyili: The Women Who Took Down The British 85 Years Before 1857!
৭) ‘Veeramangai Velu Nachiyar’,
The Hindu Business Line
৮) Tamil
Nadu to build memorial for freedom fighter Kuyili’,
Times of India
৯) Wikipedia
চিত্রঋণ: ইন্টারনেট ও চ্যাটজিপিটি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন