প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর

                             

প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান

 

তমোঘ্ন নস্কর

 

 


রাণা হামির


পর্ব ৩: রাণা হামির

 

“তোমার দাদা-সা শেষবারের মতো সারঙ-কে চুমু খেয়ে তার পিঠটা চাপড়ে দিল। সারঙ বাপু-সা’র কথা সব বুঝত, সে বুঝতে পারল, প্রভুর সঙ্গে এ-ই তার শেষ দেখা। আমাকে পিঠে নিয়ে দৌড় দিল।”

“ততক্ষণে আমার ভাইয়েরা পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর শুরু হল সেই ভীষণ লড়াই... আমার সম্মুখেই রাওয়াল রতন সিংয়ের তখন পতন হল।”

“আমি চলে যেতে যেতে দেখলাম, বাপু-সা’র মাথা কেটে নিল ওরা। মুণ্ডহীন ধড়টা কাঁপতে কাঁপতে দু’হাতে খণ্ড চালাল দু’বার, তারপর ঢলে পড়ল আমার ভাইদের উপর। কুদারুর গ্রামে এসে জানলাম, রানা লক্ষ্মণ সিংহ আর আটটি বীর পুত্রের পতন হয়েছে...”

“তা হলে তুমি ফিরে গেলে না কেন কাকা-সা?”

“ওদের সৎকার কর্ম করতে হত তো...”

“বাপু-সা আর আমার আট ভাই সৌগন্ধ নিয়েছিল যে... আমি তো লড়তে চেয়েছিলাম শেষ শ্বাস অবধি। ভীষণ লড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাপ্পা রাওয়ালের সেই মহান রক্তধারা শেষ চিহ্নটুকু বজায় রাখার সৌগন্ধ দিয়ে ওঁরা আমাকে আড়াল করে দিলেন। ক্ষতবিক্ষত আমি কাপুরুষের মতো পালিয়ে এলাম। তাঁরা শকপ্রাপ্তি করে মাটির ঋণ শোধ করলেন। আর আমি...”

যাঁদের যুদ্ধে শকপ্রাপ্তি হয় তাঁদের আলাদা করে সৎকার লাগে না। রানা অজয় সিংহ থামেন, চৌকো কঠিন মুখটা বেঁকে যায় যন্ত্রণায়। ফোঁটা ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে নামে।

বালক হামির অতশত বুঝতে পারে না। কিন্তু ভীষণ এক জ্বালাময় শূল যেন তার বক্ষমধ্যে গেঁথে যায়। যতবার কাকা-সা’র মুখ থেকে এই কাহিনি শোনে ততবার সেই জ্বালাটা ভীষণ হয়...

 

***

হামিরের বেঁচে যাওয়া দৈবঘটনা। যুদ্ধের আগে জ্যেষ্ঠপুত্র অরি সিংহের গর্ভবতী পুত্রবধূ উর্মিলা প্রসবহেতু উন্নাও গাঁয়ের মাঈকিতে ছিলেন। তারপর সেখানেই হামিরের জন্ম।

এদিকে আটমাস ধরে চিতোর অবরোধ করে রাখেন আলাউদ্দিন খিলজি। ভারী বর্ষায় যখন চিতোরের পতন হয়, তখন একদিকে পতন হয় লক্ষ্মণ সিংহ, অরি সিংহ আর তাঁর পুত্রদের, অন্যদিকে তাঁদের বধূরা কেল্লা-নগরীর ভিতর জহরব্রত পালন করেন।

তাই, কনিষ্ঠ পুত্রকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নিজের বংশের শিবরাত্রি সলতেটুকু রক্ষা করতে...

শিশু হামিরের তখন দেড় বছর বয়স। সেখানেই কিছুকাল আত্মগোপন করে, বালক হামিরকে নিয়ে লক্ষ্মণ সিংহের ত্যক্ত রাজত্বে আসেন অজয় সিংহ।

 

***

উন্নাও-এর এই গ্রাম ছেড়ে যেতে হামিরের বড়ো কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সে ভাবী রানা। রানা অরি সিংহের পুত্র, রানা লক্ষণ সিংহ তার দাদা-সা। মহান রানা বাপ্পা রাওয়ালের গিহ্লট রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারী, তাকে তুচ্ছ কারণে কষ্ট করা মানায় না।

তাকে এমনভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। তার কাকা-সা’র বদনাম তাকে ঘোচাতেই হবে। শুধুমাত্র তাকে আড়াল করতেই তিনি ফিরে এসেছিলেন।

পালকিতে নিজের মায়ের মুখের দিকে তাকায়। উর্মিলা কাকা-সা’র মতোই কঠিন দৃষ্টিতে পালকিতে বসে আছেন। হামিরের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে আরও কঠিন হয়ে বললেন, “রানাদের চোখের জল ফেলা সাজে না। পালকিতে নয়, তুমি নেমে কাকা-সা’র সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ো। জানবে ওই চিতোরগড় আমার জীবদ্দশায় তোমাকে উদ্ধার করে দেখাতে হবে। ওর মাটিতে তোমার পিতৃপুরুষের অস্থি মিশে আছে তোমাকেই তার সৎকার করতে হবে। আমি রানা অরি সিংহের বিধবা, নিজপুত্রকে এ আদেশ দিচ্ছি।”

 

***

বিশাল প্রান্তরে মুখোমুখি হয়ে পরস্পরের দিকে অস্ত্র শানিয়ে যাচ্ছিল দু’জন, হামির আর মুঞ্জা। হামির মাত্রই কিশোর , আর মুঞ্জা বৃষস্কন্ধ পুরুষ। মেওয়ারের গ্রামগুলিতে ত্রাসস্বরূপ এই মুঞ্জা ডাকাত।

ঝড়ের মতো আসে। গ্রামগুলিতে লুটপাট চালায় আর তারপরে পালিয়ে যায়। অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল হামির। আজকে পলায়নপর ডাকাত দলটার মুখোমুখি হয়েছিল হামির। দু’পক্ষ এই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করেছে। শেষে মুঞ্জাই প্রস্তাব রাখে মুখোমুখি সংঘাতের, ভেবেছিল ওই ক্ষীণ তনু কিশোরকে সহজেই পেড়ে ফেলবে।

কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, এই চেহারাই তাকে বিশেষ সুবিধা দিল। মুঞ্জার এক-একটি আঘাত এক মন ওজনের হাতুড়ির মতো ধাক্কা মারছে হামিরের শরীরে। সে-শক্তি হামিরের নেই। কিন্তু ওইটুকু সময়ে অনেক বেশি সংখ্যক আঘাত মুঞ্জাকে হানছে। অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে বিশাল চেহারার প্রতিপক্ষের পায়ের তলা দিয়ে অনায়াসে গলে যাচ্ছে এই দিক থেকে ওই দিকে...

অত বড়ো শরীর নিয়ে এদিক-ওদিক করতে পারার আগেই সুনিপুণ দক্ষতায় গভীর ক্ষত দাগ করে দিচ্ছে হামির। সাপ-নেউলের খেলায় অত্যধিক রক্তক্ষরণে ক্লান্ত, অবসন্ন মুঞ্জা ঢলে পড়তেই হামির তলোয়ারখানা আমূল বিদ্ধ করে দিল তার বুকে...

হামিরের এই জয় চিতোরহীন মেবারের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিল তাকে। সবাই কায়মনোবাক্যে ওই কিশোরকেই মেনে নিল ‘রানা’ হিসেবে। শিশোদিয়া বংশের অন্যতম প্রাণপুরুষ হামির সিংহের ‘রানা’ হয়ে ওঠা তখনও কিন্তু বেশ খানিকটা বাকি।

 

 

 

।। চিতোর উদ্ধার।।

 

চিতোরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জল আসে হামিরের। মাতৃসম চিতোরগড়ের গায়ে অসংখ্য আঘাতের দাগ। তার মধ্যে অনেকগুলি তার নিজেরও দেওয়া। হয়তো সেই অভিমানেই বারে বারে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে জননী চিতোর।

যোদ্ধার এই ধরনের খামখেয়ালি আবেগ শোভা পায় না। তবুও বারংবার ব্যর্থ চিতোর আক্রমণ ভিতরে ভিতরে দুর্বল করে দিয়েছিল সিংহহৃদয় হামিরকে।

চিতোরের গড়পার ( কেল্লাদার) সংগোরা মালদেব নেহাতই খিলজির পুতুল। ভেবেছিলেন, দুর্বল মানুষটার হাত থেকে কেল্লা দখল করা বিশেষ সমস্যার হবে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্র দেখা গেল এ একপ্রকার অসম্ভব...

গত তিন বছরে বার বার আক্রমণ করেছে। বর্ষা এবং শীতের বিভিন্ন সময়ে নিজের সেনাদল সাজিয়ে আছড়ে পড়েছে। কিন্তু চিতোরের গঠনই দুর্ভেদ্য। ওই পর্বতগাত্রের ফাঁকে ফাঁকেই নিজের সঙ্গীদের শতশত দেহ ফেলে আসতে হয়েছে। গড়ের দরজা একবার বন্ধ হলে ভিতরে দীর্ঘকালের জন্য গড়বাসীরা নিরাপদ।

 

***

ক্রমশ শরীর ও মন ভেঙে পড়ে রানা হামিরের। মাতৃআজ্ঞা পালন করতে না পারার ব্যর্থতা বুকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন; চিতোর উদ্ধারের সংকল্পের এখানেই ইতি। অল্প কিছু প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে তীর্থযাত্রায় বের হন রানা হামির। গন্তব্য দ্বারকা...

গুজরাটে প্রবেশ করে খোরের গ্রামে এক মায়ের কথা শোনেন। মা বিরওয়ারী নাকি সাক্ষাৎ হিংলাজ মায়ের শক্তিঅংশ। রানা মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মা বিরওয়ারী ছিলেন চারণ অর্থাৎ মুখে মুখে ছন্দ কাব্য রচনা করে মানুষকে উপদেশ দিতেন, আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতেন। মা বিরওয়ারী রানা হামিরকে পুনরায় চিতোর আক্রমণের উপদেশ দেন...

রানা নিজেকে সমর্পণ করেন মায়ের পায়ে। তাঁর যে আর কিছুই নেই। না আছে লোকবল, না আছে অর্থবল।

মা বিরওয়ারী আদেশ দেন, বিধর্মীদের হাত থেকে রাজ্য উদ্ধারে মা নিজে সহায় হবেন। স্বপুত্র, সেনাদের রানাকে সাহায্যের জন্য পাঠাবেন।

পরিপূর্ণ হৃদয়ে হামির ফিরে এসে উদয়পুরের খেড়োয়ারের গ্রামে নিজের ছাউনি ফেলেন। অল্প সময়েই পাঁচশত বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুর্দান্ত সেনানি সহ বিরাট সৈন্যদল নিয়ে মাতা বিরওয়ারীর সন্তান বারুজি এসে উপস্থিত হন।

 

***

পাহাড়ের উপরে যাদের অবস্থান তাদের অবস্থানগতভাবেই অনেক সুবিধা থাকে। সামান্য একটা পাথর গড়িয়ে দিলেও সেটা ভীষণ গদার মতো এসে আঘাত হানে। একে আটকানোর একমাত্র উপায় দুরন্ত গতি। সেই অসাধ্য সাধন করল এই পাঁচশত সেনানি! দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ভোরবেলার মধ্যে গড়ের দুয়ারে এসে পৌঁছোল। বীর্যে কিংবা বিক্রমে অবরোধের আড়ালে থাকা সৈন্যরা রানার সৈন্যের সমকক্ষ কখনওই ছিল না। তাই অবরোধটুকু ভেঙে যেতে সময় লাগল না। এক-একজন সৈন্য একশত হয়ে লড়াই করল।

শিশোদিয়া বংশের সূর্যলাঞ্ছিত পতাকাতলে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেন মহারানা হামির সিংহ। বৃষস্কন্ধ পুরুষটি; যাঁর দেহে নাকি চব্বিশটি প্রাণঘাতী ক্ষতচিহ্ন, সেই মানুষটা কাঁদছেন...

তবে এই যুদ্ধে রানার আরও একটি বিশেষ সুবিধা ছিল, দিল্লির টালমাটাল অবস্থা! এই সময়টা দিল্লির এক সন্ধিক্ষণ। একদিকে আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যু, মালিক কাফুরের কর্তৃত্ব। অন্যদিকে তাঁকে সরিয়ে উমরাহদের সাহায্য নিয়ে মালিক তুঘলকের দিল্লির সিংহাসন আরোহন। তবে তিনিও বেশিদিন সিংহাসনে বসতে পারেননি। অল্প কালের মধ্যেই দেহত্যাগ করলেন এবং তাঁর সন্তান মহম্মদ বিন তুঘলক সিংহাসনে বসলেন। এই সময়ে কেউই ভালোভাবে চিতোরের দিকে নজর দেননি।

 

***

মা অন্নপূর্ণার মন্দিরে সন্ধ্যারতি হচ্ছে। মায়ের এই মন্দিরটি চিতোরের গড়ে গড়েছেন রানা। মায়ের আশীর্বাদে তাঁর চিতোরপ্রাপ্তি। শুধু চিতোর নয়, মেবারের নামমাত্র অধিপতি সংগোরা মালদেবের পুত্র জাইজা মালদেবকে উৎখাত করে সমগ্র মেবারের একচ্ছত্র অধিপতি হয়েছেন তিনি।

শিশোদিয়া গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন তাঁর দাদা-সা লক্ষ্মণ সিংহ। তাই মেবারের রাজবংশ তাঁর যুগ থেকেই শিশোদিয়া বংশ নামে পরিচিত হবে, এমনটাই হুকুম দিয়েছেন তিনি। এ তাঁর পিতৃপুরুষের প্রতি তর্পণ, সৎকার কার্য... আকুল হয়ে মন্দির দুয়ারে বসে এ-সকল ভাবছিলেন মহারানা।

“হুকুম-সা...,” চমক ভাঙল দেহরক্ষীর ডাকে। পত্র পড়েই আষাঢ়ের মেঘ ঘনাল তাঁর মুখে।

 

***

সিঙ্গোলির মহাপ্রান্তর। মুখোমুখি দুই শক্তি... একজন আয়তনে বিপুল; দিল্লির বাদশাহ ও তার সেনাবাহিনী। অন্যজন বহরে কম কিন্তু  শক্তিতে ঝড়ের ন্যায়; মেবার বাহিনী। দিল্লির রাজবংশে তরুণ রাজা শুনে এসেছিলেন, রাজপুতরা কেবল সৈনিকের জাত, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে না। আত্মত্যাগ করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্র দেখা গেল, সমরকুশলতায় দিল্লির অজস্র-অগুনতি ভাড়াটে বেতনভুক সৈনিকের চেয়ে তারা অনেক বেশি ক্ষুরধার। কৃষি এবং যুদ্ধ, দু’টি পেশাতেই সমান পারদর্শী মেবারের মানুষজন। তারপর কোল-ভিল প্রভৃতি উপজাতিগুলো দুর্ধর্ষ এবং দুর্দমনীয়। তারা যুদ্ধ ব্যবসায়ী নয়, তারা মাতৃভূমির জন্য লড়াই করতে নেমেছে।

তুঘলকের একের পর এক ব্যূহ ভেঙে হস্তীপৃষ্ঠ থেকে তাঁকে (পক্ষান্তরে তাঁর সেনাপতি) বন্দি করলেন হামির।

 

***

ভীষণ এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, দিল্লি থেকে চিতোরের পথ বেয়ে এল একশত সুসজ্জিত রণহস্তী, সেই সঙ্গে পঞ্চাশ লক্ষ অর্থমূল্যের জরিমানা। আজমেড়, রনথম্বোর, নাগোরের অধিপতিরা মেনে নিলেন মহারানার কর্তৃত্ব...

ছ’মাস পর দিল্লির সিংহাসনে আবার দেখা গেল দিল্লীশ্বর মহম্মদ বিন তুঘলককে। কিন্তু এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন! ইতিহাসের সে-পাতা গোপনই রইল। হয়তো, মহান দিল্লীশ্বরের সম্মানের কথা ভেবে চাপা রইল লজ্জার অধ্যায়টি।

কেবল প্রাচীন জৈন মন্দিরের দেওয়ালে খোদিত রইল সাক্ষীলিপি।


______________________________________________________________________________

প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলি পড়ুন:

প্রথম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post.html

দ্বিতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_13.html

 

মন্তব্যসমূহ