প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর

 




প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান

 

তমোঘ্ন নস্কর

 

 

উনবিংশ পর্ব: বারবাঁকি কথা

 

 

দুর্দান্ত গরমে মাটির উপর থেকে ভাপ উঠছে। এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে আসা বালুকণা তপ্ত দীপশলাকার মতো জ্বালিয়ে দিচ্ছে মুখের চামড়া।

শিরস্ত্রাণ, বক্ষবন্ধনী, এসবের বাইরে যতটুকু জায়গা ফাঁকা আছে, সেখানে রুধির জমে আছে থপথপে হয়ে। কিন্তু তিনি সুহেলদেব। এত সহজে হার মানবেন না। দু’হাতে খণ্ডদু’টি আর-একবার ঘুরিয়ে নিয়ে বাহবার পেটে গুঁতো মারলেন। বাহবা তিরবেগে ছুটে চলল সম্মুখ বাহিনীর ফাঁকফোঁকর গলে

বাহবা আর তার পৃষ্ঠে রাজা সুহেল দেবকে ততক্ষণে ঘিরে নিয়েছে চার-পাঁচজনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দল। তারাও বুঝে গেছে, তাদের রাজার উদ্দেশ্য কী? চারদিক থেকে পাঠানবাহিনী শেষবারের মতো একত্রিত হয়ে চেষ্টা করল বাধা দেওয়ার। দু’-একটি তির-বল্লম যে ছুটে এল না, তা নয় বাহবার কোমরের কাছটা ছড়েও গেল। কিন্তু সে শিক্ষিত রণঅশ্ব। সেও বুঝে গেছে, তার প্রভু কী চায় তার প্রভু যদি সফল হয়, তা হলে বিশ্রাম সেটুকু— এই মূকপশুও সেটা বুঝে নিল। লাগামের তীব্র টানে লাফিয়ে উঠল বাহবা। তারপরেই হাহাকার উঠল পাঠান শিবিরে।

ক’হাত গড়িয়ে গেল খণ্ডিত মস্তকটি। শেষবারের মতো শূন্যে হাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করলেন পাঠান অধিপতি সালার মাসুদ। বোধহয়, ভারতবর্ষকে পরাধীন করার স্বপ্ন। বলাই বাহুল্য, তা অধরাই থেকে গেল।

 

মাহমুদ গজনির সোমনাথ আক্রমণ

 

১০২৫ সালে মাহমুদ গজনি যখন উড়ন্ত গৃধ্নুর মতো নেমে এসেছিলেন ভারতবর্ষের বুকে। নিজ সাম্রাজ্য বিস্তার এবং লুণ্ঠনের অছিলায় একের পর এক লুট করে চলেছিলেন ভারতবর্ষের মন্দিরগুলি। সেই সময় তাঁর শিবিরে তৈরি হচ্ছিল আর-একটি গৃধ্নুশাবক সালার মাসুদ। তিনি চিনিয়ে যাচ্ছিলেন সোনার দেশের স্বর্ণখনিগুলি, মাংসের গন্ধ ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলেন সেই শাবকের চোখে

হ্যাঁ, আজকের আলোচনা গজনির মাহমুদের সালার মাসুদ এবং তাঁর শোচনীয় পরাজয় নিয়ে

মাহমুদ তাঁর এগারো বছরের ভাইপোকে নিয়ে ভারতে আসেন ও তাঁকে সাক্ষী রেখে সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করেন। জ্যোতির্লিঙ্গ ধ্বংসের পর তার একটি অংশ নিয়ে গজনির প্রকাশ্য স্থলে রাখা হয়। সেই স্থল ছিল প্রাসাদের প্রবেশদ্বার। তার সম্মুখে জ্যোতির্লিঙ্গ রাখা রীতিমতো অপমান। তাই, পরবর্তীতে হিন্দুরা তাকে ফিরিয়ে আনতে গেলে প্রভূত অর্থ দাবি করেন। এবং সেই অর্থ দিতে বাধ্য হয় আব্দুর রহমান চিসতি

এই ঘটনা তাঁর মনের মধ্যে এই ধারণার জন্ম দিয়েছিল যে, ভারতবর্ষকে বোধহয় খুব সহজেই করায়ত্ত করা সম্ভব।

 

দিল্লি আক্রমণ

 

১০৩১ সালের গ্রীষ্মে সালার সিন্ধু দিয়ে প্রবেশ করে দিল্লির উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হন। দিল্লির সিংহাসনে তখন রাজা মহীপাল তোমর।

রাজা মহীপাল যথেষ্ট বীর যোদ্ধা হলেও আচমকাই সুবিশাল এক লক্ষ সৈনিকের আক্রমণ সামলাতে পারলেন না। তার উপর আছে ক্রমাগত গজনির থেকে আসা সহায়তা।

এরপর তিনি গঙ্গার দোয়াব অঞ্চল ধরে অগ্রসর হন। একে একে রাজা হরিদত্ত, কনৌজের রাজাও সমর্পণ করেন। কনৌজের প্রভূত ধনসম্পদ এবং ঐশ্বর্য দিয়ে তিনি সেখানে নিজের পোক্ত ঘাঁটি তৈরি করলেন।

গঙ্গা পার হয়ে পৌঁছোন অযোধ্যায়। এখানেই অবস্থিত প্রাচীন সাতরিখ বা সপ্তঋষি শহর (অধুনা বারবাঁকি)। এখানেই গুরু বশিষ্ঠ শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। সালার সেই পবিত্র স্থানটিকে নিজেও মুঠোর মধ্যে আনলেন।

একটি নিটোল যুদ্ধের ছক কষেন তিনি। মিঁয়া রাজাব এবং সৈফুদ্দিনকে পাঠান বাহরিচের দিকে। মালিক ফজলকে পাঠান কাশী দখল করতে। আমির কাসাবকে পাঠান মহনা দখল করতে। আজিজুদ্দিনকে পাঠান হরদোই (হরিদ্বার) এবং গোপভূমি দখল করতে।

বাহরিচের পথে সৈফুদ্দিন বাধাপ্রাপ্ত হন। কারণ, বাহরিচ অতিপবিত্র ভূমি। এই স্থানের সূর্যকুণ্ডে মানুষ আসতেন বিবিধ রোগ নিরাময়ের জন্য। ফলে হিন্দুরা প্রবল বাধা দিয়েছিলেন।

বাহরিচ— বালা + ঋষি— বালারিখ— বালা কথাটিই সূর্য হতে উদ্ভূত। ঋষি বলাকের আশ্রম, প্রাচীন পবিত্রস্থল।

অবস্থা বেগতিক দেখে সালার স্বয়ং সৈন্যবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন বাহরিচের উপকণ্ঠে।

এই অঞ্চল অর্থাৎ শ্রাবস্তীর রাজা সুহেলদেব সালারকে জানিয়েছিলেন, পবিত্র হিন্দুর জমি ছাড়তে হবে অথবা, তরবারি দ্বারা মোকাবিলা করতে হবে।

প্রত্যুত্তর আসে, সব জমি আল্লাহর; তাই তিনি যেখানে চান, সেখানে থাকতে পারবেন এবং তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য

শুরু হয় দফায় দফায় সংঘর্ষ। বরাবাঁকি, বহরাইচ, লখিমপুর, সীতাপুর, লখনউ, উন্নাও, ফৈজাবাদ, শ্রাবস্তী, গণ্ডা, এসব অঞ্চলের বিভিন্ন ভূস্বামীদের সমন্বয়ে সুহেলদেব জোট গড়েন

প্রথম আট দিনের যুদ্ধে সালার আধিপত্য করেন রণক্ষেত্রে। মৃত সৈন্যদের শরীর সূর্যকুণ্ডে ফেলে তাকে অপবিত্র করেন। সেখানে একটি মহুয়া গাছের তলায় সমাধি বানান। এই অপমান হিন্দুরা ভালোভাবে নেননি কিন্তু তখনকার মতো তাঁরা অপারগ ছিলেন।

দু’মাস শান্তির পরে রাজা সুহেলদেব যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করলেন। সুহেলদেব কঠিন আদেশ দেন, সালারকে পবিত্র হিন্দুক্ষেত্র ছাড়তে হবে নচেৎ মৃত্যু।

কিন্তু দাম্ভিক সালার উত্তর দিলেন না।

 

১০৩৩ সালের ১৩ জুন

 

রাজা সুহেলদেব স্থানীয় রাজাদের একত্রিত করলেন। সতেরোজন রাজার প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার সৈন্য ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ল সালার বাহিনীর উপর। চিত্তৌরা ঝিলের পাড়ে অগণিত ইসলাম বাহিনী রীতিমতো দলিত এবং মথিত হয় এই সেনাবাহিনীর হাতে। সংখ্যায় তারা হয়তো অগণিত কিন্তু সুহেলদেব এবং শান্তিপ্রিয় ভারতীয়দের কাছে দিনের পর দিন এই অত্যাচার অসহ্য হয়ে উঠছিল। ভারতীয়দের বোঝানো প্রয়োজন পড়েছিল যে, ভারতবর্ষের রাজারা দুর্বলচেতা নয়। ক্ষমা দুর্বলতা নয়।

মোটামুটি বেলা দ্বিপ্রহরের মধ্যেই সালালের সেই সুবিশাল দুই লক্ষ বাহিনীর ষাট হাজার সৈন্য বাদে বাকি সবাই মাটি নিয়ে নেয়। রক্তে লাল হয়ে যায় ভাকলা নদীর জলধারা।

শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনী ছিল অগণিত— চতুর্দিক একাধিক ব্যূহ রচনা করে পাহাড়ের মতো ঘনীভূত হচ্ছিল তারা। অন্যদিকে ইসলামের সৈন্যদলও ছিল বিপুল, কিন্তু তারা ঘাস কাটার মতো উপড়ে ফেলেছিল সুহেলদেবের সেনাদল। অসংখ্য সাধারণ সেনা থেকে অভিজাত সেনাপতি, রাজা, যোদ্ধা সেই যুদ্ধে প্রাণ হারালেন। সকাল থেকে সন্ধ্যার নামাজ পর্যন্ত সংঘর্ষ চলল— দলটির দুই-তৃতীয়াংশ নিহত হল, আর অবশিষ্ট অংশ শোকাহত হয়ে রইল

আব্দুর রহমান চিস্তি, মিরাট-ই-মাসুদি। সালার মাসুদ কেবলমাত্র একটি আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু সুহেলদেব তাঁর সংরক্ষিত বাহিনী নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করেন। মাসুদের সেনাদলের যে অবশিষ্ট অংশ ছিল, তাদেরও নির্দয়ভাবে শেষজন অবধি হত্যা করা হয়। সেনাপতি মীর নাসরুল্লাহ ও সালার মিঁয়া রাজাবের মৃতদেহ সালার মাসুদকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত করে।

রাজা সুহেলদেব তির ছুড়ে সালার মাসুদের শিরশ্ছেদ করে তাঁকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি দেন।

“রায় সুহেলদেব ও হরদেব কিছু প্রধান সেনানায়কের সঙ্গে গোপনে একদল সৈন্যকে সংরক্ষণে রেখেছিলেন। সালার বাহিনীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে, তাঁরা মাসুদের দেহরক্ষীদের উপর চূড়ান্ত আক্রমণ চালায়। ৪২৪ হিজরির রজব মাসের ১৪ তারিখ। সুহেলদেবের তির সালার মাসুদের প্রধান ধমনী বিদ্ধ করে। তাঁর সূর্যসম মুখচ্ছবি ফ্যাকাশে হয়ে যায় নবচন্দ্রের মতো। অবিশ্বাসীরা তাঁর বংশধরদের আজমীর থেকে বিতাড়িত করে, পুনরায় মূর্তি স্থাপন করে এবং হিন্দুস্থানের ভূমিতে পুনরায় মূর্তিপূজা প্রতিষ্ঠিত হয়।” এই খেদ স্বয়ং আব্দুর রহমানের।

তবে তাদের এই হারও চিরস্থায়ী হল। হারিয়ে গেল আমাদের বাহরিচ ও সূর্যকুণ্ড। ভারতবর্ষ এমনই এক অভাগা দেশ যে, সালার মাসুদকেই গাজী পির ঘোষণা করল।

পরবর্তীতে ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন সিংহাসনে বসলেন, সেখানে একখানি সমাধি করে তাকে ‘সন্ত’ তৈরি করে রেখে দিয়ে গেলেন। আমরাও সম্পূর্ণ ইতিহাসটা জেনে, আজও তাকে ‘সন্ত’ জ্ঞান করে চলেছি। অথচ আমাদের এত বড়ো জয়কে মেনে নিয়েও রাজা সুহেলদেবকে আমরা আজ আর কেউ স্মরণ করি না। এইসব অভাগাদের কথাই স্মরণ করার জন্যই প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান

সন্ত তুলসীদাসের যে-উক্তি রোগনিরাময়কারী সূর্যকুণ্ড ও বলাক ঋষির আশ্রমের উপরে নথিবদ্ধ হওয়ার ছিল, সেটি উৎকীর্ণ হল গাজী সালারের সমাধিতে

 

लही आँख कब आँ धरेबाँझ, पूत कब लाइ

कब कोढ़ी काया लही, जग बहराइच जाइ


___________________________________________________________________________


প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলি পড়ুন:

প্রথম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post.html

দ্বিতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_13.html

তৃতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_20.html

চতুর্থ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

পঞ্চম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

ষষ্ঠ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post.html 

সপ্তম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_12.html

অষ্টম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_19.html

নবম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

দশম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

একাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_88.html

দ্বাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_15.html

ত্রয়োদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_24.html

চতুর্দশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_30.html

পঞ্চদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post.html

ষোড়শ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_13.html

সপ্তদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_20.html

অষ্টাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/10/blog-post_11.html

মন্তব্যসমূহ