‘দুই মলাটের দুনিয়া’র বাইরে - অভীক মোহন দত্ত
‘দুই
মলাটের দুনিয়া’ পাঠক পছন্দ করেছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন। ফেসবুক ও প্রিন্টেড মিডিয়ায় আলোচনা
উঠে আসছে একে-একে। আজ ‘এই সময়’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এমনই একটি পরিচিতি। লেখকের
তাতেই তৃপ্তি। লেখক কৃতজ্ঞও বটে। কৃতজ্ঞতা-স্বরূপ পাঠকদের জন্য রইল এমনই একটি গ্রন্থযাপনের
কিসসা, যা ‘দুই মলাটের দুনিয়ায়’ গ্রন্থবদ্ধ হয়নি।
________
আজকাল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘উজান’ পড়তে বসলেই আমার ক্যাথির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ক্যাথির হাতে উল্কি করা সেই শূন্যগর্ভ বালিঘড়িটির কথা।
সেটা
ছিল একটা মেঘলা দুপুর। আলাদিন রেস্তোরাঁর ক্যাথি দু’চোখে ভূমধ্যসাগরের রং ছড়িয়ে আস্তে
করে বলল— “ইউ নো, ইট হ্যাজ এ ডিপার মিনিং। ক্যান ইউ টেল মি হোয়াট ইট ইজ?” আমি তখন ক্যাথির
হাতের দিকে তাকিয়ে। কবজির দু’ইঞ্চি উপরে একটি নিখুঁত বালিঘড়ির অবয়ব। শুধু অবয়বটুকুই।
তার গর্ভে নেই একটিও বালুকণা। ক্যাথি হাসছে মিটিমিটি। একশো হাত দূর থেকে ভূমধ্যসাগর
ছুঁয়ে আসা ভিজে হাওয়া তার শ্বেতস্বর্ণাভ চুলে পাগলামি করছে...
তেল
আভিভ শহরের সাগরবেলা ডানহাতে রেখে রেখে সোজা হেঁটে গেলে পৌঁছোনো যায় জাফা পোর্ট। জাফার
এমনিতে নাম আছে ‘ইজরায়েলের প্যারিস’ বলে— এখানে অলিগলি-পাকস্থলীতে আর্ট গ্যালারি আর
এক্সিবিশনের ঢের। বোল্ডারবাঁধানো বেলাভূমির পাশ দিয়ে রাস্তা সোজা একটি গেছে বন্দরে।
আর-একটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠেছে পুরোনো শহরের দিকে। দুই রাস্তারই ধারে, খাঁজেখন্দে
আনাচেকানাচে অজানা অচেনা শিল্পীর উৎসাহ গ্যালারি গড়ে তুলেছে।
ওল্ড
জাফার সবথেকে মশহুর মিউজিয়াম কাম আর্ট গ্যালারি হচ্ছে ইলিনা গুর মিউজিয়াম। অপূর্ব সুন্দর
সেই মিউজিয়াম-দর্শনের অভিজ্ঞতা আমার বেশ কিছুদিন আগেই হয়েছিল। অনন্য সে অভিজ্ঞতা! কিন্তু
সে গল্প অন্যদিন।
একদিকে
আর্ট গ্যালারির সারি আর অন্যধারে সমুদ্রতট রেখে রাস্তাটি সোজা চলে গেছে জাফা বন্দরের
এককোণে। প্রাক-উড়োজাহাজ সময়ে ইজরায়েল পৌঁছোনোর প্রধান দ্বার ছিল এই বন্দর। আলেক্সান্ডার,
সেন্ট পিটার, জন অফ ইবেলিন, রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট, সালাহদিন, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট—
জাফা বন্দরের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসের কয়েকটি পাতা মাত্র। প্রাচীন বন্দরে ঢোকার মুখের
দু’খানি প্রস্তরপ্রাচীর অশক্ত অর্ধভগ্ন পড়ে রয়েছে। তাদের নোনাধরা পাঁজরে গল্পকথার ভাঁড়ার।
পোর্টের
একধারে সারিসারি ইয়ট, ভাড়ায় পাওয়া যায় সমুদ্রভ্রমণের জন্য। তারই একটির মালিক আতামি।
নৌকা চালিয়ে দর্শকদের সমুদ্রে নিয়ে যান। মন মেজাজ ভালো থাকলে পুরোনো গিটারখানিতে বিখ্যাত
লোকগান ‘রাকেফেত’-এর সুরও তোলেন। যে ফুলের নামে গানটির নাম, গানটির সুর সেই ফুলের রূপের
মতোই মায়াময়।
পোর্টের
একেবারে শেষ প্রান্তে ঝা-চকচকে রেস্তোরাঁ— ‘ফিশারমেন্স’। কায়দাদুরস্ত চেয়ার টেবিলে
বসে সমুদ্রদর্শন করুন, এবং রেস্তোরাঁর খাদ্যের মজা নিন।
কিন্তু
জাফার নিজস্ব সুঘ্রাণ পেতে হলে আপনাকে ফিশারম্যান্স ছাড়িয়ে আর-একটু এগিয়ে যেতে হবে।
পোর্ট যেখানে শেষ হয়-হয়, একটি রাস্তা বাঁ দিকে বেঁকে শহরে ঢুকেছে— ঠিক সেখানে পুরোনো
নৌকা মেরামতের একটি ইয়ার্ডের উল্টোদিকে একটি নামহীন ইটিং জয়েন্ট। সামনের দিক তার পুরোটাই
খোলা।
ঝুলকালি
তেলচিটে অন্ধকার ভিতরের কিচেনে। সকালের শিফ্ট সেরে সেখানে ভিড় জমিয়েছে ক্লান্ত মাছধরিয়ে
আর বোটচালকের দল। ঘর্মাক্ত শরীর থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের মায়াবী সুঘ্রাণ। উঁচুগলার
কথাবার্তা আর হাস্যরোলে গমগম করছে চারধার। গত পাঁচ হাজার বছর ধরে ওরা এরকমভাবেই রোজ
সকালের শিফ্ট সেরে ফিরে আসে, দুপুরের খাবার খায়, বেসুরে গলা ছেড়ে গান ধরে, তারপর আবার
ফেরে। সাগরের টানে বড়ো জোর। এড়ানো দায়।
পোর্ট
থেকে বেরিয়ে গিয়ে বসলাম ওল্ড জাফার আলাদিন রেস্তোরাঁয়। ‘আলাদিন’কে পদধূলিধন্য করার
কারণ টেরাস থেকে পাওয়া মারাত্মক ভিউ। পাশে চোখ পড়লে দেখা যায় দ্বাদশ শতকের জাফার পুরোনো
মসজিদ। উত্তর দিশায় দিগন্ত দখল করে রয়েছে তেল আভিভ শহরের স্কাইস্ক্র্যাপার অরণ্য। এক
হাজার বছরের ইতিহাসের এই ব্যবধানের মধ্যে শরীর এলিয়ে সেতু হয়ে রয়েছে এক মাইল দীর্ঘ
সাগরবেলা।
এহেন
স্বর্গীয় দৃশ্যপট যখন চোখে নেশা হয়ে লেগে যাচ্ছে, মেনু নিয়ে এল ক্যাথি। সে আর তার স্বামী
ড্যান ইটিং জয়েন্টটি চালায়। হোয়াইট ওয়াইন আর জাফা স্পেশ্যাল চিকেন স্যালাড নিয়ে জুত
করে বসলাম। বিল মেটানোর সময় ক্যাথির হাতের অদ্ভুত ট্যাটুখানি চোখে পড়ল। বিশ শেকেল টিপ
পেয়ে সে মেয়ের মেজাজ হেব্বি খুশ ছিল। ছবি তো তুলতে দিলেই, উল্টে জিজ্ঞেস করলে— “বলো
দিকি, কী মানে এই ট্যাটুর?”
বিস্তর
মাথা ঘামিয়েও যখন সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলুম, তখন সে বললে, “ইট ইজ অ্যাকচুয়ালি ইটারনিটি
বাট উইদাউট মোমেন্টস। ডোন্ট ইউ ওয়ান্ট টু বি আ পার্ট অফ ইটার্নিটি হ্যোয়ার মোমেন্টস
ক্যান নট পুট ইওর এক্সিস্টেন্স ইনটু চেইনস? হু ডাজ নট?”
মুহূর্তহীন
অনন্তের খোঁজ? যেখানে অস্তিত্বের বহমানতা মহাকালের রথচক্রের সমান্তরাল, কেমন সে অনুভব?
সমুদ্রের
দিকে চোখ ফেরাই। ভূমধ্যসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। আকাশে অলৌকিক মেঘের দল। আমার
চোখে ভেসে উঠছে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের বাড়িখানি। বাবা-মা বসে গল্প করছেন।
বাড়ির ছাদের উপর বুঝি এমনই মেঘ ঘনিয়েছে। আমার ঘরে বিছানাটি একলা পড়ে রয়েছে। ওই বিছানায়
বালিশে বুক দিয়ে উপুড় হয়ে আমি একসময় ‘উজান’ পড়তুম।
এমন
একখানি উপন্যাস বাংলায় লেখা হয়েছে বলেই আমি বারবার এই অনাদৃত দুঃখী শ্যামল জন্মভূমিটিতে
ফিরে আসার জোর পেয়েছি। এমন লেখার জন্য হাজার বার জন্ম নেওয়া যায় বুঝি, অথচ অবাক ব্যাপার
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একজন্মেই এই উপন্যাসটি লিখে বসে আছেন।
একগাদা
চরিত্র। কারও প্রতি কোনও পক্ষপাত নেই, লেখক শৈশব কৈশোরের ডাগর চোখদু’টি মেলে দেখে যাচ্ছেন
অদ্ভুত এই দুনিয়ার বুকে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের ম্যাজিক আর পাঠকের বুক খামচে-খামচে
উঠছে। সতর্ক দায়িত্বশীল বাবা একজন, নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখতে চেষ্টা করেন মাটির
বুকের পরিবার একখানি।
আঙুলের
ফাঁক দিয়ে তবু বেরিয়ে যায় বালুকণার দল। ভাই ভাইয়ের কাঁধে মাথা রাখে, আঁকড়ে ধরে মাতৃগর্ভের
সাথীকে। তবু সময় এসে ঠিক ছিনিয়ে নেয় হাতে রাখা হাতখানি। সময়। এ গল্পের অনুচ্চারিত নায়ক
সময়। মায়াম্যাজিকের ভাষা আর খুশিয়াল-মৌন-দুঃখী-উচ্চকিত চরিত্রের পুতুলখেলার ঘনঘটার
আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া নায়ক আসলে সেই সময়-নৌকার উদাসীন মাঝি। তার নৌকো বয়ে যায় কালের
স্রোত বেয়ে, জন্মমৃত্যুর ঘাটে ঘাটে থামে খানিক। সওয়ারি ওঠে, সওয়ারি নামে। শীর্ষেন্দু
মুখোপাধ্যায় অপাপবিদ্ধ দৃষ্টিতে অপলক দেখতে থাকেন সেইসব ওঠানামা, নৌকোর গায়ে সময়ের
ছোটো ছোটো ঢেউয়ের ছলছলাৎ। ‘ইটার্নিটি উইদাউট মোমেন্টস’। বালুকণা শূন্য অলৌকিক এক বালিঘড়ি
নিজেকে জানান দিচ্ছে অহরহ।
মানুষ
জন্মায়, বড়ো হয়, বুড়ো হয়। সবুজ এই একলা গ্রহের খুঁতো যাপনের মধ্যে তবু জীবন নিজের মতো
খুঁজে নেয় পায়ে চলা পথ। আসলে এই বই নিয়ে লেখার কিছু নেই, এই বইটা যে আদৌ লেখা হয়েছে
এটাও একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। জীবনকে যদি উদাসীন আদরে কখনও অক্ষরে কেউ ধরতে চান, তাঁকে
মনে রাখতে হবে সে-কাজ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নামের এক ম্যাজিশিয়ান বাংলা ভাষায় করে
দেখিয়েছেন ইতোমধ্যেই।
‘উজানে’র
কথা ভাবতে ভাবতে আমি সাগরের দিকে তাকিয়েছিলাম এক মনে। দূরে, বহুদূরে সাগর আর আকাশের
নীল মিশে গিয়েছে। সেখানে একঝাঁক উড়ন্ত পাখি দেখা যাচ্ছে। ক্যাথি যদি বাংলা জানত তবে
ওকে ‘উজানে’র কথা বলতুম। আর দেখাতুম ওই পাখিগুলোকে। বলতুম, ‘জানো ক্যাথি, আমরা কেউ
পাই না-পাই ওইসব সমুদ্রবলাকারা নির্ঘাত পেয়েছে মুহূর্তহীন অনন্তের সন্ধান।’
_________
বাহ্ খুব সুন্দর লাগল পড়ে।
উত্তরমুছুন