সখী, আইপিএল কারে কয়? সে কি কেবলই ধামাকাময়? - রণদীপ নস্কর
২০০৩ সালে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের মাথা থেকে যখন টি-টোয়েন্টি নামক ক্রিকেটের এক মিনি-ভার্সনের বুদ্ধিখানা বেরোল– দূরদর্শী হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের কেউই নিশ্চয়ই কল্পনা করেননি, কুড়ি বছর পরে কুড়ি-বিশের ক্রিকেট এমন করে গোটা পৃথিবীতে জাঁকিয়ে বসবে; দু-বছর অন্তর অন্তর বিশ্বকাপ হওয়া ছাড়াও একাধিক দেশে নিয়ম করে সারাবছর চলবে নিজস্ব ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ। ক্রিকেটের যে সংস্করণ এসেছিল নেহাতই কাউন্টি ক্রিকেটের একঘেয়েমি থেকে দর্শকদের সাময়িক মুক্তি দিতে; ঠাসা সূচির মধ্যে একটু তাজা ‘ফিলার’-এর ভূমিকায়–অচিরেই সেই সংস্করণ হয়ে উঠল ক্রিকেট খেলাটির অন্যতম প্রতিনিধিস্থানীয় সংস্করণ। এবং, এর জন্মলগ্নে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক কলিন অ্যাগার যে বিশেষণটি হয়তো অজান্তেই ব্যবহার করেছিলেন, তার যাথার্থ্য ২০২৩-এর পৃথিবীতে এসে আইপিএলের দিকে তাকালেই দিনের আলোর মতো বোঝা যাবে। অ্যাগার টি-টোয়েন্টিকে বলেছিলেন, ‘তিন ঘণ্টার স্পেকট্যাকল’।
স্পেকট্যাকল– এই শব্দটার সঙ্গে কোভিড-পরবর্তী দুনিয়ায় আমরা অনেকেই পরিচিত; বিশেষত, যাঁরা নাটক-সিনেমার নিয়মিত দর্শক। অতিমারীর পর প্রাক-কোভিড সময়ের মতো মানুষকে কীভাবে আবারও হলমুখী করা যায়, সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রায়শই নির্মাতারা একটা শব্দ ব্যবহার করেন: স্পেকট্যাকল। অর্থাৎ, দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমের সারবস্তুর ওপরে চাপাতে হবে আরও খানিক আড়ম্বরের পোঁচ। যে ভয়াবহতা মানুষ পেরিয়ে এসেছে, তারপর তারা জীবন অতিক্রম করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জিনিসপত্র পর্দায় দেখতেই পছন্দ করবে; তার দৈনন্দিনতার বাস্তবানুগ প্রতিচ্ছবি নয়। কোনও ভ্যালু জাজমেন্টে না গিয়ে ‘জন উইক ফোর’ এবং ‘ভিড়’ এই সিনেমাদুটির কলকাতায় ব্যবসা দেখলেই পুরো ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। কাজেই, কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতে মানুষের নজর কাড়তে গেলে তাদের সামনে পেশ করতে হবে এমন কিছু, যা তুলনারহিত বিনোদনে মানুষকে ঘণ্টা আড়াই নিমগ্ন করে রাখবে বাইরের পৃথিবী ভুলিয়ে–শাহরুখের ছবিতে মিনিট পাঁচেকের জন্য আসতে হবে সালমানকে, স্পাইডারম্যানের ছবিতে ফিরে আসতে হবে পূর্বতন দুই পিটার পার্কারকে। পণ্যের বহিরঙ্গের ঝলককে বাড়িয়ে তুলতে হবে কয়েকগুণ অথবা বাছতে হবে এমন একটি বিষয়, যা নিজগুণে দাবি করে এক বহুমাত্রিক জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থাপন।
এখন এই স্পেকট্যাকল শব্দের সঙ্গে বিশুদ্ধবাদীরা খানিক অন্তঃসারশূন্যতা জুড়ে দেন। যা অতিরঞ্জিত, যা সারবস্তুর চাইতেও নির্ভর করছে আনুষঙ্গিক ঝলমলে পৃথিবী নির্মাণের ওপর, তা-ই বৌদ্ধিক পরিসরেখানিক বা সম্পূর্ণই ব্রাত্য–এমন মনোভাব খুব একটা বিরল নয়। যাঁরা সনাতনী লাল বলের ক্রিকেটকেই খেলাটির সর্বোত্তম রূপ বলে মনে করেন, তাঁরা প্রায়শই টি-টোয়েন্টিকে তুলনা করে বসেন সার্কাসের সঙ্গে। সার্কাসের উচ্চকিত প্রদর্শন, উগ্রতা এবং চকচকে আলোর মাঝখানে দর্শকদের মনোরঞ্জন করার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত বিপজ্জনক ঝুঁকিপূর্ণ খেলাধুলো করা হয়– তার সঙ্গে বারবার নিক্তিতে ওঠে আইপিএলজাতীয় লিগ; স্ট্রেট ড্রাইভে ব্যাটারের মাথা কোথায় থাকল, বাংলার দলে আদৌ বাংলার খেলোয়াড় থাকল কিনা তা গৌণ হয়ে গিয়ে কেবল পড়ে থাকে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার শেষ ওভার, ঝাঁ-চকচকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং চকচকে মোড়ক। এভাবে ক্রিকেট ‘কৌলীন্য’ হারায় বলে প্রায়শই বিশুদ্ধবাদীরা সরব হন, ঠিক যেমন পাঠান কখনও ‘সিনেমা’ হতে পারে না বলে দাবি করেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের একাংশ। কিন্তু, এই উপসংহার কখনও এতটা একমাত্রিক হতে পারে না বলেই আমার ধারণা, এর মধ্যে রয়েছে আরও অনেক পরত। ক্রিকেটকে কি আর নেহাতই খেলার গুণমান দিয়ে বিচার করা সম্ভব? মহম্মদ শামি– সাম্প্রতিকে জাতীয় দলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পেসার– তাঁর উদ্দেশে তাঁরই সহনাগরিকদের থেকে ভেসে আসে ব্যঙ্গাত্মক ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি, খেলার মাঠেই। অর্শদীপ সিং ক্যাচ ফেললে তাঁকে দেগে দেওয়া হয় ‘খালিস্তানি’ বলে। কাজেই ক্রিকেট সম্ভবত আর ভারতের বুকে নেহাতই খেলাটির ব্যাকরণগত শুদ্ধতার গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই; ক্রিকেট, আমার মতে, ভারতীয় রাজনৈতিক পরিসরের একটা প্রিজম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিয়ালদা দক্ষিণ লাইনের দুপুরের ট্রেনে আলাপ হল একজনের সঙ্গে, পেশায় ঠিকাদার। আদপে মুর্শিদাবাদের মানুষ, কাজ করেন দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পল্লীতে। হাতে মোবাইল দেখে জিজ্ঞাসা করলেন সন্ধেয় কার খেলা। দিল্লি বনাম মুম্বাইয়ের খেলা শুনে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন মুম্বাই জিতবে (সেদিন মুম্বাই জিতেও গেল), এবং এবছরের আইপিএলের সম্ভাব্য দাবিদার, তাঁর মতে, চেন্নাই-কলকাতা-মুম্বাই– এই ত্রয়ের কোনও একটি দল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি জানেন টিম বানিয়ে টাকা জেতা যায়?’ আমার উন্নাসিকতার গালে একটি সজোর কশাঘাত পড়ল, ‘জানি। আমি তো জিতেওছি, পাঁচশো-হাজার; হেরেওছি’। একগাল হেসে গড়গড় করে কেকেআরের নতুন বিদেশি কারা, কাদের জায়গায় তাঁরা এসেছেন সব বলে গেলেন। কেবল টিম বানিয়ে টাকা জেতার মোহেই তিনি ঠোঁটস্থ রেখেছেন প্রতিটা টিমের হাল-হকিকত; ক্রিকেটপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আচমকাই বড়লোক হয়ে যাওয়ার হাতছানি। আইপিএল– ঝাঁ-চকচকে রাংতায় মোড়া এক জগৎ যেখানে ক্রিকেট নেহাৎই সমগ্র প্যাকেজটার একটা অংশমাত্র– এই মানুষগুলোকে বছরের দুটো মাস এক সন্ধেয় দশ-রোজের উপার্জন পাইয়ে দিতে পারে।ক্রিকেট এদেশে ধর্ম, আইপিএল এদেশে উৎসব। জার্মান বুড়ো বলেছিলেন ধর্ম আফিম, রাষ্ট্রের শাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য মোক্ষম হাতিয়ার; পাশাপাশিবলেছিলেন ধর্ম নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাসও বটে। যে মানুষ কোথাও আশ্রয় পায় না, ধর্ম তার কাছে বটগাছের মতো বিস্তৃত শরণ। কেবলই আইপিএল স্ক্রিপ্টেড, গঙ্গার দিক থেকে সকাল সাড়ে ন-টার হাওয়া মেখে লাল বল অফস্টাম্পে ঢুকে না এলে সে খেলা ক্রিকেট পদবাচ্য নয়, এমন বলে হয়তো আইপিএল তুলে দেওয়ার কথা ভাবা যাবে; কিন্তু তারপর? ট্রেনের এই মানুষগুলোর মতো লোকজনের মোহপাশ একরাতে কেটে গেলে এঁদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? প্রশ্ন আসতে পারে, আইপিএলের আগে কি ক্রিকেট এবং জুয়া কখনও মিশে যায়নি? কত খেলোয়াড়রাও তো ক্রিকেট-জুয়ার শিকার হয়েছেন, প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। হ্যান্সি ক্রোনিয়ের কথা কি ভুলে গেলে চলবে? ক্রিকেট নিয়ে কীভাবে লাগাতার বেটিং চলে, তার একটা আন্দাজ দিয়েছিল ‘জন্নত’। সেই ছবিটি কি তাহলে ভুল? আর তাছাড়া ভারতের জুয়ার ইতিহাস তো কেবল ক্রিকেটের উত্থানের সঙ্গে তৈরি হয়েছে এমন নয়–ভারতীয় মহাকাব্যের সব থেকে সৎ চরিত্রই সমস্ত খুইয়েছিলেন সর্বনাশা জুয়া খেলায়। ভারতের জুয়ার ইতিহাস এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সবিনয়ে বলি, এই সবই সত্যি। পাশাপাশি, এ-ও সত্যি, এখন টাকা লাগিয়ে বড়লোক হয়ে যাওয়ার পন্থাটি যেরকম সহজলভ্য এবং সহজ– তা আগে কখনও ছিল কি? এখন হাতে স্মার্টফোন, মোটামুটি ক্রিকেটজ্ঞান এবং ইচ্ছে থাকলে যে কোনও মানুষ যে কোনও সময়ে জুয়ার অ্যাপে নাম লিখিয়ে খেলা শুরু করতে পারেন। মাত্রায় হয়তো তা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের তুল্য নয়, কিন্তু জুয়া তো বটেই। এবং, মজার ব্যাপার, সরকারিভাবে মানুষকে জুয়া খেলতে মদতই দেওয়া হচ্ছে বলা চলে।
কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ যখন এদেশে প্রত্যেকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে, সে-সময়কার দৃশ্যগুলো আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। পূর্ব দিল্লিতে ড্রোন শটে একটা ছবি তোলা হয়েছিল, নদীর ধারে সার দিয়ে জ্বলছে চিতা, পুড়ছে শব। গোটা দেশ তখন পরিণত হয়েছিল একটা বিশাল চুল্লিতে, যে চুল্লির আগুন কিছুতেই নিভছে না। সেই অবস্থায় ‘এই বিমর্ষ পরিস্থিতিতে আইপিএল তবু মানুষকে খানিক ভুলিয়ে রাখতে পারবে’ মর্মে আইপিএল চালিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুম্বাইয়ে, আপাত নিশ্ছিদ্র জৈব-বলয়ের মধ্যে। বহু খেলোয়াড় জৈব-বলয়ের মধ্যে থাকতে না পেরে নাম প্রত্যাহার করে নেন, খেলা চলাকালীন অনেকে কোভিডে আক্রান্ত হন– তা-ও টুর্নামেন্ট থামেনি।সমীক্ষা বলছে এ দেশে জাতীয়স্তরে লোকসভা ভোটের পরই মানুষের অংশগ্রহণের নিরিখে স্থান পায় আইপিএল। কাজেই এই প্রতিযোগিতাকে তো উপেক্ষা করা চলে না কোনমতেই, বিশেষ করে, যাঁরা সমাজতত্ত্ব বা সমতুল বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন, তাঁদের তো এটা হালকা চালে দেখাই উচিত নয়। এক এক করে একটু আইপিএলের বিভিন্ন স্তর খতিয়ে দেখা যাক।
গত কয়েকবছরে ভারতের ভার্চুয়াল বিহেভিয়ারকে দুটো ঘটনা বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রথমটি হল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জিও-কর্তৃক ‘ডেটা-বিপ্লব’। ভারতীয়রা এর আগে সারামাসে যে পরিমাণ ডেটা খরচ করতে পারত, জিওর ‘কল্যাণে’ তা হয়ে দাঁড়াল একদিনের বরাদ্দ। অর্থাৎ এখন একমাসে পাওয়া গেল আগের তিরিশগুণ বেশি ডেটা। এখন সমস্ত প্রোভাইডার দিনে এক, দুই এমনকি তিন-চার জিবি অবধিও ডেটা দিয়ে দিচ্ছে। এই সময়ে ভারত থেকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী বেড়ে গেল কয়েকগুণ। প্রায় প্রত্যেকেই ফেসবুক, ট্যুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ অথবা ইনস্টা– এই চারটির কমপক্ষে যে কোনও একটাতে সক্রিয়ই বলা চলে। যে মানুষ বাস্তবে ক্ষমতাহীন, প্রভাবহীন হয়ে বেঁচে আছেন; তাঁর স্মার্টফোনটি তাঁকে আচমকা দিয়ে দিল সাম্রাজ্যের চাবিকাঠি। একটি প্রোফাইল সাজিয়ে নিয়ে তিনিও মতামত রাখতে শুরু করে দিলেন। এই অসংশয়িত ইন্টারনেট-সত্তা তাঁর মননে কেউকেটা হয়ে উঠল এবং দিনে দিনে তা বাড়ল বই কমল না। প্রোফাইলের আড়াল তাঁকে দিল তাঁর সমস্ত গূঢ়ৈষা পূরণের লাইসেন্স– সরাসরি অপছন্দের বিষয়কে খিস্তি, ইনবক্সের সন্তর্পণ স্পেসে খোলাখুলি অথবা সতর্ক কু-প্রস্তাব দেওয়া। এ যদি প্রথম সূচক হয়ে থাকে, দ্বিতীয় সূচক অবশ্যই ২০২০ এবং ’২১ এর কোভিডজনিত লকডাউন। মোটামুটি সমর্থ বাড়িতে দৈনন্দিন জীবনের অনেকখানি আবদ্ধ হয়ে পড়ল ইন্টারনেটে। ইন্টারনেটেই ক্লাস, পরীক্ষা, অফিস থেকে শুরু করে ভিডিও কলে তৈরি হয়ে গেল একাধিক ফিচার ছবি। যাঁরা প্রযুক্তিতে বিশেষ দড় ছিলেন না, তাঁরাও মোটামুটি ইন্টারনেটের দুনিয়ায় স্বচ্ছল হয়ে পড়লেন। কোভিড পরিস্থিতি মোটামুটি সামলে যাওয়ার পর আরেকটা যে বড়সড় বদল চোখে পড়ল, তা হল পাড়ার মোড়ে মোড়ে লটারির দোকান। অতিমারীতে সকলেরই অর্থনৈতিক অবস্থা বিপন্ন হয়েছে, ধ্বসে পড়েছে। কারুর চাকরি চলে গিয়েছে, কারুর বন্ধ হয়েছে ব্যবসা। এবং ইতিহাস সাক্ষী, অন্ধবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে এবং বিবর্তিত হয়েছে এহেন সংকটের সময়েই। লটারির চাইতে শর্টকাটে বড়লোক হওয়ার উপায় সাধারণের নাগালে আর কিছু আছে কি? ফলস্বরূপ, প্রতিটা মোড়ে একটা করে লটারির দোকান। হারানো স্বচ্ছ্বলতা ফিরিয়ে আনতে দেদার টিকিট কিনতে শুরু করেছে মানুষ; এদিকে ছাঁটাইয়ের পরে চাকরি নেই, বন্ধ ব্যবসা খোলার কোনও পথ জানা নেই।
ইন্টারনেটে আসক্ত দেড়শো কোটির জনতা এবং তাদের অর্থনৈতিক বিপন্নতার ফলে ভাগ্যের শরণাপন্ন হওয়া– এই দুইয়ের মেলবন্ধনের পরিস্থিতিতে আইপিএল হয়ে উঠল সরকারের ঢাল।আপনারা যদি মন দিয়ে আইপিএলের বিজ্ঞাপনগুলো দেখেন, সেখানে এক আশ্চর্য প্যাটার্ন দেখতে পাবেন। যাঁরা ভারতীয় টেলিভিশন নিয়ে পড়াশোনা করেন, তাঁরা বলেন নয়ের দশকে ভারতীয় টিভির বিজ্ঞাপনের একরকমের ন্যারেটিভাইজেশন বা আখ্যানীকরণ হয়েছিল। সহজ কথায় বলতে গেলে বিজ্ঞাপনের পণ্যের সঙ্গে একটা গল্প জুড়ে দেওয়া শুরু হয়েছিল। ধরা যাক, ওই সময়ের আগে একটা পারফিউম বিক্রি হচ্ছে (কথার কথা), সেই পারফিউমের বোতলে পরিমাণ কত, কতক্ষণ গন্ধ থাকে, কী কী ফ্লেভার– এসবই ছিল বিজ্ঞাপনের উপজীব্য। কিন্তু মোটামুটি নয়ের দশক থেকে এসবের পাশাপাশি দেখানো শুরু হল কীভাবে সেই পারফিউম মেখে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে। অর্থাৎ, পারফিউমটি সুগন্ধী হিসেবে কতখানি যোগ্য তা শুধু বিচার্য নয়, তা মাখার পর কী কী হতে পারে তাঁরও একটা আঁচ দিয়ে রাখা। ঠিক তেমনই আইপিএলের এখনকার বিজ্ঞাপনেও একটা মোড় ঘোরানো দিক পরিলক্ষিত হয় বলে আমার ধারণা। এখনকার আইপিএলের বিজ্ঞাপনে আমির খান বা যশপ্রীত বুমরা কোনও চরিত্রে অভিনয় করেন না; তাঁরা আসেন সরাসরি আমির খান বা যশপ্রীত বুমরা হিসেবেই। আমির খান ফ্যান্টাসি অ্যাপের বিজ্ঞাপনে শোনেন লাল সিং চাড্ডার ফ্লপ হওয়া নিয়ে খোঁচা; বদলে হার্দিক পাণ্ডিয়াকে ফিরিয়ে দেন ম্যাচ ফিক্সিংয়ের আঁশটে গন্ধমাখা শ্লেষ। চরিত্র নয়, তাঁরা আসেন তাঁদের আসল পরিচয়টা নিয়েই– ফলে সাধারণ দর্শকের কাছে আর জুয়ার অ্যাপের গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে না। ভারতবর্ষ আইকন কালচারের দেশ, আমির খান বা হার্দিক পাণ্ডিয়া বলে দিলে আর অ্যাপের শর্তাবলী কে পড়ে! আপনি খেলা দেখছেন, দেখতে দেখতে খিদে পেল? আপনাকে আপনার সোফা থেকে নামতেই হবে না, অ্যাপে অর্ডার করুন, সে একেবারে আপনার টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে যাবে স্ন্যাকস এবং ঠাণ্ডা পানীয়। খেলা থেকে চোখ সরাতে হবে না। আপনি ভাববেন ফ্যান্টাসি অ্যাপে টিম বানানো ঠিক হবে কিনা? রোহিত শর্মা, ভারতের তিন ফর্ম্যাটের ক্রিকেটের অধিনায়ক, নিজে এসে বলে যাবেন ‘সোচো মাত, টিম বানাও’। অর্থাৎ, ভাবনাচিন্তা আপনাকে করতেই হবে না, আপনি শুধু ডুবে থাকুন দুশো চল্লিশটা বলের রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারে, খাবার ডেলিভারি অ্যাপ কর্মী ছাঁটাই করল কিনা, আইপিএলের প্রতিটা টিমের শার্টে ফ্যান্টাসি অ্যাপ জ্বলজ্বল করতে শুরু করল কিনা তা নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর দরকারই নেই। প্রত্যেকের হাতে স্মার্টফোন এবং দ্রুত কিছু টাকা কামিয়ে নেওয়ার চিন্তা– এমতাবস্থায় আইপিএল তাকে দিয়েছে প্রশ্নাতীত ক্ষমতার ভ্রম এবং নিজের টিম বানানোর এক ছদ্ম-মালিকানার সুখ। কাজেই, কোন আপদে ভেবে মরে বাইরে কী হচ্ছে না হচ্ছে?
ইমেজ এবং ইনফর্মেশনের যুগে দেশের ভয়াবহতার ইমেজের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে আছে তিন ঘণ্টার স্পেকট্যাকল। প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণকারী দলগুলি থেকেই দর্শককে বলা হচ্ছে, তোমরা ভাবনাচিন্তাই কোরো না, চোখ সরিও না টিভির পর্দা থেকে– যা তোমার প্রয়োজন, সব পায়ের কাছে এনে রেখে দেওয়া হবে। কিন্তু, তোমাদের আইপিএল দর্শনে যেন বিন্দুমাত্র ছেদ না পড়ে। ইতিহাস থেকে খামচা মেরে অংশ মুছে নেওয়ার যুগে, অন্ধত্বকে দূরদৃষ্টির ওপরে বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার যুগে কতকগুলো মানুষকে ভাগ্যের কাছে নত থাকার জন্য প্রভাবিত করা হচ্ছে। এবং, এই গোটা ব্যাপারটায় সব থেকে কম যেটা ক্ষয় হয়, তা হল ক্রিকেটের কৌলীন্য। ক্রিকেট এখানে গৌণ, সমাজ তার অনেক আগেই ল্যাংটো হয়ে মাঝবাজারে পড়ে আছে। আপনি লাল বলের ক্রিকেটের গলা-ফাটানো সমর্থক হয়ে আইপিএল তুলে দিতে পারেন, আপনি আইপিএলকে কেবলই ক্রিকেটের পক্ষে ক্ষতিকারক ছাড়া আর কিচ্ছু না-ই ভাবতে পারেন; কতকগুলো লোক যে হাতে স্মার্টফোন নিয়ে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে অন্ধ জুয়াড়ি হয়ে পড়ছে এবং রাষ্ট্র তাতে সর্বোতভাবে মদত জোগাচ্ছে, আপনি নিশ্চিত আইপিএল তুলে দিলেই এঁদের জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে পড়বে? এই যে এতগুলো মানুষ হাতে মোবাইল পেয়ে নিজেদের ভাবতে শুরু করলেন হারুন-অল-রশিদ এবং তাঁদের চোখে ঝিকিয়ে উঠল সোনার মোহরের ঝলকানি— আইপিএল সরিয়ে নেওয়ার পর এঁরা যে রুক্ষ বাস্তবের মাটিতে পড়বেন; যখন একদিন-কা-সুলতানের স্বপ্নটি ভেঙে যাবে, তখন তাঁদের কীভাবে ফের ফিরিয়ে আনা যাবে মূলস্রোতে? কীভাবে দেওয়া যাবে স্বাভাবিক জীবন? মানুষের মানসিকতাই যে ভাগ্যাধীন হওয়ার মতো হয়ে গেল, অন্ধবিশ্বাস থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যেস তৈরি হয়ে গেল— আপনারা নিশ্চিত কেবলমাত্র ক্রিকেটের জাত যাচ্ছে বলে আইপিএল তুলে দিলেই রাতারাতি এইসব ঠিক হয়ে যাবে?
প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর…?
দারুণ লাগল।
উত্তরমুছুন