বীজ - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
বীজ
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
“অরুন্ধতী? ও লা অরুন্ধতী? নাইতে যাবি তো?”
বড়দির গলা। অরুন্ধতীর এই বড়োননদটি বেশ গ্রামভারী চেহারার
মানুষ। সম্প্রতি ছেলে হয়ে আরো মোটাসোটা গোলগাল হয়েছে। চৌধুরীপাড়ায় শ্বশুরবাড়ি।
“কী রে কানে খোল জমেছে? শুনতে পাস না?”
বড়দির গলাটা এইবার ঘরের ভেতর ঢুকে এসেছে। একচিলতে বারান্দা
ঘরের বাইরে। তার ওপর উঠে এসে দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি মারছে। উনুনের তলায় পেতলের
পাইপটা দিয়ে ফুঁ দিতে দিতে অরুন্ধতীর চোখে ধোঁয়ার জলের সঙ্গে অন্য একটু জলও চলে
এল। ছেলে হয়ে বড়দির শ্বশুরবাড়িতে প্রতাপ বেড়েছে। কাজের লোক রাখা হয়েছে একটা। তাকে
এসব কাজকর্ম এখন খুব একটা করতে-টরতে হয় না।
“দেখ না বড়দি, হতচ্ছাড়া
উনুন...” গলা ধরে এল অরুন্ধতীর। দেশের বাড়িতে কাঠের উনুনে দুটো কাঠিকুটো ফেললেই
গণগণে আগুণ ওঠে। আর এদেশের এই হতচ্ছাড়া কয়লা...
অতসী এসে উঁকি মেরে উনুনটার দিকে একনজর চেয়েই ফিক করে হেসে
ফেলল,
“উফ। মরি মরি। উনুন ভর্তি কয়লা চাপিয়ে তলায় কাগজের নুড়ো
জ্বেলেছেন। এভাবে সারাদিনে তোর উনুন ধরবে? দাদাটা যে
কোথেকে এই গেঁয়ো ভূতটাকে...”
“গেঁয়ো ভূত? আমাদের জলপাইগুড়ি
তোমাদের এই দেনগাঁ-র চাইতে অনেক বড়ো শহর।” অরুন্ধতী মুখ নীচু করে রেখেই রাগে গরগর
করে উঠল।
“হ্যাঁ সে তো বটেই। বাড়ি তো বেণেপুর। জলপাইগুড়ি সদর ছাড়িয়ে
বিশ মাইল। আমার মেজোবোনের শ্বশুরবাড়ি আমি জানি না? তার আবার শহরের গর্ব,
হুঃ। নে এখন সর। আঠারো বছরে মেয়ে, তাকে এখন উনোন ধরানো শেখাই। ঘুঁটে আছে ঘরে? ঘুটে? ওই দুখানা...”
বলতে বলতেই কথা থামিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়েছে অতসী, “ও দাদা, উঠে এসে দেখে যা, বউয়ের কী রূপ খুলেছে তোর!”
দ্বিজেন ধুতির ওপর পাঞ্জাবি গলাচ্ছিল। সাড়ে ছটায় ইশকুল বসে
যায়। সাইকেল করে যেতে আধঘন্টার ওপর সময় লাগবে। বাজে পৌনে ছ'টা। বোতাম আঁটতে আঁটতে বলে, “আবার কী হল?”
আর সেই বলতে বলতে বের হয়ে অতসীর দু'হাতে ধরা অরুন্ধতীর মুখটা দেখে হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়ল সে।
অতসীও হাহাহিহি করে হাসতে লেগেছে। তারপর উঠে গিয়ে বারান্দার দিকে ঝোলানো আয়নাটা
এনে অরুন্ধতীর মুখের সামনে ধরে বলে, “মুখপুড়ি, মুখে কয়লার কালি মেখে হনুমানের মা হয়ে...”
বড়ো ক্লান্ত লাগছিল অরুন্ধতীর। রাতে রুটি করা নিয়ে একচোট
হয়ে গেছে দ্বিজেনের সঙ্গে। ত্যাড়াবাঁকা আধপোড়া রুটি পাতে নিয়ে বসে একবার শুধু
বলেছিল,
“রুটিটাও ভালো করে গড়তে পারোনি? সারাটা দিন খেটেখুটে ঘরে ফেরা। এখন তবে আমি...”
কথাগুলো শুনে হঠাৎ তার গত ছ'মাসের একাকিত্ব,
দেশের বাড়ির ওই বিস্তীর্ণ দুনিয়া ছেড়ে এসে শহরবাজারের এই
একচিলতে ভাড়ার ঘরে সংসার,
হাজারো দায়িত্বের শেকল, তার সঙ্গে
মানিয়ে নেবার লড়াই এই সবকিছুর নির্যাস হয়ে একরাশ তিক্ততা এসে ভর করেছিল অরুন্ধতীর
গলায়।
“খেতে হবে না তোমায় আমার রুটি। চারবেলা ভাত খেয়ে মানুষ।
জন্মে কখনো রুটি দেখেছি চোখে? রুটি খাবার শখ তেমন
মেয়ে বিয়ে করে আনলেই পারতে! দেনগাঁয় মেয়ের অভাব ছিল?”
কথাগুলো বলতে বলতেই কেন যে অমন চণ্ডাল রাগ চেপে বসল তার
মাথায়! দ্বিজেনের সামনে থেকে থালাটা টান দিয়ে সরিয়ে এনে জল ঢেলে দিয়েছিল সে তাতে।
তাদের দুজনেরই আর খাওয়া হয়নি তারপর।
পাশে শুয়ে অনেক রাত্রে দ্বিজেন তাকে নিজের দিকে টেনেছিল।
অন্ধকারে কাছে এসে তার চুলে মুখ গুঁজে বলেছিল, “খিদে পেলে উঠে
মুড়ি খেয়ে নাও দুটো।”
অরুন্ধতী কোনো জবাব দেয়নি। বুক জুড়ে তখন তার একটা অবাধ্য
জেদ মাথা তুলছে। এ-মানুষের সঙ্গে এই অচেনা পুরীতে এমনভাবে ঘর করতে সে পারবে না।
ভোর ভোর ঘুম ভেঙে আবার, পাশে শুয়ে
অকাতরে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটার দিকে চোখ রেখে মনটা ভিজে গিয়েছিল অরুন্ধতীর। আহা
মুখটা শুকিয়ে গেছে রাত্তিরে না খেয়ে। যদি ইশকুলে বেরোবার আগে অন্তত দুটি ভাতে ভাত
ফুটিয়ে দেয়া যায়,
সেই আশায় অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে এসে উনুনটা নিয়ে পড়েছিল
সে। এমনিতে দ্বিজেনই ধরিয়ে দিয়ে যায় রোজ। আজ ভেবেছিল নিজেই...
আয়নায় মুখটা দেখে নিজের ওপরে একটু করুণাই হচ্ছিল অরুন্ধতীর।
পেছন থেকে দুই ভাইবোনের বাঁধভাঙা হাসির শব্দ, একটা ব্যর্থ
উনুন আর গাল ও কপালে কয়লার কালির একরাশ দাগ যেন শতমুখে তাকে বলছিল, “হেরে গেছিস। হেরো...”
বড়োবৌদি ভুল কিছু বলত না। তার রোজকার গঞ্জনাগুলো বারংবার
কানে এসে বাজছিল এখন অরুন্ধতীর, “মর তুই আপদ। মরে হাড়
জুড়ো আমার। ভেবেছিস রূপের ঝুড়ি দিয়ে জগৎ ভোলাবি? ওরে আবাগি,
যার গলায় ঝুলবি, তার জীবন
অতিষ্ঠ করে ছাড়বি তুই,
আর নয়ত সারাজীবন আমার গলগ্রহ হয়ে...”
নাঃ। ও-বাড়িতে আর ফেরা নয়। তাছাড়া, চাইলেও তো একা চিনে যাওয়ার উপায় নেই। ট্রেনে এক রাত্রের রাস্তা।
মেজদা... না না,
সে ভারী লজ্জা। কাছেই থাকে। এ-মানুষ ও-বাড়িতে যায় তো মাঝে
মাঝে। চোখের ওপর সে জীয়ন্ত ঘোরাঘুরি করলে...
দ্বিজেন বেরিয়ে গেছে। না খেয়েই গেছে। উনুনটা ধরিয়ে দিয়ে
বড়দিও স্নানে চলে গেছে অনেকক্ষণ। গণগণে উনুনের পাশ থেকে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল
অরুন্ধতী। মুখের কালিঝুলি লেগেই রয়েছে। থাক গে, মা গঙ্গা সব
ধুয়ে নেবেন।
ফাঁকা ঘরটার দরজা হা হা করে খোলা। ভেতরে খাঁ খাঁ করে
জ্বলছিল উনুনটা। তার পাশে পেতে রাখা শিলের ওপর নোড়া চাপা দেয়া একটা কাগজে কাঁচা
হাতের লেখার ক'টি অক্ষর তার প্রাপকের আশায় চুপ করে জেগে থাকে...
“স্রিচরণেশু,
আমি চলিলাম। তুমি একটা ভাল মেয়ে বিবাহ করিবা। সে তোমাকে সুখে
রাখিবে।
অভাগিনি
অরুন্ধতী”
***
“অনু...”
মুখের ওপর ঝাপসা একটা মুখ ঝুঁকে রয়েছে তার। অরুন্ধতী চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল
একবার। একটা ছিটেবেড়ার ঘর। জানালার বড়ো বড়ো কচুগাছে রোদ পড়েছে এসে।
মুখটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বড়দি। তাকে তাকাতে
দেখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে।
“ভেবেছিলি ফাঁকি দিয়ে পালাবি তাই না? কিন্তু অতসী বামনি কাছে থাকতে সে অত সহজ কাজ নয়।
বাঁডুজ্জেঘাটে ডুব দিতে দিতে দেখি ও মা আঘাটায় লাল পাড় শাড়ি পরে ওটা কে ভেসে
যাচ্ছে! ভাগ্যিস জোয়ার ছিল। নইলে ভাটায় টেনে নিলে আজ আর...”
“বড়দি...”
দরজা থেকে ভারী গলাটা পেয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল হঠাৎ
অরুন্ধতীর। আর তারপরেই একই সঙ্গে একটা স্বস্তি আর হতাশা এসে চেপে বসল সমস্ত
সত্ত্বায়। সে নয়। মেজদার গলা। এ-ঘরটা তার চেনা। মেজদার ঘর।
বড়োননদ তার পাশ থেকে উঠে ঘোমটা টেনে দাঁড়ালেন। মেজদার
মুখটায় উদ্বেগ আর খুশি একসঙ্গে মিলেমিশে গেছে। কাছে এসে বড়দির দিকে হাতজোড় করে
ফিরে বলছেন,
“আপনার কাছে চিরঋণে বাঁধা পড়লাম দিদি। আজ আপনি না থাকলে
বোনটা আমার...”
বাকি কথাগুলো আর মুখ থেকে বের হচ্ছিল না তার।
“একটু বাইরে আসুন দাদা। কথা আছে,” বলতে বলতে বড়দি মেজদাকে ধরে বাইরে বের হয়ে গেলেন। একটা
ফাঁকা অনুভূতি এসে যেন গিলে খেতে চাইছিল অরুন্ধতীকে। মরতেও দেবে না তাকে এরা। আবার
সেই নিত্যদিনের গ্লানি। শহরের বুকে একচিলতে ঘরে আটকে থেকে...
আস্তে আস্তে একটা শক্ত প্রতিজ্ঞা গড়ে উঠছিল তার মাথায়।
দ্বিতীয়বার আর ভুল সে করবে না। ওখানেই যদি ফিরে যেতে হয়, তাহলে এইবার একদিন রাত্তিবেলা উঠে একলা একলা...
একটা কোমল হাত এসে তার কপালে ঠেকল হঠাৎ। শরীরটা একটু কেঁপে
উঠল অরুন্ধতীর। এ-ছোঁয়া সে চেনে। এবার? কোথায় পালাবে
সে? দুর্বল হাত দিয়ে হাতটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি পাশ ফিরে
চোখদুটো শক্ত করে বন্ধ করে শুয়ে রইল সে। লজ্জা? ভয়? অভিমান? তার অনভিজ্ঞ মন, বুকের ভেতর ওঠা তোলপাড়টাকে চিনতে পারে না। শুধু এইটুকু সে
টের পায় ওই বিষামৃতে ভরা স্পর্শে বড়ো কষ্ট হয় তার।
***
নিঃশব্দে চৌকিটার পাশে একটা হাতলভাঙা চেয়ারে বসে রইল দ্বিজেন। স্কুলে
খাওয়াদাওয়া ছিল আজ। কিছু মুখে তুলতে পারেনি সে। বলেছিল, “খিদে নেই। আমি বরং আমার শেয়ারটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে...”
হেডমাস্টারমশাই মুচকি হেসেছিলেন জবাবে। বলেছিলেন, “আরে ইয়াংম্যান ওসব অজুহাত না-ই বা দিলে। আমরাও একদিন নববিবাহিত ছিলাম হে! গুড
ওল্ড ডেজ। পেট ভরে খাও তারপর বৌমার জন্য ছাঁদা বাঁধবার দায়িত্ব আমার।”
খেতে পারেনি সে। দুজনের ভাগের মাংস ভাঁড়ে নিয়ে, কলাপাতায় খানিক পোলাও বেঁধে সাইকেলে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরেছিল
হাওয়ার বেগে প্যাডেল করে। বারো মাইল পথ। সে-খাবার বাড়িতে পড়ে আছে। হাতের মুঠোয়
অরুন্ধতীর চিঠিটা দলা করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। স্ত্রীর পত্র। প্রথম চিঠি।
মেজদির শ্বশুরবাড়ি গিয়ে প্রথম অরুন্ধতীকে দেখেছিল দ্বিজেন।
খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো একটি পাখির মতই একটা অদ্ভুত গান গাইতে গাইতে ফিরছিল।
কলিটা দ্বিজেনের মনে আছে,
মই হইনু আবোলা নারী ডিহির বান্ধা জল...
ভালো লেগেছিল। মেজদির তা নজর এড়ায়নি। ছোটো এলাকা। সবাই
সবাইকে চেনে। বলেছিল,
“মেয়েটা কষ্টে আছে রে। বাপ-মা নেই। দাদার সংসারে থাকে। ওর
আরেক দাদা তো তোদের ওখানেই মিলে কাজ করে। নাম সুগত। চিনিস?”
হ্যাঁ। সুগতকে দ্বিজেন চিনত। গভীরভাবেই। এই দেনগাঁ-তেই বাসা
করে থাকেন। রেলপাড়া গ্রামের দিকে। বিয়েথা করেননি।
ওর পর আর সমস্যা হয়নি। পালটি ঘর। অরুন্ধতীর দাদাবৌদিও এক
কথায় রাজি। শুধু দেয়াথোয়া কিছু করতে পারবেন না সে কথা পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন।
দ্বিজেন চায়ওনি কিছু। প্রাইমারি ইশকুলের মাষ্টার। সে-ই বা কোন লাট-বেলাট। বাইরে
সুগতদা আর বড়দি দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। দ্বিজেন উঠে গিয়ে দাঁড়াল সেখানে। তাকে দেখে
সুগত মুখ তুলে চাইলেন।
“কী করি বলুন তো সুগতদা? যতটুকু সাধ্য
সে তো করছি। তবু... মেয়েটা তিন মাসে কেমন শুকিয়ে গেল। অত সুন্দর গানের গলা। কিন্তু
তিন মাসে,
জানেন, গানের একটা কলি
বেরোয়নি গলা থেকে। শুধু বলবে এই বাড়িতে আমার দম আটকে যায়। তুমি গাঁয়ের দিকে খানিক
জমি নিয়ে... আচ্ছা আপনিই বলুন তো দাদা, মাস্টারি করে
ক'টা টাকা পাই হাতে যে জমি কিনব? কাল রাতে রান্না নিয়ে খানিক রাগারাগি করেছিল। তারপর সকালে
বড়দি আসতে খানিক হাসিমশকরাও হল দিব্যি। তারপর এ যে এমন একটা কাণ্ড করে বসবে...
“রাত্তিরে কিচ্ছু দাঁতে কাটেনি। একটু ভালো খাবার-দাবার নিয়ে
এসেছিলাম তাই। যদি খুশি হয়। তা এসে দেখি... এই দেখুন চিঠিও লিখে রেখেছিল একটা...”
চিঠিটা হাতে নিয়ে একবার সেদিকে, আর একবার দ্বিজেনের শুকিয়ে ওঠা মুখটার দিকে দেখলেন সুগত।
অনেক দেখেছেন তিনি জীবনে। তার সমস্ত বাঁধনের আনন্দ যন্ত্রণা দুটিকেই চেনেন
গভীরভাবে। একটা যন্ত্রণার পথ বেয়ে চলেছে যুবকযুবতী দুজন।
বড়ো একাকি বেড়ে উঠেছে দুজনেই। দ্বিজেনের বড়ো হয়ে ওঠা
দেশভাগের পটভূমিতে। দুই দিদির বিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে ছোটোবেলাতেই এদিককার হোস্টেল
পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাপ-মা। তারপর, এক দুঃস্বপ্নের
রাত্রে দেশভাগের দাঙ্গা এসে তাঁদের খেয়েছে।
আর এ-মেয়ের কপালও তথৈবচ। দূর সম্পর্কের আত্মীয় তাঁদের।
বাপ-মা মরতে বড়দার সংসারে মানুষ। বড়োবৌদি সুবিধের মানুষ নন কোনোকালেই।
ফলে,
যৌথ জীবনকে নিজের বলে বুঝতে শেখেনি দুটো একক সত্ত্বাই।
সুখকে সুখ বলেও চিনতে শেখেনি কোনোকালে। তার জন্যে তাদের কেউই দায়ী নয়।
তবু ওদের মধ্যে ভালোবাসার অস্ফুট বীজটিকে তিনি ছুঁতে
পারছিলেন। ওদের অজান্তেই বীজটির ভেতরে অঙ্কুর দেখা দিচ্ছে এখন। প্রকৃতির পথ। ওদের
আচরণে তাঁর অভিজ্ঞ চোখ সে-লক্ষণগুলোকে পড়ে নিতে পারছিল। সংঘর্ষ থেকে সযত্নে সরিয়ে
রেখে তাকে বেড়ে ওঠবার সময় দিতে হবে এখন।
খানিক বাদে শান্ত গলায় তিনি বললেন, “ভেবো না। ক'টা দিন
মেয়েটাকে বরং আমার কাছে এনে রাখি। গাঁ-গঞ্জ এলাকা। খোলামেলায় থাক। ঠিক হয়ে যাবে'খন।”
“সেই ভালো রে,” অতসী
দ্বিজেনের দিকে মুখ ঘোরাল,
“তুই বরং বিয়ের আগে যেমন আমার ওখানে দুবেলা খেয়ে যেতিস তেমনি
ফের...”
ম্লান হেসে মাথা নাড়ল দ্বিজেন, “না রে। আমি নিজেই সামলে নেব।” কেন যেন ফের একবার দিদির
সংসারে দুটি অন্নের জন্য ফিরে যেতে একরাশ সঙ্কোচ তাকে গ্রাস করেছে তখন। নিজের বাড়ি
থাকতে....
২
বাড়িটা অনেকটা জায়গা নিয়ে। স্টেশন থেকে মাইলদুয়েক ভেতরে। একপাশে পুকুর আছে
একটা। তাতে মাছ ঘাই দেয়। উঠোনের খানিক জায়গা খোলা রেখে দুপাশে, পেছনে সবজির ক্ষেত।
বারান্দার এক কোণে কাঠের জ্বালে ভাত হয়ে এসেছিল। হাঁড়িটা
তুলে তার ফ্যান গালতে গালতেই একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সে ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখল
একবার। দাদাটা বড়ো অগোছালো মানুষ। যত গুছিয়ে রাখো, তত এলোমেলো করে সবকিছু ছড়িয়ে ফেলবে! অথচ ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখলে এ-ঘরে জায়গা কম
নাকি?
বেলা চড়ছিল। দাদার মর্নিং শিফটে ডিউটি আজ। ফেরার সময় বাজার
করে নিয়ে ঢুকবে। তখন বাকি রান্না। বাইরে রোদ উঠেছে কড়া। আশ্বিনের রোদ। সেদিকে
একবার দেখে নিয়ে সে গলা তুলে ডাকল, “ভোঁদড়?”
“যাই দিদি।”
বছর দশেক বয়েস হবে ছেলেটার। দাদার কাছেই থাকে। ফাইফরমাশ
খাটে টুকটাক। রাতে দাদা ওকে পড়ায়। আজকাল সে-আসরে অরুন্ধতীও এসে বসছে।
সে আসতে আঁচল খুলে কটা টাকা তার হাতে দিল অরুন্ধতী। “ছুটে
যা। হারুর দোকান থেকে একটা ছুঁচ আর গুলিসুতো নিয়ে আসবি। আর দু'গজ লাল শালু।”
“আর আমি?”
অরুন্ধতী হাসল, “ঠিক আছে। একটা
মাছ লজেন্স।
তার বেশি নয়।”
ভোঁদড় অবশ্য তাতেই বেজায় সন্তুষ্ট। পয়সা হাতে নিয়ে টিটিটিটি
করে কী এক আজব সুর ভাঁজতে ভাঁজতে সে ভোঁ দৌড় দিয়েছে উঠোন পেরিয়ে সামনের রাস্তা
ধরে।
ঘরে ঢুকে দাদার তোষকটা বাইরে এনে রোদে দিল অরুন্ধতী। তাকে
চৌকিটা দিয়ে দাদা ওই পেতে মাটিতে শোয়। বর্ষায় মাটি থেকে ভাপ উঠে স্যাঁতসেঁতে হয়ে
এসেছে জিনিসটা। এখানে ওখানে ছেঁড়া। রোদ খাক এখন খানিক। তারপর ভোঁদড় ছুঁচসুতো, শালু আনলে ছেঁড়াফাটাগুলো ঠিকঠাক করে দিলেই হবে। অরুন্ধতী
আঁচলে বাঁধা অবশিষ্ট টাকাক'টাকে একবার ছুঁয়ে দেখে নিল। দ্বিজেন তার মাসখরচা দাদাকে
দেবে বলেছিল।
দাদা রাজি হয়নি। বলে, “নিজের বোনকে
খাইয়ে পয়সা নেব কি গো?
ও তো আমার ঘরে দুদিনের অতিথি।”
'দুদিনের অতিথি' শুনে অরুন্ধতী
মাথা নেড়েছিল শক্ত করে। দেনগাঁর গঙ্গার ধারের ওই একচিলতে নরকটাতে সে আর কিছুতেই
ফিরে যাবে না। তারপর থেকে মাসে দশটা করে টাকা তার হাতেই দিয়ে যায় দ্বিজেন। তার
হাতখরচ। অরুন্ধতী মানা করে না। বারবার দাদার কাছে হাত পাতবার দায় থাকে না ওতে।
তারই বা আর কতটুকু রোজগার! তার চাইতে যার দায় সে করুক না! ক্ষতি কী?
বাড়িটা নিঃঝুম হয়ে আছে। চালের ওপর তোষক রোদে দিয়ে বারান্দার
এক কোণে বসে চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল অরুন্ধতী। পুজো গিয়েছে সবে। বাতাসে
শেষ শরতের ছোঁয়া। কাল কোজাগরি। প্রকৃতিতেও তার প্রস্তুতি চলেছে।
“ছুঁচসুতো নিয়ে কী করবি রে?”
দাদার গলা শুনে হঠাৎ চমক ভেঙে ঘুরে তাকাল সে। দুটো বড়ো বড়ো
বাজারের থলে একপাশে নামিয়ে রাখতে রাখতেই সুগত হাসছিলেন, “ফিরছি তখন দেখি ভোঁদড় হাতে ছুঁচের পাতা, গুলিসুতো আর এই শালুর টুকরো নিয়ে ঘোষপুকুরে মাছ ধরা দেখছে।
আমায় দেখে বলে 'বদ্দাদা তুমি দিদিকে এগুলো দিয়ে দিও। আর, এই যে চল্লিশ পয়সা ফেরৎ।' হ্যাঁরে তোর দাদাটা কি তোকে একটা ছুঁচসুতোও কিনে দিতে পারে না? নিজের পয়সা দিয়ে...”
অরুন্ধতী অবশ্য তাঁর সে কথার কোনো জবাব দিচ্ছিল না। বাজারের
থলে দুটোর দিকে তখন তার চোখ গিয়েছে।
“তোমার তোষকটা একটু সেলাই করে দেব ভাবছিলাম। কিন্তু অত কী
বাজার করলে দাদা?”
সুগত হাসলেন, “উঠে এসে দেখ
একবার!”
অরুন্ধতী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে থলেদুটো খুলে দেখল। তারপর অবাক
হয়ে বলে,
“মরাই, লক্ষ্মীর পট, দশকর্মা, ফলফুলুরি, কদমা, খেলনা... তুমি...
হঠাৎ?”
“তোর দ্বারা সংসার করা আর হবে না। কাল কোজাগরি ভুলে গেলি?”
“তু-তুমি পুজো করবে বাড়িতে?” এবার অরুন্ধতীর অবাক হবার পালা। এ-বাড়িতে কোনো ঠাকুরদেবতা নেই। গত তিনমাসে
কখনো তার এই দাদাটিকে কোনো ঈশ্বরের নাম নিতে সে দেখেনি। কিছু বললে একগাল হেসে, ঘরের এক কোণে রাখা মোটা মোটা কয়েকটা লাল মলাট দেয়া বই
দেখিয়ে বলেছে,
ওই আমার ভগবান।
ফের মাথা নেড়ে হাসলেন সুগত, “আমি নয়। আমার আরেক বন্ধুর বাড়িতে পুজো হবে। সে-বেচারা নতুন বিয়ে করেছে। বড়ো
আশা করে ভিটেয় প্রথমবার পুজো করছে। কায়দাকানুন কিছুই জানে না। শেষে আমি বললাম, নিজে মানি ছাই না মানি, বামুনের ছেলে, নিয়মকানুন তো কিছু জানি। টাকাপয়সা নিয়ে বাজারটা করে আনলাম।
চল কাল আমরা ভাইবোন মিলে গিয়ে পুজো উঠিয়ে দিয়ে আসি গিয়ে। আসলে জানিস, যার যা বিশ্বাস সেইটে নিয়ে ভালো থাকলে ক্ষতি কী?”
বাড়ি! পুজো! নিজের অজান্তেই একটা ঈর্ষার ছায়া উড়ে গেল
অরুন্ধতীর চোখ বেয়ে। খানিক বাদে মাথা নেড়ে সে বলল, “কোথায় গো?”
“কাছেই। সোনারিপুকুরের ওদিকে খানিক জমি নিয়েছে। আমিই খোঁজ
দিয়েছিলাম। সস্তায় হয়ে গেছে। কাল চল। গিয়েই দেখতে পাবি।”
***
দিনটা ভারী সুন্দর। সোনারিপুকুরের পুব পাড়ে এই বাড়িটা একদম নতুন। ছিটেবেড়ার
দেয়াল। মাথায় টালি। গোবর-লেপা ঠনঠনে উঠোন। তার গায়ে কাঁচা হলুদ রঙের বিকেলের রোদ
এসে পড়ছে। কাঠাদশেক জমি। দেখলে হিংসে হয়। তার যদি এমন একটা...
আজ উপোস করেছে অরুন্ধতী। হোক না পরের পুজো। নিয়মকানুন তো
মানতে হয়। দুপুর দুপুর দাদা তাকে নিয়ে চলে এসেছিল এখানে। এসে অরুন্ধতী অবাক।
বাড়িতে জনমনিষ্যি নেই। দেখে খানিক অবাকই হয়েছিল অরুন্ধতী।
দাদা তার মুখের বাঁকা হাসি দেখে তাড়াতাড়ি বলে, “না রে, আসবে। আসলে আজ
একেবারে লক্ষ্মীপুজো করে তারপর গৃহপ্রবেশ করবে কি না! বোধ হয় তাকে বাপের বাড়ি থেকে
নিয়ে আসতে গেছে তার কর্তা।”
হবে হয়ত। তবু একটুখানি বিরক্তই হয়েছিল অরুন্ধতী। বলিহারি
বাই বাড়ির গিন্নির। নিজের ঘরে লক্ষ্মীপুজো তো নিজেরই দেখা নেই।
পরের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে...
উঠোন জুড়ে চালের গুঁড়োর পিটুলি দিয়ে আলপনা দেয়া সারা হয়ে এল
অরুন্ধতীর। বড়ো বড়ো পদ্মফুল এঁকেছে। লম্বা লম্বা লতা আর লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। ছাপ
দেখে দাদা একটু হেসেছিল অবশ্য। বলে, “ও কী রে?
মা লক্ষ্মী কেবল ডান পায়ে কিতকিত খেলতে খেলতে ঘরে আসবে বুঝি?”
ভুলটা বুঝতে পেরে অরুন্ধতী তাড়াতাড়ি আবার একটা করে পা মুছে
নতুন আঁকতে বসে।
হাত ধুয়ে বারান্দায় উঠে এল এবারে সে। ঘরের মালিকের দেখা নেই
এখনো। দাদার অবশ্য তাতে বিশেষ হেলদোল নেই। দিব্যি ঘরের ভেতর লক্ষ্মীর সরা বসিয়ে
পুজোর জোগাড় করছে। সুন্দর সাজিয়েছে সবকিছু। কলাগাছের খোলের নৌকোয় শস্যের মরাই। কলাপাতায় চাল
ভেজা,
কলা,
পাঁচরকম ফল। লক্ষ্মীর পটের সামনে একটা শাড়ি, আলতা সিঁদুর... একদম আসল পুজোর মত। তাকে দেখে মুখ তুলে বলে, “চন্দনটা একটু পিষে দিবি নাকি?”
পুবে গাছপালার আড়ালে থালার মত চাঁদটা মুখ বাড়িয়েছে। সেদিকে
একনজর দেখে নিয়ে কী মনে হতে অরুন্ধতী বলল, “দাঁড়াও, শাঁখটায় তিনটে ফুঁ দিয়ে দি আগে। এদের তো তুলসিতলা নেই।
প্রদীপ দেখাব কোথা কে জানে!”
দাদা হাসল, “সব হয়ে যাবে একে
একে।”
মাথায় ঘোমটাটা টেনে দিয়ে শাঁখটা হাতে নিয়ে গাল ফুলিয়ে ফুঁ
দিতে দিতেই হঠাৎ দরজার কাছে ছায়া পড়ল একটা। দাদা তাড়াতাড়ি সেদিকে মুখ তুলে তাকিয়ে
বলে,
“আরে দ্বিজেন যে! এস এস।”
শাঁখটা নামিয়ে রেখে মুখ ঘুরিয়ে দেখল অরুন্ধতী। বারান্দার
নীচে জুতো খুলে রেখে উঠে আসছে সে। হঠাৎ বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠল তার। ও তাহলে
ফের...”
ভয়টাকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে দ্বিজেন উঠে এসে তার দিকে তাকিয়ে
ফিক করে একটু হাসি দিয়েই দাদার দিকে ঘুরে বলল, “বেশি দেরি
হয়নি তো?
সন্ধের লগ্নে পুজো বলেছিলেন না দাদা?”
“উঁহু। দেরি হয়নি। এস। পুকুরে গিয়ে স্নান সেরে পোশাক পালটে
নাও। তারপর জোড়ে এসে বসে সংকল্প হবে প্রথমে...”
“যাই।”
বলে তার পাশ দিয়ে অন্ধকারে নেমে ডোবাটার দিকে চলে গেল
দ্বিজেন। যাবার সময় কী যেন বলবে বলে তার দিকে তাকিয়েছিল একবার। অরুন্ধতী চোখ
ঘুরিয়ে নিল।
নাঃ। কাঁদবে না সে। দ্বিজেনের দোষ কী? সে-ই তো চিঠি লিখে তাকে অনুমতি দিয়ে এসেছিল। শুধু একটাই
দুঃখ হচ্ছিল তার। দাদা তাকে আগে কিছু বলল না কেন? জানলে সে দ্বিজেনের নতুন সংসারে কিছুতেই এভাবে...
মুখ ঘুরিয়ে আঁচলে চোখদুটো একবার মুছে নিল সে। লোকটা একা একা
আগে আগে ঢুকে এসেছে। বউটা বোধ হয় এখনো পিছু পিছু রাস্তাতেই...
বাড়ির সীমানায় মেহেন্দির বেড়া। তার মধ্যে কাঠের ছোট্টো
দরজাটি। সেইটি ধরে বাইরের অন্ধকার রাস্তাটার দিকে তাকিয়েছিল অরুন্ধতী। অন্ধকারে
নিজের অজান্তেই বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল চোখের কোল বেয়ে। তখন হঠাৎ পেছন
থেকে দ্বিজেনের গলাটা ভেসে এল। কখন যেন অন্ধকারে চুপচাপ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে,
“কাকে খুঁজছ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে?”
ধরা পড়ে গিয়ে একটু অস্বস্তিতে পড়ল অরুন্ধতী, “না,
নতুন বউ...”
“হুম। শোনো। পুকুরে একটা ডুব দিয়ে, ভিজে শাড়ি পালটে এইটে পরে ঘরে এস। শিগগির...”
বলতে বলতেই একটা কাগজের প্যাকেট অন্ধকারে তার হাতে গুঁজে
দিয়েছে দ্বিজেন। মুখ ঘুরিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েছিল সে। কিন্তু তার আগেই অন্ধকারে
দুটো সবল হাত এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। দুটো আগ্রাসী ঠোঁট এসে তার না বলা কথাগুলোকে
থামিয়ে দিল। খানিক বাদে অন্ধকারের ভেতর দ্বিজেনের গলাটা ফিসফিস করে তার কানে কানে
বলল,
“নতুন আর কোথা পাব? একটাই পুরোনো
বউ। তার জন্যেই তো...”
আজ কোজাগরী। গেরস্তকে আজ সস্ত্রীক রাত জাগতে হয়। দাদার অবশ্য ওসব
রীতিনিয়মে ভক্তি নেই। পুজোটুজো সেরে খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে সে ছোটো ঘরটায় গিয়ে আরামে
শুয়ে পড়েছে। বলে,
“যাদের ঘর তারা রাত জাগুক গে। আমি ওসবে নেই।”
উঠোনে ডগডগে চাঁদের আলো। বেড়ার ওধারে বিস্তীর্ণ ধানের
ক্ষেতের বুকে সে আলোয় ঢেউ খেলছে। সেদিকে দেখতে দেখেতে অরুন্ধতী বলল, “এতগুলো টাকা...”
দ্বিজেন হাসল মিটিমিটি, “সব সুগতদার
জন্য,
বুঝলে? খুব সাহায্য করেছে।
কিছুতেই কথা শুনল না। নিজের বাড়িটা ব্যাঙ্কে মর্টগেজ দিয়ে টাকা তুলেছে। বলে “আস্তে
আস্তে ব্যাঙ্কের কিস্তি শোধ দেবে। তাহলেই হবে। যা করছি সে আমার বোনের জন্য। তাতে
তুমি কথা বলবার কে?”
এখন বছরপাঁচেক খানিক টানাটানিতে চলবে। ধারটা শোধ দিতে হবে
তো! সে যাক গে! তুমি খুশি কি না তাই বলো। এমন একটা বাড়িই তো চেয়েছিলে? তাই না?”
“হুঁ উ...”
উঠোনের ঠনঠনে আলপনা আঁকা মাটিতে শুয়ে পড়েছে অরুন্ধতী। লাল
শাড়িটিতে কোনো তরুণ ঈশ্বরীর মত দেখায় তাকে সেই চাঁদের রুপোলী আলোয়। ঘরের ভেতরের
অন্ধকার থেকে সেদিকে তাকিয়ে দেখছিলেন সুগত। দুটি মানুষ বড় সুখে ঘন হয়ে মিশে এক হয়ে
রয়েছে সেখানে। তাদের মাথায় আশীর্বাদের মত চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে। গুণগুণ করে গান
ধরেছে মেয়েটি। জীবনের গান।
একটা অদ্ভুত ফাঁকা ভাব ছড়িয়ে পড়ছিল তাঁর বুকে। দ্বিজেন তাঁর
বড়ো প্রিয় শিষ্য ছিল। এই উনসত্তর সালের গত কয়েকটা মাস জুড়ে উত্তরবঙ্গে একটা ঝড়
ঘনিয়ে উঠেছে। তার ঢেউ এসে লাগছে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ কলকারখানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অতিবামপন্থী সেই আন্দোলনে তলায় তলায়
নিজেদেরও জড়িয়েছিলেন সুগত ও দ্বিজেন। সেই পার্টির কাজেই উত্তরবঙ্গে গিয়ে যখন
দ্বিজেন তাঁরই বোনটাকে বিয়ে করে ফিরল তখন একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব জেগেছিল তাঁর মনে।
বিয়ে করেননি তিনি। সে তাঁর পথ নয়। প্রথম যৌবন বামপন্থার
সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। সে বাঁধন আর খুলবে না। সামনেই যুদ্ধ আসছে। রক্ত ঝরবে
অনেক। হয়ত তিনি নিজেও তাতে...
...সে হোক। তাঁর একটা জীবনের আর মূল্য কতটুকু। কিন্তু, সেই অনাগত রণাঙ্গণের বুকে, নিজের যথাসর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসার এই বীজটুকু তিনি ছড়িয়ে গেলেন। যুদ্ধশেষে, রণাঙ্গণের বুকে ফসল ফলাবার জন্য কৃষকেরও তো প্রয়োজন হয়।
অলংকরণ: প্রদীপ গোস্বামী
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন