প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর
প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান
তমোঘ্ন নস্কর
পশ্চিমের আকাশ তখনও ঘন নীলিমায় ঢাকা। সূর্য উঠতে তখনও ঢের দেরি। ভারী আকাশটার
দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মনে হয়, যেন মস্ত বড়ো কালচে-নীল চাদর গায়ে দিয়ে কেউ ঘুমোচ্ছে!
জেলেরা নাও ঠেলা শুরু করে। তাদের দিন সূর্য ওঠার আগেই শুরু হয়। চকচকে রোদ যখন ওঠে,
ততক্ষণে তাদের নৌকার খোল ভরে ওঠে রুপোলি শস্যে। আচমকাই শিঙার গম্ভীর ভারী ধ্বনিতে থমকে
দাঁড়াল তারা!
পূর্ব দিক থেকে সার সার কী যেন আসছে! আর সেই সঙ্গে
ঘন ঘন শিঙাধ্বনি। তাদের আলোয় লাল হয়ে উঠছে পূর্ব দিকের আকাশ। সূর্যদেব স্বয়ং অভিবাদন
জানাচ্ছেন তাদের।
সেই সঙ্গে জলের ভীষণ আলোড়ন বলে দিচ্ছে, বল্লভ
আসছে।
***
হ্যাঁ, বল্লভ। রাজা অগ্গুকের সেই কিংবদন্তি রণতরী, যা আরব নৌবাহিনীকে চিরতরে
স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
সেদিন পূর্ব দিগন্তে যে-রক্তিম আভা দেখা দিয়েছিল,
তা কেবল নতুন দিনের নয়— এক দীর্ঘমেয়াদি সংঘর্ষের অগ্নি-পূর্বাভাস। ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ।
স্থলপথ দিয়ে বারবার ভারতবর্ষের উপরে নেমে এসেছে খলিফার সেনাবাহিনী। কখনও ব্যর্থ হয়েছে,
কখনও ভারতের স্বাধীন রাজারা মাথা নুইয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। খলিফা-বাহিনীর বাপ্পা
রাওয়ালের হাতে যেমন পর্যুদস্ত ও মথিত হওয়ার কাহিনি আছে, তেমনই হলু শাহের মতো রাজাদের
মাথা নুইয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কাহিনিও রয়েছে।
রাজা অগ্গুক তেমনই একজন বীর শাসক, যিনি সুবিশাল
রণতরীর সম্মুখে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের সাহস দেখিয়েছিলেন। বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি
করার অছিলায় ভারতবর্ষে বহু আগে থেকেই নৌবহর প্রদর্শন করে এসেছিল আরবিরা। জরিপ করেছিল
ভারতবর্ষের নৌ-বাহিনীর পরিকাঠামো। কিন্তু সেই তাদেরকেই নাজেহাল করবে এঁরা, ভুলেও বুঝতে
পারেনি।
***
৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের সেই সকাল
রণতরীর কাঠে ঢেউয়ের ধাক্কা তীব্র থেকে তীব্রতর হল। রাজা অগ্গুকের দাঁড়িরা
দারুণ রণ-উন্মাদনায় ফুটছে। ক্রমশই বাড়ছে তাদের দাঁড় বাওয়ার গতি। আর অন্যদিকে বিশাল
আরবি নৌবহর যেন অনেকখানি শ্লথ। তবে কি তারা অন্য কোনও পরিকল্পনা করছে?
তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ ভেসে আসে মাস্তুলের উপর থেকে।
দড়িতে চড়চড় শব্দ ওঠে। নোনা জলের গন্ধ ছাপিয়ে একটি
তীব্র গন্ধ বাতাসে ভাসে।
ক্ষণিকের জন্য মুখোমুখি দাঁড়ায় দুই শক্তিশালী নৌবহর।
বল্লভি বংশের অধিপতি, তরুণ ও নির্ভীক রাজা অগ্গুকের রণতরী অপেক্ষাকৃত ছোটো। এতক্ষণে
বোঝা যায়, লাল বিচ্ছুরণের উৎস। কাঠ এবং তামার পাত দিয়ে তৈরি রণতরীতে সূর্যের আলো পড়ে
এমন অদ্ভুত বিচ্ছুরণ হচ্ছিল। এটি খানিকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও বটে, এই বিচ্ছুরণে শত্রু
বিভ্রান্ত হবে।
তুলনায় আরব খিলাফতের বহর ঢের শক্তিশালী। তাদের
শাল গাছের মতো বৃহৎ মাস্তুল আর পাল, সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসার চিহ্ন বহন করে চলেছে।
সৌরাষ্ট্রীয়দের এহেন শিশুসুলভ নৌকা দেখে তাদের মধ্যে কিঞ্চিত ব্যঙ্গের সাড়া পড়ল।
স্থির নিস্পন্দ রাজা অগ্গুক। প্রধান রণতরীর উঁচুতে
দাঁড়িয়ে বাতাসের গতি বুঝতে লাগলেন। ভালোমতোই জানেন তাঁর নৌবহরের সীমাবদ্ধতা। তাই,
সবটুকু নির্ভর করছে বাতাসের গতির উপর। বাতাসের গতি ও দিক যদি সহায় হয়, এই যুদ্ধ জেতা
অনেক সহজ হবে। তিনি যে-বিশেষ বস্তুটি জলে মিশিয়েছেন (যার উৎকট গন্ধে নোনা বাতাস চাপা
পড়ে গেছে) ওই জিনিসটি পূর্ণমাত্রায় কার্যকরী হবে তখনই, যদি বাতাস তার সহায় হয়।
রাজা অগ্গুকের রণতরীগুলি প্রথমে তির্যক ভঙ্গিতে
এগিয়ে গেল। কৌশল স্পষ্ট; এত বড়ো বাহিনীকে তারা সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না। তাই আরবি
বহরের কেন্দ্রীয় অংশকে দ্রুত বিভক্ত করে দেবে। তারপর তাদের ছোটো ছোটো তরণিগুলি দু’পাশ
থেকে আক্রমণ চালাবে। ছোটো হওয়ার দরুন তাদের গতি অনেক দ্রুত।
আরবি নৌবহর সারিবদ্ধ হয়ে প্রস্তুত হল। অগ্রভাগের
খাড়া মুষল সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি থাকল।
কিন্তু যতই কাছে আসতে লাগল, ততই অবাক হল তারা।
অগ্গুকের রণতরীর পাটাতনে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছে পাথর ছোড়ার যন্ত্র! কিছু বুঝে ওঠার আগেই
মুর্হুমুহু পাথরের আঘাতে গুঁড়ো হয়ে যেতে লাগল সব। পাল, মাস্তুল, সবই ভেঙে পড়তে লাগল।
বাধ্য হয়েই নৌবহরে থাকা পাথর-নিক্ষেপণকারীদের
নিরস্ত্র করতে আরবি নৌবহর থেকে শুরু হল তির-বৃষ্টি। খাটো তিরগুলি যোদ্ধাদের বর্ম ভেদ
করে আঘাত হানতে শুরু করল।
ততক্ষণে রণতরীগুলো পরস্পরের কাছাকাছি চলে এসেছে।
নৌযুদ্ধের রীতি হল বিপরীত রণতরীকে কাছে টেনে আনা, সেই সুবিধা অগ্গুকের রণতরীগুলির নেই,
কারণ তারা আয়তনে ছোটো।
আরবি রণতরী থেকে ছোড়া ‘কাঁটা দড়ি’র আকর্ষণ টান
টান হল। আরবি সেনারা রণতরী থেকে লাফানোর প্রস্তুতি নিল।
কাঠের সঙ্গে কাঠের ধাক্কায় প্রচণ্ড শব্দে সমুদ্র
যেন কেঁপে উঠল। আর ঠিক তখনই ঘটে গেল সেই ঘটনা। দাউ দাউ করে সমুদ্রবক্ষ থেকে উঠে এল
অগ্নির লেলিহান শিখা। মুহূর্তের মধ্যে দড়িগুলিতে এবং কাঠের আরবি রণতরীতে আগুন ধরে
গেল। তামার পাত থাকার কারণে অগ্গুকের রণতরীতে চট করে আগুন লাগল না। দ্রুতগতিতে দড়িগুলো
কেটে নিয়ে তারা রণতরীর পাল তুলে দিল। কখন যেন চুপিসারে অজস্র জেলেনৌকা এসে দাঁড়িয়েছিল
উল্টোদিকের আড়ালে! তারা শয়ে শয়ে ‘কাঁটা দড়ি’ ছুড়ে অগ্গুকের রণতরীগুলিকে টানতে লাগল
বিপরীত দিকে।
আর প্রকৃতির কী আশ্চর্য নিয়ম! হাওয়া বিপরীত দিকে
বইল। দারুণ বেগে রণতরীগুলো পিছু হটে গেল কিছুটা। অবশ্যই হিসাব তিনি কষেই রেখেছিলেন,
গরমের দুপুরের এই সময়টা ঝোড়ো এলোমেলো বাতাস বয়।
ঝপঝপ করে মানুষগুলো পড়তে লাগল সমুদ্রের বুকে।
কয়েকজন এসে পড়েছিল রাজা অগ্গুকের রণতরীতে, তাদেরকে পেড়ে ফেলতে বেশি সময় লাগল না।
আগুন নিভে গেল আস্তে আস্তে পরবর্তী আরবি রণতরীগুলো এগিয়ে এল। মুখোমুখি সংঘাত বটে কিন্তু
প্রথম আঘাতেই আরবিরা অনেকখানি স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। বেলা দ্বিপ্রহরে তলোয়ারে তলোয়ারে
ঝনঝনানি, বর্শার তীক্ষ্ণ আঘাতের শব্দ, আর যোদ্ধাদের চিৎকারে জলরাশি উন্মত্ত হয়ে উঠল
বটে কিন্তু সেখানে আরবির সংখ্যাই বেশি।
উপরন্তু রণতরীগুলির নীচে ছোটো ছোটো জেলেনৌকাগুলি
এসে দাঁড়িয়েছে। তীক্ষ্ণ বর্শা নিয়ে অপেক্ষা করছে জেলের দল। যারা রণতরী থেকে নীচে
পড়ছে, তাদেরকে চিরতরে সমুদ্র-বুকে শয়ান দিচ্ছে তারা।
বেলা যত বাড়ছিল, আরবিদের ক্ষমতা তত স্তিমিত হয়ে
আসছিল। মূল আরবি বাহিনীর অর্থাৎ স্থল-বাহিনীর কোনও সাহায্য তারা পাবে না, দিব্যি বুঝেছিল।
নিজেদের বাণিজ্য ও রণতরী ক্ষয় নয় হয়। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে
পারে চিন্তা করে, ক্রমশ পিছু হটতে থাকে তারা।
কুড়ি বছর পর, ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ
রাজা অগ্গুকের দীর্ঘ পক্বকেশ উড়ছে বাতাসে। সম্মুখভাগে সার দিয়ে আসছে আরবি
রণতরীর দল। মৃদু হাসি খেলে গেল তাঁর মুখে। সেই দিনের পর, দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে ভয়ে
তাঁর সৌরাষ্ট্র বন্দর এড়িয়ে গেছে তারা। তারা ভাবতেই পারেনি, নিঃশব্দে কত বড়ো বিপ্লব
ঘটে গেছে।
আরবি নৌবহর থমকে দাঁড়াল সৌরাষ্ট্রের কাছাকাছি
এসে। সম্মুখভাগের নৌবহর নয়, সহস্র নৌকার নিরেট দুর্গ!
সেদিনের যুদ্ধ দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মূলত এই
শক্তিশালী নৌবহরের সামনে টিকতেই পারেনি আরবি নৌবহর। খলিফা আল মাহাদি চিরতরে নৌপথে ভারতবর্ষ
আক্রমণের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করলেন। ভারতের লিপিতে অতি সাধারণ এক দেশীয় সম্রাট চিরতরে
অক্ষয় হলেন সমুদ্রাধিপতি নামে। বলা হত, সৌরাষ্ট্রের অনুমতি না নিয়ে কোনও বিদেশি জাহাজ
সুদীর্ঘ একশত বছর ভারতবর্ষে ঢোকার সাহস পায়নি। আমরা ভুলে গেছি এসব কথা, এসব কাহিনি।
ললিতাদিত্য, বাপ্পা রাওয়ালদের বিপুল স্থলশক্তির পাশাপাশি ভারতবর্ষের নৌবাহিনীও যথেষ্ট
শক্তিশালী ছিল— সে-কথা স্মরণ করা হয় না, অথচ এদেরই উত্তরসূরি কাহ্নোজি আংরে, কুনয়ালি
মারাকার-রা।
তাই, এঁদেরকে মনে করার জন্যই আমাদের এই প্রয়াস।
______________________________________________________________________________
প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলি পড়ুন:
প্রথম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post.html
দ্বিতীয় পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_13.html
তৃতীয় পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_20.html
চতুর্থ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html
পঞ্চম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html
ষষ্ঠ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post.html
সপ্তম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_12.html
অষ্টম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_19.html
নবম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html
দশম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html
একাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_88.html
দ্বাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_15.html
ত্রয়োদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_24.html
চতুর্দশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_30.html
পঞ্চদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post.html
ষোড়শ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_13.html
সপ্তদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_20.html
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন