গোলমেলে ঘড়ি
ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
নিলাম ঘরে ঢুকেই অমিতাভ টের পেল, ভিতরের আবহাওয়াটা আজ অন্যরকম।
অ্যারাটুন ব্রাদার্সের এই নিলামঘরে সাধারণত বিশ্বাস-বাবুই সেলারের কাজটা করেন। কদাচিৎ
তিনি না এলে তাঁর ছেলে সেলারের টেবিলে দাঁড়ায়। ছেলেটা একটু লাজুক, তাই বিশ্বাস-বাবুর
মত নিলামের টেম্পো তুলে দিতে পারে না ঠিকই, তবে মোটামুটি কাজ চলে যায় । কিন্তু আজ সেলারের
টেবিলে দাঁড়িয়েছেন সিনিয়র অ্যারাটুন। তাতে সমস্যা ছিল না, কিন্তু তিনি মাল খেয়ে যাকে
বলে একদম টাল হয়ে আছেন।
রবিবার সকালে নিলামঘরে বেশী ভিড় হয়। আজ
বুধবার সন্ধ্যার নিলামেও বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবাই উত্তেজিত। অমিতাভ পাশের
লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল -“দাদা আজ স্পেশাল কিছু হচ্ছে না কি?”
লোকটা বলল –“আরে বুড়ো আজ ক্ষেপে গেছে।
যাচ্ছেতাই কম দামে সব জিনিষপত্র ছেড়ে দিচ্ছে। কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ!”
এ কথাটা বোঝার আছে। রবিবারের নিলামের
নিয়ম হল যে বেচছে সে একটা মিনিমাম দাম বলে দেয়। সেই দামের কমে বেচা যাবে না। কিন্তু
বুধবারের নিলাম তা নয়। নিলাম ওয়ালা যে দামে ইচ্ছা বেচে দিতে পারবে। অবশ্য কম দামে বেচলে
নিলাম ওয়ালার কমিশনও কম হবে। কিন্তু এগুলো সাধারণত টাকা উদ্ধারের জন্য ক্রোক করা জিনিষ।
যা টাকায় বিক্রি হবে নিলাম-ওয়ালার পারসেন্টেজ কেটে বাকি টাকা পার্টি পাবে, সেই দিয়ে
ধার শোধ হবে। ইচ্ছে করে কম দামে ছেড়ে দিলে পার্টির সর্বনাশ।
নিলাম দেখতে থাকে অমিতাভ। বুড়ো অ্যারাটুন
একেবারেই আউট হয়ে গেছে। একটা চমৎকার গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের দাম বলল হাজার টাকা। সামনের
একজন বলল হাজার দশ। সঙ্গে সঙ্গে হাতুড়ি ঠুকে বলল, ‘ইট ইস ইওর স্যার’ সামনে থেকে দু
চার জন প্রতিবাদ পর্যন্ত করল, কারণ তাদের বিড করার সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয় নি। কিন্তু
সিনিয়র অ্যারাটুন ততক্ষণে তার পরের আইটেম, ছটা কফি মগের সেটের দাম বলছেন। উপস্থিত লোক-জনের
হাসাহাসি থেকে অমিতাভ বুঝতে পারল, এই কাণ্ড আগেও বেশ কয়েক বার হয়ে গেছে ।
সহসা অমিতাভর একটা কথা মনে হয়। এটা কি
সেই ঘড়িটা? দেখে চমকে ওঠে অমিতাভ। কি কাণ্ড!
এই বস্তুটা আজই নিলাম হবার কথা ছিল? হায় ভগবান! ঘড়িটার ক্রেতাকেও এক ঝলক দেখতে পায়
অমিতাভ। পরিচিত লোক, অবশ্য এখানে অনেকেই তার পরিচিত।
আরও কিছুক্ষণ নিলাম দেখে অমিতাভ, তবে
তার মন খারাপ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে নিলাম ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে।
পরদিন বেলা এগারোটার সময় বাগবাজারের একটা
বাড়ির সামনে দেখা যায় অমিতাভকে। পুরনো বাড়ি, তবে দেখে বোঝা যায়, মোটামুটি যত্ন-আত্তি
করা হয়।বাড়ির ভিতরে ঢুকলে একটা ছোট উঠান আর তার চারপাশে ঘর। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে
দুতলায়।
দুতলার চেহারাটা কিন্তু বেশ ঝাঁ চকচকে।
বাড়ির মালিক এসে দাঁড়ায় অমিতাভর সামনে।
-“আরে ভায়া! কি খবর? অনেকদিন পরে তোমার
দর্শন মিলল কিন্তু”।
মালিক মাঝারি উচ্চতার ফর্সা মানুষ। মাথায়
বিশাল টাক, পিছনে কয়েকটি চুল অতীতের স্মৃতি রক্ষা করছে। পরনে সাদা ফতুয়া পাঞ্জাবি।
মুখের ভাব ভীষণ ধূর্ত।
অসীম দত্ত। কলকাতার বড় কিউরিও কালেক্টারদের
মধ্যে একজন। এর একটা বিশেষত্ব আছে। ইনি অসম্ভব
সস্তা দামে বিচিত্র জিনিষ কিনে থাকেন। সত্যি কথা বলতে কি, সস্তায় না পেলে ইনি কোনও
আইটেমই কেনেন না। এই ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য
করে তাঁর বিরাট পড়াশোনা, শখের পিছনে অসম্ভব পরিশ্রম করার ক্ষমতা, বিরাট পরিচিতি। এছাড়া
আরও একটা কথা আছে। কোন কিউরিও সংগ্রহ করার জন্য তিনি যে কোনও রকম অসৎ পথ অবলম্বন করতে
পারেন।
এই বাড়ির দুতলায় একটি বড় হলঘরে গাদাগাদি করে রাখা
আছে মিং বংশের সময়কার চিনা চায়ের কাপের সেট, পুতুল উৎসবের জাপানী পুতুল- তা অন্তত তিনশো
বছরের পুরনো হবে, দামাস্কাসের ছোরা, মোগল আমলের ম্যাচলক গাদা বন্দুক, খাসিয়া সর্দারের
শিরোভূষণ, রাজা প্রথম ইম্যানুয়েলের সময়কার প্রিমেইরো খেলার পর্তুগিজ তাস, আরও কত কী!
অমিতাভকে দেখে অসীম দত্ত বেশ খুশি হয়েছেন
বোঝা গেল। সমঝদারদের কাছে নিজের সাফল্যের বিবরণ দিতে তিনি ভারি ভালবাসেন। কিন্তু তিনি
কিছু বলার আগেই অমিতাভ বলল -“কাল অ্যারাটুনদের ওখানে আপনাকে দেখলাম।”
-“আরে তুমি ওখানে ছিলে না কি? কি ভাগ্যিস কাল ও পাড়ায়
গিয়েছিলাম, কি পেয়েছি জান?”
-“জানি, সতের-শো বারো সালের জিনিষ, সমারসেটের
টমাস বুলকের তৈরি গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক। ও বস্তু গোটা দশেকের বেশী তৈরি হয় নি। উচ্চতায়
সাড়ে ছ ফুট, পুরো লেংথের সেকেন্ডস পেন্ডুলাম। টমাস বুলকের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব তার ঘড়ির
বাজনার আওয়াজ।”
অসীম দত্তের চোখে সন্দেহ ঘনিয়ে আসে। বলেন
-“এত কথা জানার তো কথা নয় তোমার?”
-“জেনে ফেলেছি, কী আর করি?”
-“কত দামে কিনেছি জান নিশ্চয়ই?”
-“মাত্র হাজার টাকা।”
অসীম দত্তের চোখে অসীম আনন্দ নাচতে থাকে।
-“হাজার টাকা, মাত্র হাজার টাকা! হাজার টাকায় একজোড়া ভাল জুতোও হয় না। সেই দামে টমাস
বুলক!! ও হো হো, অমিতাভ, আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।”
-“আপনার হিসাবে এই টমাস বুলকের কত দাম হওয়া উচিত?”
-“অমূল্য হে, অমূল্য! এই ঘড়ি দাম দিয়ে
কেনার মত লোক কম আছে। একটাই খুঁত, ঘড়িটা চলে না। অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম
না। টমাস বুলকের বাজনার আওয়াজই যদি না শোনা গেল, তাহলে আর কী রইল বল!”
-“কোনও ঘড়ির মিস্ত্রি কে দিয়ে চেষ্টা করতে পারেন তো?”
-“এতো পুরনো গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক সারাতে
পারবে এমন মিস্ত্রি কলকাতায় নেই। মাঝখান থেকে ড্যামেজ করে দিলেই চিত্তির। আমার গ্র্যান্ড
ফাদার ক্লকের মেকানিজম নিয়ে পড়াশোনা করা আছে, কিন্তু এই টমাস বুলক অন্য জিনিষ।”
-“আমি একটু চেষ্টা করে দেখব নাকি? ঘাবড়াবেন
না, কিছু লোকসান করব না। আসলে এই বিশেষ ঘড়ির ব্যাপারে আমারও কিছু জানকারি আছে আর কি।”
অসীম দত্তের মুখের চেহারাটা দেখবার মত
হল। একই মুখে খেলা করছে লোভ আর ভয়। সত্যি কথা বলতে কী একটা বন্ধ ঘড়ি আর একটা চালু ঘড়ির
মধ্যে দাম এবং কিউরিও ভ্যালু দুইয়েরই তফাত আকাশ পাতাল। কিন্তু সেই চেষ্টা করতে গিয়ে
যদি অমূল্য ঘড়িটার কোনও পার্টস ভেঙ্গে যায়।
অবশেষে লোভেরই জয় হল। অসীম দত্ত বললেন
-“কী জানো জানি না, কিন্তু তোমাকে ভরসা করি। দেখতে চাইছ যখন দেখো, কিন্তু প্লিজ যা
করবে সাবধানে কোর।”
অমিতাভ একটা স্ক্রু ড্রাইভার চেয়ে এগিয়ে
গিয়ে ঘড়ির সামনের ডালাটা খুলে ফেলল। ঘড়িটার
ভিতরে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে অবশেষে আবিষ্কার করল একটা সরু পিন দিয়ে কগ হুইলটাকে ঠেকিয়ে রাখা আছে। এরকম কিছু একটা হবে এটাই আশা করেছিল
অমিতাভ। পিনটা সরিয়ে দিয়ে ডালাটা বন্ধ করল সে। তারপর গম্ভীর ভাবে বলল -“দম দেয়া আছে
আশা করি। এইবারে চালিয়ে দেখুন তো।
ঘড়িটার পেন্ডুলাম দুলিয়ে দিতেই ঘড়িটা
চলতে শুরু করল। অসীম দত্তের মুখে একটা হাজার ভোল্টের হাসি ফুটে উঠল। বললেন -“তুমি যে
এত ভাল মেকানিক তা তো জানতাম না? খুব উপকার করলে, থ্যাংক ইউ ভাই।”
অমিতাভ গম্ভীর মুখে বলল -“ঠিক থ্যাংক
ইউ দিয়ে ছেড়ে দিলে হবে না। আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।”
এত দ্রুত যে কারও মুখের ভাব পাল্টাতে
পারে জানা ছিল না অমিতাভর। ভ্রু কুঁচকে অসীম বললেন -“কী বলতে চাও।”
অমিতাভ পিছিয়ে গেল না। বলল -“আপনার নিজের
স্বীকৃতি মতনই ঘড়ির দামটা এখন অনেক বেড়ে গেল। এর একটা অংশ আপনাকে শেয়ার করতে হবে।”
-“ঘড়ি সারিয়ে দিয়ে ঘড়ির দামের অংশ ক্লেম
করছ, অ্যাঁ? এ তো, ‘পালকি যার বৌ তার’ কেস দাঁড়ালো হে”। অসীম দত্তর গলায় হুমকির সুর
স্পষ্ট।
অমিতাভ ভয় পেল না। বলল -“আপনি ঘড়িটা অবিশ্বাস্য
কম দামে পেয়েছেন। এতে ঘড়ির মালিকের তো সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনার লাভের কিছুটা অংশ তারও
পাওয়া উচিত।”
-“আমার জীবনের মটোই তো সস্তায় দামী জিনিষ
কেনা। উপযুক্ত দাম দিয়ে জিনিষ তো সবাই কিনতে পারে। আর একবার কেনা জিনিষের দুবার দাম
দেয়া আবার কী ধরণের যুক্তির কথা?”
-“দেশের আইন আপনারই পক্ষে, কিন্তু দেখুন,
জীবনে একবার একটা পুণ্য কাজ না হয় করলেনই।”
-“তুমি পাগল হয়ে গেছ। আর তাছাড়া এটা হল
কেনাবেচার কথা পাপ পুণ্যের কথা আসছে কেন?”
-“আসলে এই ঘড়িটার একটা ইতিহাস আছে। এর
মালকিনকে আমি চিনি। অনেক বয়স, দেখার কেউ নেই, ভীষণ গরিব। এই ঘড়ির ন্যায্য দাম না হোক,
তার একটা ছোট অংশ পেলেও ওঁর শেষ কটা দিন শান্তিতে কাটবে। ওদিকে আপনারও তো লোকসান হচ্ছে
না। যা কিনেছিলেন তার থেকে অনেক দামী জিনিষই তো পেয়ে গেলেন”।
-“অ! এতক্ষণে বুঝলাম। মালিককে চেন, ফলে
তোমার কমিশন আছে, তাই তো?”
অমিতাভ অনেক কষ্টে রাগ আটকাল। হাজার হোক,
আইন সম্পূর্ণ অসীম দত্তের দিকে। যদি জয়া দিদার জন্য কিছু আদায় করা যায়, সেটা অনুনয়
বিনয় করেই করতে হবে।
-“অসীমদা, নিজের মায়ের নামে দিব্যি দিয়ে
বলছি, একটা পয়সাও আমি নেব না। বরং আপনি ইতিহাসটা একবার শুনুন। আমি নিশ্চিত, যে শোনার
পরে আপনি নিজেই ঘড়ির দামের একটা পার্ট শেয়ার করবেন।”
-“ইতিহাস শুনতে আমার কোনও আপত্তি নেই। বরং যুতসই ইতিহাস থাকলে ঘড়িটার মূল্য আরও বেশী হতে
পারে”।
-“অপূর্ব দাস জন্মেছিলেন ফরাসী চন্দননগরে
১৯০০ সাল নাগাদ। ভাল ছাত্র ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স পড়তে পড়তে,
বিপ্লবীদের চক্করে পড়ে যান। কেমিস্ট্রিতে যখন এম- এসসি পড়ছেন তখন আলাপ হয় হেমচন্দ্র
ঘোষের সঙ্গে। হেমচন্দ্র তখন সদ্য কারামুক্ত হয়ে আবার সংগঠন শুরু করছেন। হেমচন্দ্র ওঁকে
নির্দেশ দেন উচ্চ শক্তি সম্পন্ন বোমা বানানো এবং নিরাপদে সেগুলো ফাটানোর ব্যাপারে গবেষণা
করতে। এম-এসসি পাশ করে অপূর্ব দাস চন্দননগরের
ডুপ্লে কলেজে চাকরি নেন। এবং নিজের বাড়িতে গবেষণাগার বানিয়ে বিস্ফোরক সংক্রান্ত গবেষণা
শুরু করেন।
সেই সময় চন্দননগর যেহেতু ফরাসী শাসনাধীন
ছিল, ফলে ব্রিটিশ পুলিশ সেখানে কোনরকম খোঁজখবর চালাতে পারত না। আর চন্দননগরের বিপ্লবীরা
ফরাসী সরকারকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করতেন না, ফলে ফরাসী পুলিশও এই সব লুকিয়ে থাকা বিপ্লবীদের
নিয়ে মাথা ঘামাত না।
অপূর্ব দাস নতুন নতুন কায়দায় উচ্চশক্তি
সম্পন্ন বোমা তৈরি করতে লাগলেন আর সেই বোমা দিয়ে বিপ্লবীরা সারা ভারতে তোলপাড় লাগিয়ে
দিলেন। অথচ ডুপ্লে কলেজের এই সদা হাস্যময়, লাজুক, ছাত্রবৎসল অধ্যাপকটি যে সব নষ্টের
গোঁড়া এ কথা কেউ ভাবতে পারত না। চন্দননগরের এক মিষ্টির দোকানী ছিল বিপ্লবীদের সঙ্গে
তাঁর যোগসূত্র। বোমার অর্ডার ঐ দোকানের মালিকের
কাছেই আসত, আর বোমা গুলো মিষ্টির হাঁড়িতে করে কলকাতায় চালান হত। অপূর্বকে কেউই
চিনত না।
কিন্তু এই চমৎকার ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেল,
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ফ্রান্স দখল করে নিলো। মার্শাল দ্য গল ইংল্যান্ডে
পালিয়ে গিয়ে স্বাধীন ফরাসী সরকার গঠন করলেন। ওদিকে জার্মান প্রভাবাধীন ফরাসী সরকারকে,
বলা হত ভিসি গভর্নমেন্ট। এখন প্রশ্ন হল ফরাসী উপনিবেশগুলি কোন পক্ষ নেবে? মোটামুটি
সব কটা উপনিবেশই কিন্তু স্বাধীন ফরাসী সরকারের পক্ষ নিলো। আমাদের পন্ডিচেরির গভর্নর
‘লুই আলেক্সি এঁতিয়ে বভীন’, প্রথমে একটু দোনোমনা করে পরে ইংরাজ সরকারের চাপ খেয়ে স্বাধীন
ফরাসী সরকারকেই সমর্থন করলেন। শুধু তাই নয়,
তিনি এ ও ঘোষণা করলেন, ব্রিটিশ ভারতের অপরাধী যদি ফরাসী ভারতে লুকিয়ে থাকে, তাহলে তাদের
ব্রিটিশ পুলিসের হাতে তুলে দেয়া হবে।
এই ঘোষণায় বিপ্লবীরা পড়ে গেলেন বিপদে।
তবে অপূর্ব দাসকে বিশেষ কেউ চিনত না। তাই তিনি অত সহজে ধরা পড়েন নি। কিন্তু তিনি বোমা
বানানো বা বোমার অর্ডার নেয়া একেবারেই বন্ধ করে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে রইলেন।
এই করে বছর দুয়েক কেটে গেল ১৯৪৩ সালে
মঁসিয়ে বভিনের চন্দননগরে আসার কথা। অপূর্ব দাস দেখলেন রাজভক্ত প্রজা হয়ে নিজের উপর
থেকে সন্দেহ কাটিয়ে দেবার ভাল সুযোগ এসেছে। সবার সঙ্গে মিলে তিনি এক অভ্যর্থনা কমিটি
তৈরি করলেন। মঁসিয়ে বভিনের কিউরিওর শখ আছে বলে চন্দন নগরের এক দুস্থ সাহেবের কাছ থেকে
একটা প্রাচীন দামী গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক জোগাড় করলেন ওঁকে উপহার দেবার জন্য।
কিন্তু সব ফেঁসে গেল। মঁসিয়ে বভিন চন্দননগরে
এলেন না। ওদিকে যেসব বিপ্লবীরা মঁসিয়ে বভিনের উপর খাপ্পা ছিলেন তাঁরা অপূর্ব দাসের
রাজভক্তি দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। হয়ত তাদের কারো দেয়া খবরেই কয়েক দিন বাদে ফরাসী
পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিসের হাতে তুলে দেয়।
অপূর্ব দাসের বাড়িতে তখন খালি তাঁর সদ্যবিবাহিতা,
প্রায় কুড়ি বছরের ছোট স্ত্রী। গরীবের কন্যাদায় উদ্ধারের জন্য বছর খানেক আগে তাকে ঘরে
এনেছেন। পুলিস ধরে নিয়ে যাবার সময় বার বার বলে গেলেন, ঐ ঘড়িটাই যত নষ্টের গোঁড়া, ওটাকে
যেন আর কখনও না চালানো হয়। চালালেই খারাপ কিছু হবে।
ওঁর সেই স্ত্রী জয়া দাস গ্রাম সম্পর্কে
আমার দিদিমা হন। স্বামী ছ মাসের ভিতরে বৃটিশ জেলে যক্ষ্মা রোগে মারা যান। দুর্জনে বলে
পুলিশ ওঁর বিরুদ্ধে ভাল করে কেস না সাজাতে পেরে ওঁকে না খাইয়ে মেরে ফেলেছিল। কারণ ওঁর তৈরি বোমায় বহু সাহেব পটল তুলেছিল।
সেই থেকে জয়ার জীবন সংগ্রাম শুরু হল। জমা টাকা শেষ হলে বাড়ি বিক্রি, তারপর আত্মীয়
স্বজনের যৎসামান্য সাহায্য এই তেই বেঁচে রয়েছেন। ঘড়িটা কেন জানি বেচতে পারেন নি। আমি
অনেকবার ওঁর বাড়িতে গেছি। ঘড়িটা সেইজন্যই আমার এত পরিচিত।
এখন জয়া দিদার বাড়িওয়ালার টাকা দেবারও
ক্ষমতা নেই। কাজেই বাড়ির সমস্ত কিছুই নিলামে বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আপনার কাছ থেকে
ঘড়িটার ন্যায্য দাম না হোক, হাজার পঞ্চাশেক টাকাও যদি পান, শেষ কটা দিন অনাহারে কাটবে
না। প্লিজ অসীমদা, স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিধবাকে অন্তত এইটুকু দয়া করুন।”
অসীম দত্ত এতক্ষণ এক মনে গল্পটা শুনছিলেন।
এইবার তাঁর ভাবান্তর ঘটল। বললেন -“হুঁ, খুবই
দুঃখের কথা। কিন্তু আমার দিকটা তুমি দেখ। আমার কিউরিও কালেকশনের একটাই তো উদ্দেশ্য।
সস্তায়, আই রিপিট, সস্তায় ভাল কিউরিও কেনা। আমার কাছে এই ঘড়িটার দাম এই কারণেই এত বেশী
যে একটা দশ লাখ টাকার কিউরিও, আমি হাজার টাকায় পেয়েছি। সেটা একান্ন হাজার হলে তো আমার
আসল আনন্দটাই মাঠে মারা যায়। না হে, তোমার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। তবে তুমি বললে বলে
আরও শ পাঁচেক টাকা দিতে পারি। ব্যাস তার বেশী এক পয়সা নয়”।
লোকটার চরিত্র দেখে অমিতাভ স্তম্ভিত হয়ে
গেল। এ কি মানুষ না পিশাচ? মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে প্রস্তুত গালাগালির স্রোতকে অনেক কষ্টে
সামলাল সে। শুধু শুধু সম্পর্ক খারাপ করে লাভ নেই। বলল -“থ্যাংক ইউ অসীমদা। পাঁচশো টাকা
তোমায় দিতে হবে না। বরং চেষ্টা করব তোমার হাজার টাকাও ফিরিয়ে দিতে। তাহলে আশা করি তোমার
আনন্দ আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে। আমি চললাম।”
সিঁড়ি দিয়ে অমিতাভর সঙ্গেই নামতে থকেন
অসীম দত্ত। বলতে থাকেন -“আহা তুমি দেখছি রাগ করেছো। ভেবে দেখ…”
ওরা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ নামতে নামতেই
টমাস বুলকে বারোটা বাজার ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। সে এক স্বর্গীয় স্বর। পিয়ানোর সঙ্গে
কোন একটা অর্গানের মত বাদ্যযন্ত্র মিলে বাজানো কনসার্ট।
দুজনেই উৎকর্ণ হয়ে ঘড়ির বাজনা শুনছিল।
বাজনা থামার পর, উত্তেজিত অসীম কিছু একটা বলতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সমস্ত চাপা দিয়ে দিল
এক বিকট বিরাট বিস্ফোরণের আওয়াজ!
আওয়াজের চোটে কানে তালা লেগে দুজনেই কিছুক্ষণ
ঘোরের মধ্যে ছিল। একটা কুয়াশার আবরণে দুজনেই ঢাকা পড়ে গেল মনে হল। তার পরে বোঝা গেল
ওটা হচ্ছে কটু গন্ধ বিস্ফোরকের ধোঁয়া।
অসীম দত্তই আগে সম্বিত ফিরে পেয়ে উপরে
দৌড়লেন। পিছন পিছন অমিতাভ।
হলঘরটাকে আর চেনার উপায় নেই। প্রচণ্ড
বিস্ফোরণে সেই মিউজিয়ামের প্রতিটি কিউরিও ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ছাত থেকে প্লাস্টার
খসে পড়েছে। দুটো জানালা সম্পূর্ণ উড়ে গিয়ে ফাঁকা দেয়াল হা হা করছে।
অমিতাভ হাসতে শুরু করে। দেশপ্রেমিকের
ঘড়ি চমৎকার প্রতিশোধ নিয়েছে। এই ঘড়িতে অপূর্ব দাস বোমা লাগিয়ে রেখেছিলেন মঁশিয়ে বভিনকে
হত্যার উদ্দেশ্যে। এ ঘড়ি নিয়ে বাড়ি যাবার পর বারোটা বাজলেই বোমা ফাটত। তাই পুলিশ ধরে
নিয়ে যাবার সময় বার বার করে ঘড়ি চালাতে বারণ করে গিয়েছিলেন। ভাগ্যিস জয়া দিদা কথাটা
শুনেছিলেন।
অমিতাভ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। এবারে একাই।
নিজের সস্তার মিউজিয়ামে বসে কাঁদছেন অপূর্ব দত্ত। পাড়া-প্রতিবেশী আসবে, পুলিশ আসবে, তাদের জবাবদিহি করতে হবে, অনেক
কাজ।
অমিতাভর এখন কেটে পড়াই ভাল।
অলঙ্করণ: শুভঙ্কর প্রামাণিক
______________________________________________________________________________
ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের বহুল-প্রশংসিত গ্রন্থ ‘শিকার’ সংগ্রহ করুন এই লিংক-এ:
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন