জ্ঞানবৃক্ষ - রাজা ভট্টাচার্য
জ্ঞানবৃক্ষ
রাজা ভট্টাচার্য
গল্পের
গোড়াতেই আমি এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য— রমেনবাবুর মতো প্রকৃত ভদ্রলোক আজকালকার
দিনে কালেভদ্রে দেখা যায়৷ রমেনবাবুর পুরো নাম রমেন্দ্রনাথ আচার্য্য; এবং এই
য-ফলাটির ব্যাপারে তিনি খুবই স্পর্শকাতর। আজকাল যে এই বাড়তি য-ফলাটা আর দেওয়া
হচ্ছে না, তা তাঁকে বেশ
কয়েকজন উপযাচক হয়ে শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনও অজানা কারণে রমেনবাবু এ ব্যাপারে লড়ে
যাচ্ছেন আজও। অবিশ্যি আজকাল আর তাঁর নামটা লিখতেই বা হয় কখন? ওই… পাড়ার ছেলেরা চাঁদা কাটতে এলে তিনি মনে করিয়ে দেন, “হ্যাঁ
হ্যাঁ, আচার্য্য, স্বরে আ, চ-য়ে আকার, শেষে হল গিয়ে অন্তস্থ
য-য়ে রেফ য-ফলা, বুঝলে?”
তা এই য-ফলা রক্ষার মতো বেশ কিছু খেয়াল রমেনবাবু
রীতিমতো ভালোবেসে মেনটেইন করেন। বই পড়ার নেশাটা তারই মধ্যে একটা। তিনি যে
শহরতলিটিতে থাকেন, সেখানে অনেক কিছুই নেই বটে; কিন্তু খাসা একখানা লাইব্রেরি আছে।
রমেনবাবুর ছেলেবেলায় সেখানে বিকেলবেলার দিকে টেবিলে বসার জায়গা পাওয়া যেত না। সে
আজ চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের কথা। রমেনবাবুর বয়েস তখন সবে দশের কোঠায় ঢুকেছে। খেলার
আগে একবার লাইব্রেরিগুলো ঢুঁ মেরে বই বদলে নেওয়াটা ছিল তামাম ছেলেপুলের নেশা।
আজ সেই লাইব্রেরিতে একা বসে থাকেন অমিতবাবু। তিনিই
এখন লাইব্রেরিয়ান, ফলে কেউ আসুক না আসুক— তাঁকে এসে দরজা-জানালা খুলে বসে থাকতেই
হয়। আর আসেন জনাকয়েক রিটায়ার্ড বৃদ্ধ; যাঁরা সন্ধের পর টিভির রিমোটটাকে হাতে পান
না গিন্নির অত্যাচারে৷ এঁরাই বসে থাকেন আটটা পর্যন্ত, পেপার বা ম্যাগাজিন পড়েন,
ক্বচিৎ আড্ডাও হয়। বইয়ের আলমারিতে ধুলো জমেছে। কে নেবে বই?
কমতে কমতে তাই
এখন বলতে গেলে লাইব্রেরির একমাত্র বইয়ের গ্রাহক হয়ে দাঁড়িয়েছেন রমেনবাবু। তাঁর
একটা জুতোর দোকান আছে বাজারে। পুজোর আগে ছাড়া আজকাল আর বিশেষ বিক্রি-টিক্রি হয় না,
লোকজন অনলাইনেই অর্ধেক কেনাকাটা করে নেয়। তবে কী, রমেনবাবু
একা মানুষ, বিয়ে-থা করেননি, তাই চলে যায় মোটামুটি। বাকি
সময়টা রমেনবাবুর একমাত্র কাজ হল বই পড়া। নেশা খুব, কিন্তু অত পয়সা নেই বলে
রমেনবাবু একান্তভাবেই লাইব্রেরির উপরে নির্ভরশীল। আর সত্যি বলতে কী, টাউন
লাইব্রেরিতে বইও আছে বিস্তর। তাছাড়া, বই পড়ার লোক না থাকলে কী হবে— সরকারের টাকা
পাঠানো তো আর বন্ধ হয়নি! ফলে প্রতি বছর নতুন বই কেনা হয়ে চলেছে; আর রমেনবাবু মনের
আনন্দে পড়ে চলেছেন। বলতে গেলে, তাঁরই জন্য আজও চালু আছে টাউন লাইব্রেরি।
ব্যবসার কাজে মাসে একবার রমেনবাবুকে আসতেই হয় কলকাতায়। সেদিন একটু
তাড়াতাড়ি কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পর কেন কে জানে হঠাৎ তাঁর মনে হল
একটা অদ্ভুত কথা। সেই কোন ছেলেবেলা থেকে এই মস্ত শহরটায় আসছেন তিনি, অথচ কিছুই
দেখা হয়নি তাঁর। এন্টালির মোড়ে দাঁড়িয়ে চিনি-ছাড়া চা খেতে খেতে হিসেব করলেন তিনি।
চিড়িয়াখানা, জাদুঘর আর কালীঘাটের মন্দিরটা ছাড়া তো আর কিছুই দেখা হয়নি! আশ্চর্য!
এতদিন ধরে আসছেন শহরটায়, অথচ বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামটা পর্যন্ত কিনা শুধু বাইরে
থেকেই দেখেছেন! এত যে বইয়ের নেশা তাঁর, বইয়ের আদত জায়গা কলেজ স্ট্রিটটা অবধি তিনি
চেনেন না!
এই ভাবনা
থেকেই তিনি চলে এলেন কলেজ স্ট্রিটে, এবং জাস্ট হাঁ হয়ে গেলেন। এত বই আর এত বইয়ের
দোকানও আছে পৃথিবীতে! নেশাগ্রস্তের মতো সন্ধে পর্যন্ত এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে
বেড়ালেন রমেনবাবু, নতুন বইয়ের গন্ধ নিলেন; মানিক বাঁড়ুজ্যের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’
বইটা পড়েছিলেন বহুকাল আগে, আজ কুড়ি টাকায় সেকেন্ড হ্যান্ড বই পেয়ে কিনেই ফেললেন। এ
বই বাড়িতে রেখে দিতে হয়। কৈশোরের সেই স্মৃতিবাহী অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেকের
ইন্দ্রজাল কমিক্সের বই দেখেও বেজায় ইচ্ছে হয়েছিল বটে কিনে ফেলার, কিন্তু এক-একটা বইয়ের দাম পঞ্চাশ
টাকা চাইতে তিনি রণে ভঙ্গ দিলেন। শেষমেশ সন্ধে পার করে যখন পায়ে ব্যথা আর পেটে
খিদের টান ধরল, তখন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন ঠিক কফিহাউসের নীচে। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছেন এই জায়গাটার কথা,
কিন্তু ঢোকা হয়নি কখনও। আজ আর এটাই বা বাকি থাকে কেন? গট গট করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায়
উঠলেন রমেনবাবু, এবং বরাতজোরে একটা ফাঁকা টেবিলও জুটে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
বয়েস হয়েছে। বসে যে আরামটা পেলেন, তাতেই কথাটা মনে হল রমেনবাবুর৷
কিন্তু চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে পায়ের ব্যথা ভুলে গেলেন তিনি। কত টেবিল রে বাপু!
আর প্রত্যেকটা টেবিলেই লোক বসে আছে! দেওয়ালে মস্ত একটা রবিঠাকুরের ছবি ঝুলছে, তার
পাশে লেখা আছে ‘ধূমপান নিষেধ’৷ তার ঠিক নীচে বসেই সিগ্রেট ফুঁকছে দাড়িওলা একটা
ছোকরা আর শাড়ি-পরা একটা মেয়ে। নিচু স্বরে গুনগুনিয়ে কথা বলে চলেছে সবাই। অনেকেই
বইখাতা খুলে দস্তুরমতো আলোচনা করছে। সব মিলিয়ে রমেনবাবুর বেশ একটা ইয়ে হল, হুঁ হুঁ বাবা, এর নাম কফিহাউস! অ্যাদ্দিন শুনেই এসেছেন, আজ দর্শনও হয়ে
গেল।
মুশকিল হল, বসে যে আছেন, তা কেউ তো অর্ডার নিতে আসছে না! মেন্যু কার্ডটাই বা
কোথায়? খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে, দু’-একজন সাদা উর্দি পরা
লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলেন রমেনবাবু। কী করা যায়?
ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, ব্যাগের ভেতর সদ্য কেনা বইটা আছে বটে।
বহুকাল পড়েননি, ভুলেই গেছেন গল্প-টল্প সব। তবে হ্যাঁ,
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রথমবার পড়ার, এবং সেই অমোঘ শুরুটা পড়ার মুগ্ধতা এখনও মনে
আছে বই-কি! কাজেই বইটা বের করে পড়া শুরু করে দিলেন তিনি, এবং যথারীতি সেই আশ্চর্য সূত্রপাত তাঁকে আবার ঘায়েল করে ফেলল। দেবতার
কটাক্ষ যে আজও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না, তা বুঝতে রমেনবাবুর লাগল দু’মিনিট, তারপর বইয়ের পাতায় ডুবে গেলেন তিনি।
হঠাৎ চেয়ার টানার কর্কশ শব্দে তাঁর ঘোর-লাগা ভাবটা
কেটে গেল। জনা চার-পাঁচ অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে প্যাট প্যাট করে তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছে
দেখে বই-টই ফেলে
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি। কে জানে— হয়তো এটা এদের বুক করা টেবিল, এখানকার দস্তুর তো আর তিনি জানেন না!
ওদেরই মধ্যে একটি দাড়িওলা পাঞ্জাবি পরা ছেলে মিষ্টি
গলায় বলল, “আঙ্কল, আর কেউ আসবে?”
শুনে রমেনবাবু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। আর কে কে আসবে, এলে-ই বা
তিনি সে কথা জানবেন কী করে— ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মাথায় এল তাঁর, তারপর ঘাড় নেড়ে
বললেন, “তা তো জানি না ভাই!” বলেই অবিশ্যি মনে হল, এ হে!
ছেলেটি যখন আঙ্কল বলেছে, তখন তাঁর ‘ভাই’ সম্বোধনটা টেকনিক্যালি ভুল।
ছেলেটি একটু হেসে বলল, “মানে আপনার কোনও বন্ধুবান্ধব আসবে
না তো পরে? ব্যস, ওটাই জিজ্ঞেস করছিলাম। বস রে! এই শাকম্ভরী, তুই ওদিকটায় যা, আর
অর্যমা, তুই এই চেয়ারটায় বসে পড়।”
বেশ গুছিয়ে নিয়ে বসার পর সেই অর্যমা নামের ছেলেটি হঠাৎ ঝুঁকে টেবিলের
উপর রাখা বইটা টুক করে উল্টে নামটা দেখে নিয়ে সিধে রমেনবাবুকেই বলল, “আপনার বই?
পড়ছিলেন?”
ফিকে হেসে ঘাড় নাড়লেন রমেনবাবু। টেবিলে যখন তিনি একাই বসেছিলেন, আর
টেবিলের উপর বইটা যখন খোলাই ছিল— তখন আর কী-ই বা হতে পারে?
উল্টোদিকে বসা চশমাপরা মেয়েটি এবার বলল, “পুতুলনাচ? বাব্বাঃ! বইটা
দেখলেও আমার এখনও বমি পায়। শশী আসবে, শশী আসবে করে সব লাফাল, শেষে এল কুসুম! আর
সেই ইডিয়টিক প্রশ্নটা— সেই যে রে, পুতুল বই তো নই আমরা... ওইটা। হরিবল্! জাস্ট
হরিবল্!”
সত্যি বলতে কী, মেয়েটির একটি কথারও মানে বুঝতে পারলেন না রমেনবাবু। শশী
বা কুসুম তো এই বইটারই দুটো চরিত্রের নাম। তারা আবার কোথায় আসবে? কেন-ই বা আসতে
যাবে? আর যদি এসেই পড়ে, তাতে এভাবে হরিবোল হরিবোল করার-ই বা কী আছে?
তাঁকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি বলল, “আপনি এখনও এসব বই পড়েন?”
এরকম কড়া অভিযোগ আজ পর্যন্ত কেউ রমেনবাবুর মুখের উপর করেনি। তায় আবার
এইমাত্র এই একই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি ঘাড় নেড়েছেন, কাজেই এখন অস্বীকার
করার উপায় নেই। থতমত খেয়ে তিনি তাড়াতাড়ি বইটাকে টেবিলের উপর থেকে নিয়ে ব্যাগে ভরে
ফেললেন।
যে ছেলেটি হাঁকডাক করে সবাইকে বসাল, সে এবার নাকটা সামান্য কুঁচকে বলল,
“এখনও সেই মানিক? সাঁর্ত্রের এক্সিস্টেনশিয়ালিজমটা পড়ে দেখলে
বুঝতে পারতেন, মানিক যেটাকে সমাজ-মন বলে চালানোর চেষ্টা করছেন, ওটা আসলে সিম্পল
নিয়তিবাদ। অদৃষ্টবাদেরই একটা রকমফের ছাড়া কিছুই নয়।”
মেয়েটি, যার নাম শাক দিয়ে কী যেন একটা, বলল, “‘অন অ্যানার্কিজম’
পড়েছেন? চমস্কি? ওটা পড়লে বুঝবেন— পরবর্তীকালে মানিক যে কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে
পড়েছিলেন, সেটাও আসলে একটা দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতিরই অনিবার্য বিপরীত প্রতিক্রিয়ায়।
বুঝলেন?”
সত্যি বলতে কী, রমেনবাবুর মাথায় একটি শব্দেরও অর্থ ঢুকছিল না৷ এদের
সামনে কোন কুক্ষণে তিনি যে বইটা পড়ার কথা স্বীকার করতে গেলেন, কে জানে?
এতক্ষণ দ্বিতীয় মেয়েটি চুপ করে বসেছিল। কালোর মধ্যে ভারি স্নিগ্ধ
চেহারা, শাড়ি-পরা৷ একটু হেসে বলল, “আপনি বুঝি বই-টই পড়েন
খুব?”
“না না, খুব আবার কী?” ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন রমেনবাবু, “তবে... ওই আর-কি...
কাজ-টাজ তো নেই কিছু তেমন... তা বসে বসে...”
“বেশ বেশ!” মেয়েটি বলল, “আজকাল তো বই-ই পড়ে না কেউ। তা কাদের লেখা পড়েন
মেইনলি?”
এই মেয়েটির কথা-টথা তবু দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। আশ্বস্ত হয়ে রমেনবাবু
বললেন, “আমার আবার পড়া! ওই ধরুন... রবি ঠাকুর পড়েছি ছোটোগল্পগুলো,
উপন্যাসও পড়েছি চারটে না পাঁচটা, তারপর শরৎচন্দ্রের সবই পড়া। ওই মোটা নীল বইটাতে
যা আছে সব, তারপর তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণের সব, মানিক বাঁড়ুয্যে, ও হো! বঙ্কিম সব
পড়েছি। মাইকেল। তারপর এধারে ধরুন সতীনাথ ভাদুড়ী খুব ভালো লাগে... নারায়ণ
সান্যাল... আর সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ বসু তো সবাই পড়ে...”
“হ্যাঁ, সব্বাই পড়ে।” মিষ্টি হেসে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল মেয়েটি, “নবারুণ
পড়েননি?”
“পড়েছিলাম তো!” রমেনবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, “হারবার্ট পড়লাম, তারপরেই
পড়লাম কাঙাল মালসাট... তারপর আরেকটা কী যেন বই পড়ছিলাম, মানে শুরু করেছিলাম, তারপর
কেমন একইরকম লাগল, তাই আর শেষ করা হয়নি আর-কি।”
বলে চোখ ফেরাতেই দেখলেন, চারজোড়া চোখ তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে তাঁর দিকে
তাকিয়ে আছে। কাজেই সন্তপ্ত স্বরে তিনি যোগ করলেন, “আমার হল...
মানে যাকে বলে জাস্ট শখের পড়া, বুঝতেই পারছেন... ভালোলাগা নিয়ে কথা... হেঁ হেঁ…”
“শরৎচন্দ্রের গল্পগুলো সত্যিই আপনার ভালো লাগে?”
সরু চোখে তাকিয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে এবার
একটু ঘাবড়ে গেলেন রমেনবাবু। তারপর সতর্ক গলায় বললেন, “ইয়ে... তা লাগে বটে...”
অর্যমা নামের ছেলেটি তীব্র গলায় বলে উঠল, “ওই প্যানপ্যানে
সেন্টিমেন্টের গ্যাদগ্যাদে বড়িগুলো খেতে সত্যিই ভালোলাগে? সিরিয়াসলি?”
রমেনবাবু বুঝতে পারছিলেন, তাঁর কোথাও একটা ভুল হচ্ছে৷ বোধহয় শরৎচন্দ্র
ভালোলাগে বলাটা ঠিক হয়নি। মুশকিল হল, তাঁরা যখন পড়াশুনো শুরু
করেছিলেন, তখন তো এঁদের লেখাই সবাই পড়ত! দিনকাল কি এতই বদলে গেল নাকি এরই মধ্যে?
শাড়ি-পরা মেয়েটা বলল, “আমার সবচেয়ে কোনটা খারাপ
লাগে জানিস? মেয়েদের নিয়ে এত্ত কথা বলেছেন ভদ্রলোক, কোথাও নারীর ক্ষমতায়নের কোনও চিহ্ন দেখিস? মেয়েরা যেন শুধু ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদার জন্যই
জন্ম নিয়েছে। অদ্ভুত মেন্টালিটি মাইরি!”
রমেনবাবু ব্যস্ত হয়ে রাজলক্ষ্মী আর কিরণময়ীর নাম
বলতে যাচ্ছিলেন, এইসময় সেই দাড়িওলা ছেলেটা ‘ছিছিক্!’ করে একটা বিচিত্র শব্দ করতেই
কোত্থেকে একজন ওয়েটার এসে দাঁড়াল এই টেবিলের সামনে৷ চারটে ইনফিউশানের অর্ডার নিল
দিব্যি। রমেনবাবু বুঝতে পারলেন, এই আওয়াজটা করেননি বলেই তাঁর অর্ডার নিতে আসেনি
কেউ। যস্মিন দেশে যদাচার।
চশমাপরা মেয়েটি আবার বলল, “রবিঠাকুরের ব্যাপারটাই বা আলাদা হল
কীসে? আশা আর বিনোদিনী মিলে মহেন্দ্রকে কেলিয়ে দিলেই হয়ে যেত!”
আঁতকে উঠে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন রমেনবাবু, তার আগেই অন্য ছেলেটি বলল,
“অ্যাটলিস্ট ওদের দু‘জনের মধ্যে একটা লেসবিয়ান রিলেশনশিপ...”
এবার রমেনবাবুর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটা খপ করে বন্ধ হয়ে গেল। বলে কী এরা?
সেইটে দেখে ফেলে সেই শাড়ি-পরিহিতা মেয়েটি আচমকা
তীব্র গলায় বলে উঠল, “অমনি খারাপ লাগল, না? আর নিজেরা যখন... গোরা আর বিনয়ের মধ্যে
কী রিলেশনশিপ ছিল— বুঝি না, না?”
‘গোরা’ রমেনবাবু পড়েননি, কাজেই মেয়েটির ওই ‘নিজেরা যখন’ ইত্যাদি শুনেই
তিনি হাঁ হাঁ করে বললেন, “আরে না না, ছি ছি ছি, আমাকে আপনারা এইসব ভাবলেন কী করে?”
দাড়িওলা তীব্রতর স্বরে বলল, “এই যে আপনি ছিছিক্কার করে উঠলেন, এটাই হল উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনার খোঁয়ারি, বুঝলেন? পোস্ট-কলোনিয়াল
হ্যাং-ওভার এখনও কাটেনি আপনাদের। সারাজীবন তো এইসব বুলশিট
পড়েই গেলেন; এবার একটু সাহিত্য পড়ুন। প্রকৃত সাহিত্য। লাতিন আমেরিকান সাহিত্য
পড়ুন। মার্কেজের নাম শুনেছেন? বাদ দিন। কোয়েলহো? মুরাকামি? লাভক্র্যাফট জানেন?
শুধু ছিঁচকাঁদুনে ছেন্টিমেন্টাল বাংলা। হুঁঃ!”
“জীবনানন্দ পড়েছেন?” জিজ্ঞেস করল অর্যমা।
হ্যাঁ বলবেন, না অস্বীকার করবেন, বুঝতে না পেরে রমেনবাবু মিনমিন করে
বললেন, “ওই ‘রূপসী বাংলা’টা... আর বনলতা...”
“শুধু ‘আট বছর আগের এক দিন’ কবিতাটার উপরে আমারই স্যারের তিনশো পাতার
বই আছে। পড়ুন, ভালো বই পড়ুন। যে লেখা পড়ে হাসি পায় বা চোখে জল আসে— সেটা সাহিত্য
নয়, বুঝলেন? যা পড়লে মগজ খোরাক পায়, সেটাই আসল।”
খুব ঘটা করে মাথা নেড়ে সুড় সুড় করে উঠে পড়লেন
রমেনবাবু৷ রাত হচ্ছে, এরপর আর ট্রেন পাবেন না। ছেলেমেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে কথায়
ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দেখে টুক করে মস্ত দরজাটা দিয়ে নিজেকে গলিয়ে দিলেন তিনি।
আজ কপাল ভালো।
লোকাল ট্রেনের জানলার পাশে একটা সিট জুটে গেল তাঁর। আয়েশ করে বসে, এক ঢোঁক জল খেয়ে ব্যাগ থেকে বইটা ফের বের করলেন রমেনবাবু। দিব্যি পড়তে পড়তে চলে
যাওয়া যাবে।
বরিশাল থেকে বারো বছর বয়েসে চলে আসতে হয়েছিল তাঁকে।
কড়ির স্তূপের মতো মেঘ, কুচফল, রূপশালী ধান তিনি দেখেছেন। দেখেছেন বিশীর্ণা
ধানসিঁড়ি নদীটিও। বেঁচে থাক তাঁর না বোঝা রূপসী ব!
সব বুঝে ফেললে, এই রহস্যহীন, মায়াহীন, মোহহীন
পৃথিবী তাঁর কোন কর্মে লাগবে?
______________________________________________________________________________
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন