তিনটি কোথা হারিয়ে গেল - অর্ক পৈতণ্ডী
তিনটি কোথা হারিয়ে গেল
অর্ক পৈতণ্ডী
।। ১।।
১৩ মে ১৯৭৮
সূর্য
ডোবার বেশ কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছে গেল রিচার্ড। গাড়ি দাঁড় করিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখল।
কেউ কোত্থাও নেই। যে রাস্তায় সে তার গাড়ি দাঁড় করিয়েছে তার পোশাকি নাম ওল্ড রোড। সে-রাস্তা
এখন শুনশান। জনমনিষ্যি নেই। পাশ দিয়ে চলে গেছে পাওয়ার ট্রান্সমিশন লাইন। রাস্তার পাশে
জঙ্গল। সেই জঙ্গল ধরে একটু এগোলেই একটা খাঁড়ি— যাকে
সবাই বলে লোন ক্রিক। সেখানে আজ মাছ ধরতে এসেছে রিচার্ডের ভাই বিলি। সঙ্গে রয়েছে ওর
দুই বন্ধু জর্জ আর মার্ক। ওদের মাছ ধরার বড্ড নেশা।
মাঝেমধ্যেই এই খাঁড়িতে চলে আসে মাছ ধরতে। লোন ক্রিকে মাছ ধরতে আসা মানে সারা দিনের
ব্যাপার। রিচার্ড সকালবেলা ওদের ঠিক এইখানে নামিয়ে দিয়ে যায়, আবার বিকেলের দিকে
এসে তুলে নেয়। ওরা থাকে পেটাওয়াওয়ায়, কানাডিয়ান
ফোর্সের বেসে। এখান থেকে ফিরতে একঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগে।
রিচার্ড গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ বোকার
মতো দাঁড়িয়ে রইল। আশ্চর্য ছেলেপিলে যত! সময়জ্ঞানের
বালাই বলে কিছু
নেই! একটু বিরক্ত হয়েই
রিচার্ড জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খাঁড়ির দিকে হাঁটা দিল। এই জঙ্গলটা ওন্টারিও-র অ্যালগংকুইন পার্কের উত্তর-পূর্ব দিকের
অংশ। খাঁড়িটা বয়ে গেছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। রিচার্ড খাঁড়ির
কাছে পৌঁছে খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করল। ছেলেদের কোনও চিহ্ন নেই। ওরা কি প্রতিবার একই জায়গায়
মাছ ধরে,
নাকি
জায়গা বদল করে? খাঁড়িতে জল মোটামুটি। ওরা খাঁড়ি পেরিয়ে দক্ষিণের দিকে
যায়নি তো? রিচার্ড একবার ভাবল ওপাড়ে গিয়েও
একটু খোঁজাখুঁজি করবে, কিন্তু কী যেন ভেবে তা বাতিল করল। মনের মধ্যে
একটা খচখচানি হতে শুরু করেছে, একটা চাপা অস্বস্তি— কেন, তা রিচার্ড
নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
ইতোমধ্যেই কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। প্রকৃতি
রাতের চাদর জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। রিচার্ড গাড়ির কাছে ফিরে এসে হর্নে চাপ দিল। একবার… দু’বার… তিনবার… শেষবার
চেপে ধরে রইল অনেকক্ষণ। রাতের নৈঃশব্দ্য চিরে ফালা ফালা হয়ে গেল... কিন্তু
ছেলেগুলোর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে থাকতেই রিচার্ডের
মনের সেই চাপা অস্বস্তিটা ডালপালা মেলতে শুরু করল। আর দেরি না করে সে গাড়ি ছোটাল পেটাওয়াওয়ার
দিকে।
।। ২ ।।
ওন্টারিও
প্রভিন্সিয়াল পুলিশ বা ওপিপি-র নর্থ বে ডিটাচমেন্টের
কনস্টেবল রে কার্সনের কাছে ফোনটা এল পরদিন সকালে। ফোনের ওপারে ওপিপি ইনভেস্টিগেশন-এর হেড
কর্পোরাল কার্টিস। রে কার্সন ওপিপি-র একজন দক্ষ ডগ হ্যান্ডলার।
হারানো মানুষ খুঁজে বের করার ব্যাপারে তাঁর প্রায় বছর দশেকের অভিজ্ঞতা। আগের দিন ছিল
নাইট শিফটে কাজ। শেষ হয়েছে সকাল আটটায়। শরীরে সামান্য ক্লান্তি যে ছিল না তা নয়, কিন্তু
ওপারের কথাগুলো শুনতে শুনতে নিমেষে সজাগ হয়ে উঠলেন তিনি। একজন দু’জন নয়, একেবারে
তিন-তিনজন একসঙ্গে
হারিয়ে গেছে। তিনটি অল্পবয়সী ছেলে। জর্জ হাফকেনির বয়স ষোলো। সঙ্গে ছিল তার ভাই বারো
বছরের মার্ক হাফকেনি আর তাদের বন্ধু পনেরো বছরের উইলিয়াম রাইনড্রেস যার ডাকনাম বিলি।
এই তিনজনেই গতকাল অ্যালগংকুইন পার্কের উত্তর-পূর্ব কোণের
একটা খাঁড়িতে মাছ ধরতে গিয়েছিল। বিলি রাইনড্রেস-এর দাদা
রিচার্ড—
যার
বয়স আঠেরো—
সে
ওই তিনটি ছেলেকে সকালবেলা খাঁড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে এসেছে। কিন্তু বিকেলবেলা তাদের
আনতে গিয়ে আর খুঁজে পায়নি। সে-ই ফিরে এসে খবর দিয়েছে
পেটাওয়াওয়ায় জর্জ আর মার্কের বাড়িতে। ওদের মা শার্লট হাফকেনি সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ
করেছিলেন অষ্টম কানাডিয়ান হুজ়ার্স-এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল
বব বিলিংস-এর সঙ্গে।
বিলিংস কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করে রাত্রেই দুশো জনের সার্চ পার্টি পাঠিয়ে একদফা তল্লাশি
চালিয়েছেন সেই খাঁড়ির আশেপাশে। আজ সকালে কানাডিয়ান ফোর্স-এর সঙ্গে
ওন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পুলিশ আর মিনিস্ট্রি অফ ন্যাচারাল রিসোর্সেস-ও যোগ দিয়েছে।
প্রায় আড়াইশো জন মিলে আজ সকালে তন্ন-তন্ন করে খুঁজেছে।
ওই ছেলে তিনটের কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। সেজন্যই এবারে ডাক পড়েছে রে কার্সন আর তাঁর কুকুরের।
সকাল
ন’টা পনেরো
নাগাদ কার্সন লোন ক্রিকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
সঙ্গে তাঁর কুকুর ক্লাউড থ্রি। ক্লাউড থ্রি জাতে জার্মান শেপার্ড। ট্র্যাকিং ডগ হিসেবে
দুর্দান্ত। তবে কার্সনের চিন্তা অন্য জায়গায়। ইতোমধ্যেই শত শত মানুষ জঙ্গলের সেই
অংশ ছেনে ফেলেছে। এতজনের গন্ধের মধ্যে থেকে তিনজনের গন্ধ আলাদা করা ক্লাউড থ্রি-র পক্ষে
খুব একটা সহজ হবে না।
হলও না। কার্সন আর ক্লাউড থ্রি যখন খাঁড়ির
উত্তর পাড়
বরাবর
খোঁজ শুরু করলেন তখন কানাডিয়ান ফোর্সের চারটে চপার এসে যোগ দিয়েছে তল্লাশি অভিযান।
খাঁড়ির দুই পাড়
সেনায়
ছয়লাপ। এদের অনেকেরই হাতে লাউডস্পিকার। কার্সনের ভুরু কুঁচকে গেল। মাথার উপর চপার
উড়ছে,
জঙ্গল
গমগম করছে লাউডস্পিকারে শব্দে। অথচ ছেলেগুলো তা দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে না? আশ্চর্য
তো!
ওরা
কি খুব গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গেছে নাকি?
কার্সন ক্লাউড থ্রি-কে নিয়ে
গভীর জঙ্গলের দিকে হাঁটা দিলেন। তবে এতেও তেমন লাভের লাভ কিছু হল না। ক্লাউড থ্রি নতুন
কোনও
ট্র্যাকের
হদিশ পেল না। সারাটা দিন যাকে বলে একেবারে নিষ্ফলা কাটল।
।। ৩ ।।
পরদিন
অর্থাৎ সোমবার সকালে কার্সনের সঙ্গে আলাপ হল জর্জ আর মার্ক-এর বাবা
ওয়ারেন্ট অফিসার হাফকেনির। ছেলেদের নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে তিনি তড়িঘড়ি টেক্সাস
থেকে ফিরে এসে অনুসন্ধানকারী দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তিনি অবশ্য খুব একটা চিন্তিত
নন। নিজের ছেলেদের বিশেষ করে জর্জকে জঙ্গলে বেঁচে থাকার কৌশল শিখিয়েছেন হাতে-কলমে। এছাড়াও
জর্জ নিজে কানাডিয়ান এয়ার বোর্ন রেজিমেন্টের ক্যাডেট কর্প হিসেবে দু’ দুটো ওয়াইল্ডারনেস
সারভাইভাল কোর্স করেছে। এই জঙ্গল
তাঁর ছেলেদের কোনও সমস্যায় ফেলতে পারে বলে বাবা মনে করছেন না।
এসব শুনে নিশ্চিন্ত হওয়ার বদলে কার্সনের
চিন্তা বেড়ে গেল। ছেলেগুলো তার মানে নেহাতই কাঁচা নয়। জঙ্গল সম্বন্ধে ভালমতোই ওয়াকিবহাল। তা হলে প্রায় দেড় দিন ধরে
তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? হিসেবে কি কোনও ভুল
হচ্ছে?
কার্সন
ঠিক করলেন আবার শুরু থেকে শুরু করবেন।
সেইমতো
রিচার্ড রাইনড্রেস-কে সঙ্গে নিয়ে ফের ওল্ড রোড থেকে লোন ক্রিকের
দিকে এগোলেন তিনি। এবার খাঁড়ি পেরিয়ে দক্ষিণে যেতেই ক্লাউড থ্রি আচমকাই যেন সক্রিয়
হয়ে উঠল। কার্সন স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, সে কোনও গন্ধ পেয়েছে।
খাঁড়ির দক্ষিণ পাড় বরাবর একশ’ গজ যেতে
না যেতেই ক্লাউড থ্রি প্রথমে খাঁড়ির পাশে পাথরের গায়ে আটকে থাকা জর্জের ছিপটা খুঁজে
পেল। এরপরেই… খাঁড়ি
থেকে বেরিয়ে আসা একটা খোঁচা মতো গাছের ডালে জর্জের জ্যাকেটের একটা ছেঁড়া অংশ আটকে
থাকতে দেখা গেল। সেই ডাল ছাড়িয়ে হিসেব করে কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল মাটির গায়ে কোনও কিছু
ঘষটে ঘষটে নিয়ে যাওয়ার দাগ। খাঁড়ির পাশের মাটি ছড়িয়ে মসে ঢাকা গাছের গুঁড়ির
উপর আঁচড় কেটে সেই দাগ চলে গেছে বনের গভীরে।
এক নিমেষে পুরো ব্যাপারটাই যেন বদলে
গেল। এতক্ষণ অবধি তিনটে হারিয়ে যাওয়া ছেলের খোঁজ করছিল সবাই। কার্সনের কোনও সন্দেহ
রইল না যে,
এবার
খুঁজতে হবে মৃতদেহ।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল বব বিলিংস তখন জঙ্গলেই
ছিলেন। তাঁকে বলে কার্সন সমস্ত লোকেদের একজোট করল পাওয়ার লাইন রোডের উপর। সব মিলিয়ে
প্রায় শ’খানেক
লোক।
এতক্ষণ খোঁজার ধরন যা ছিল এবার তার চেয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে খুঁজতে হবে। খুঁটিয়ে
দেখতে হবে প্রতিটি
ঝোপ-ঝাড়।
নজর রাখতে হবে মাটির দিকে।
দলটা খোঁজ শুরু
করল দক্ষিণ
পাড় বরাবর।
আর কার্সন হাঁটা দিলেন নিজের গাড়ির দিকে। অ্যালগংকুইন প্রভিন্সিয়াল পার্কে আগ্নেয়াস্ত্র
নিয়ে ঢোকার নিয়ম নেই, তাই তাঁর .38 স্পেশাল
রিভলভারটা গাড়িতেই ছেড়ে এসেছিলেন তিনি। মন বলছে এই অবস্থায় সেটা আবার কোমরে আটকানোর
বিশেষ প্রয়োজন।
বিকেল ছ’টা পনেরো
নাগাদ লোন ক্রিকের দক্ষিণ পাড় বরাবর যে দলটা তল্লাশি
চালাচ্ছিল তার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের মানুষটি আচমকা চেঁচিয়ে উঠল। সে মৃতদেহের
খোঁজ পেয়েছে।
জনা-কুড়ি লোক তার কাছাকাছি
ছিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে জড়ো হল। তাদের রীতিমতো বিস্মিত করে দিয়ে মৃতদেহের
পাশ থেকে উঠে ধীরপায়ে পাশের ঝোপে গিয়ে ঢুকে পড়ল একটা বিশাল আকৃতির কালো ভালুক।
।। ৪ ।।
বসন্তকাল।
জঙ্গলের স্যাঁতসেঁতে মাটিতে এখন ভিজে পাতা আর পাইন নিড্ল্ ছড়িয়ে
রয়েছে। খাঁড়িটারও এখন বেশ তরতাজা অবস্থা। জল বইছে সশব্দে। ক’টা বাজে
এখন?
দিনের
আলো দেখে মনে হচ্ছে পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যেই হবে। তবে
জর্জের এখন সময়ের খেয়াল নেই। চার-চারটে ব্রুক ট্রাউট
মিলেছে খাঁড়ি থেকে। এখন সে ছিপ ফেলে পাঁচ নম্বরটার জন্য অপেক্ষা করছে।
জর্জ বসে ছিল দক্ষিণে
মুখ
করে। ভালুকটা এল উত্তর দিক থেকে। চুপিসাড়ে। জর্জ কিছুই টের পেল
না। খাঁড়ির জলের কলকলানিতে খুনির পায়ের শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছিল বোধ হয়।
ভালুকটা জর্জকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে
তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এমন অসম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব।
ভালুকের থাবার আঘাতে জর্জের ডান পাঁজরের
ছ’
ছ’টা হাড়
ভেঙে গেল,
টুকরো
হয়ে গেল ডান দিকের কণ্ঠার হাড়, ফুটো হয়ে গেল ডান
ফুসফুস। শেষমেষ এক জোরালো কামড়ে ঘাড় মটকে যাওয়ার আগে জর্জ আর ভালুকের সংক্ষিপ্ত
লড়াইয়ের ফল ছিল এটুকুই।
ভালুকটা এবার জর্জের মৃতদেহ টানতে টানতে
নিয়ে গেল খাঁড়ির উত্তর পাড় বরাবর দশ গজ। তারপর মৃতদেহ সমেত খাঁড়ি পেরিয়ে ঢুকে
পড়ল দক্ষিণ পাড়ের জঙ্গলে।
মার্ক আর বিলি মাছ ধরছিল বেশ কিছুটা
দূরে। সেখানে বসে জর্জকে দেখতে পাওয়া যায় না। তাই জর্জের পরিণতির
কিছুই তারা জানতে পারেনি। তারা জর্জের খোঁজ করল বাড়ি ফেরার সময়। তাকে দেখতে না পেয়ে
এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি
শুরু করল। সেটাই হল কাল। খুঁজতে খুঁজতে তারা একসময় পৌঁছে গেল খাঁড়ির দক্ষিণ পাড়ে, নিজের শিকার
আগলে বসে থাকা ভালুকটার খুব কাছে।
ভালুকটা মার্ক আর বিলিকে প্রায় একসঙ্গেই
আক্রমণ করল। তার বিশাল থাবা গিয়ে পড়ল মার্কের মাথায়।
এক আঘাতেই মৃত্যু। বিলি পালানোরও সময় পেল না।
মার্ক পড়ে যেতেই নিমেষের মধ্যে ভালুকটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কণ্ঠনালী ছিন্ন
করল তারপর শক্তিশালী চোয়ালে মটকে দিল ঘাড়।
এরপর ভালুকটা মার্ক আর বিলির মৃতদেহ
টেনে নিয়ে গেল জর্জের মৃতদেহের কাছে। তারপর তিনটে মৃতদেহ থেকেই একটু একটু করে খুবলে
খেয়ে লতাপাতা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল।
।। ৫ ।।
রে
কার্সন চিৎকার করে তল্লাশি দলটাকে সেখান থেকে সরে আসতে বললেন। ভালুকটাকে যদি মারতে
হয় তা হলে তাকে মড়ির কাছ থেকে খেদিয়ে দিলে চলবে না। কার্সনের বিশ্বাস লোকজন সরে
গেলেই ভালুকটা আবার তার শিকারের কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু মারব বললেই যে ভালুকটাকে মারা
যাবে এমনটা নয়। তার জন্য কোনও অভিজ্ঞ শিকারির দরকার। দরকার উপযুক্ত রাইফেল। তাঁর কাছে
আছে একটা রিভলবার। এটা দিয়ে ভালুক শিকার করার কোনও
প্রশ্নই ওঠে না। কানাডিয়ান ফোর্সের এক অফিসারের কাছে .30/30 রাইফেল
একটা আছে ঠিকই কিন্তু তিনি কোনও শিকারি নন। তবে বেশিক্ষণ এই নিয়ে ভাবতে হল না। দ্রুত
এই সমস্যার সমাধান করে দিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল বিলিংস।
কনজারভেশন
অফিসার লোর্ন ও’
ব্রায়েন
মিনিস্ট্রি অফ ন্যাচারাল রিসোর্সেস-এর সঙ্গে প্রায় ছাব্বিশ
বছর ধরে কাজ করছেন। দক্ষ শিকারি। অনেক বজ্জাত ভালুককে শায়েস্তা করেছেন তিনি। তাঁর
কাছে যখন খবর পৌঁছাল তখন তিনি সবে খেতে বসেছেন। এক মুহূর্তও সময়
নষ্ট না করে তিনি তাঁর মডেল 94 উইনচেস্টার আর 150 গ্রেন সিলভার
টিপ কার্ট্রিজের একটা বাক্স তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল বিলিংস
একটা চপার পাঠিয়ে দিয়েছেন পেমব্রোকে।
ওন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পুলিশের কর্পোরাল
কার্টিস,
কনস্টেবল
রে কার্সন আর ক্যানাডিয়ান ফোর্সেস-এর সেই রাইফেলধারী
অফিসারের সঙ্গে যখন মিনিস্ট্রি অফ ন্যাচারাল রিসোর্সেস-এর লোর্ন
ও’
ব্রায়েন
এসে যোগ দিলেন তখন অ্যালগংকুইন পার্কে দিনের আলো ফিকে হয়ে এসেছে।
এই চারজন এগিয়ে চললেন জঙ্গলের সেই দক্ষিণতম
প্রান্তটির দিকে। দেখা গেল তল্লাশি দলের কেউই সেখানে নেই। তাদের দোষ দেওয়া যায়
না। একে বিকেল ফুরিয়ে আসছে তায় ঝোপের আড়ালে মানুষখেকো ভালুক। কাছাকাছি
পৌঁছে চারজনের দলটা পড়ল বিপদে। মৃতদেহগুলি খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছে না। আচ্ছা মুশকিল হল! তল্লাশি দলের লোকজন
যারা মৃতদেহ খুঁজে বের করেছিল তারা সকলেই গিয়ে জমায়েত হয়েছে পাওয়ারলাইন রোডে। ওদের
কাছে কোনও বন্দুক নেই। এই অবস্থায় তাদের কাউকে এখানে আসতে বলা যায় না। ঠিক হল কর্পোরাল
কার্টিস আর কানাডিয়ান ফোর্সেস-এর সেই অফিসারটি পাওয়ারলাইন
রোডে ফিরে গিয়ে মৃতদেহ খুঁজে বের করা দলের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আবার ফিরে আসবেন।
কার্টিস আর অফিসারটি রওনা দিলেন। সঙ্গে
নিলেন
.30/30 রাইফেলটা।
কার্টিসরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই
কার্সন আর ও’
ব্রায়েন
মৃতদেহগুলি খুঁজে পেয়ে গেলেন, সঙ্গে ভালুকটাকেও।
সে ইতোমধ্যেই ফিরে এসেছিল মড়িতে। কার্সন আর ও’ব্রায়েন-কে দেখেই
সে আবার সেঁধিয়ে গেল পাশের ঝোপে। ও’ ব্রায়েন রাইফেলটা
তুললেন বটে কিন্তু গুলি চালানোর ঝুঁকি নিলেন না। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে গুলি চালানো
যাবে না। জানোয়ারটা আহত অবস্থায় পালিয়ে গেলে হিতে বিপরীত হবে।
ও’ ব্রায়েন
আর কার্সন মৃতদেহগুলি থেকে চল্লিশ ফুট দূরত্বে হাঁটু মুড়ে বসলেন। ও’ ব্রায়েনের
বন্দুকের নল সেই ঝোপের দিকে তাক করা যেখানে একটু আগেই ভালুকটা গিয়ে ঢুকেছে। কার্সন
বসলেন ও’
ব্রায়নের
পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বিপরীত দিকে মুখ করে।
ভালুকের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। তারা যদি
কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকেন তা হলে ভালুকটা আবার ফিরে আসতে পারে মড়ির কাছে। সমস্যা
শুধু একটাই,
কার্টিস
কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল লোক নিয়ে এসে হাজির হবেন। অত লোকের উপস্থিতি আঁচ করলে ভালুক
যে আর ঝোপ থেকে বেরোবে না তা বলাই বাহুল্য। পালিয়েও যেতে পারে। কার্সন খুব সাবধানে
তাঁর টু-ওয়ে রেডিওটা
বের করে কার্টিসকে মড়ির কাছে ফিরতে বারণ করে দিলেন। এখন এই শেষ বিকেলের আলোয় অ্যালগংকুইন-এর জঙ্গলে
নরখাদকের সঙ্গে হিসেব-নিকেশ করতে হবে তাঁদের দু’জনকেই।
না,
ভুল
হল,
দু’জন নয়, তিনজন।
ক্লাউড থ্রি-ও রয়েছে
কার্সনের সঙ্গে,
এবং
হঠাৎ করেই সে যেন একটু উশখুশ করতে শুরু
করেছে। কার্সনের ডাইনে একটা ছোটো জলা। জলার পাড়ে ট্যামাৱ্যাক গাছের সারি আর ঘন ঘাসের
জঙ্গল। এই ঘাস-জঙ্গল গিয়ে
মিশেছে সেই ঝোপের সঙ্গে যার আড়ালে ভালুকটা কিছুক্ষণ আগেই গিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।
ট্যামাৱ্যাক গাছের সারি আর ঘাস-জঙ্গল এগিয়ে এসেছে
একেবারে কার্সনের ডান দিকে প্রায় ষাট গজ পর্যন্ত। কার্সন বেশ বুঝতে পারলেন অন্ধকারের
সুযোগ নিয়ে ভালুকটা ঝোপ ছেড়ে ঘাসের জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে ধীরেপায়ে এগিয়ে আসছে তাঁদের
দিকে। ক্লাউড থ্রি সেটা টের পেয়ে থেকেই উশখুশ করে চলেছে।
কার্সন মৃত্যুর গন্ধ পেলেন। এর আগে একবার
এমন অবস্থা হয়েছিল। সেবার ক্লাউড টু-কে সঙ্গে নিয়ে ডোনাল্ড
কেলি নামে এক খুনির পিছু ধাওয়া করেছিলেন তিনি আর তাঁর পার্টনার। ক্লাউড টু কেলিকে
ধরে ফেলা মাত্র সে মরিয়া হয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। কার্সন
আর তাঁর পার্টনার গুলির জবাব দিলেন। কেলি শেষ পর্যন্ত আহত অবস্থায় ধরা পড়ল। কিন্তু
ক্লাউড টু মারা গেল।
আজও কার্সনের হাত সেদিনের মতোই রিভলবার
ধরা অবস্থাতেই ঘেমে উঠল। ক্লাউড থ্রি-র ছটফটানি বাড়ছে।
আবছা আলোয় সবচেয়ে কাছের ট্যামাৱ্যাক গাছটার আড়ালে একটা কালো অবয়ব দেখা গেল কি? কার্সন
ও’
ব্রায়েনকে
সাবধান করে দেওয়ার জন্য হালকা কনুইয়ের খোঁচা দিতে না দিতেই ভালুকটা তীব্র বেগে জঙ্গল
ছেড়ে বেরিয়ে এল।
ও’ ব্রায়েন
পোড়খাওয়া শিকারি। এক ঝটকায় তাঁর শর্ট ব্যারেল রাইফেলের মুখ ভালুকের দিকে ঘুরিয়ে
ট্রিগার টানলেন তিনি। সন্ধের আধো অন্ধকারে তুমুল গর্জনের সঙ্গে উইনচেস্টারের নল থেকে
লাল আলো ঝলকে উঠল। ভালুকটা যেমন দ্রুত বেরিয়ে এসেছিল তার চেয়েও দ্রুত মাটি নিল। কার্সন
বুঝলেন গুলি
ভালুকের
মস্তিষ্ক ভেদ করেছে। তিনি রিভলবার উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ভালুকটা মরেছে কিনা পরীক্ষা
করার জন্য। আচমকাই ভালুকটা উঠে দাঁড়িয়ে আক্রমণ করল। ও’ ব্রায়েন
তৈরিই ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় গুলিতে ভালুকটা আবার পড়ে গেল। এবার আর আক্রমণ নয়।
ভালুকটা পালানোর চেষ্টা
করল ঘন জঙ্গলের দিকে। কার্সনের রিভলবার আর ও’ ব্রায়নের
রাইফেল গর্জে উঠল একসঙ্গে। ভালুকটা কোনোমতে দশ গজ অবধি নিজের
শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা চাপা গর্জন করে মাটিতে পড়ে গেল, আর উঠল
না। বোঝাই যাচ্ছে এবার সে মারা গেছে। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য কার্সন আর ও’ ব্রায়েন
তার কাছাকাছি পৌঁছে আরও এক রাউন্ড করে গুলি চালালেন।
ঝপ করে জঙ্গলটা আবার আগের মতোই নীরব
হয়ে গেল। আশ্চর্য রহস্যময় সেই নীরবতা। জঙ্গল রহস্যময় আর সেজন্যই জঙ্গল বিপজ্জনক।
কার্সন ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে মৃতদেহগুলির পাশে দাঁড়ালেন। দলের বাকিরা এসে পৌঁছনো
পর্যন্ত তিনি এখানেই একটু দাঁড়িয়ে থাকতে চান।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে। মূল লেখা- টেড গর্সলাইন।)
অলঙ্করণ: আশিস ভট্টাচার্য
______________________________________________________________________________
এমনই নানান রোমাঞ্চকর কাহিনি, অনুবাদ, প্রবন্ধ, রঙিন চিত্র পাবেন শুধুমাত্র অন্তরীপ জল-জঙ্গল-বন্যপ্রাণ সংখ্যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন