ঠাউরানির চরের রাত - শিল্পী দত্ত
ঠাউরানির
চরের রাত
শিল্পী দত্ত
।।
১।।
চাক পাইলাম না
আইতে একশো যাইতে একশো
পারমিটেতে একশো যায়
এত খরচ তবু বুঝি মধু মিলা না...”
আনোয়ার শেখ পেশায় মৌয়াল। চাক খোঁজা, ভাঙা, নিড়ান দেওয়া ছাড়া জগতের আর কোনো কাজ আনোয়ারের জানা নেই। অথচ পারমিটের পয়সা, মহাজনের কর্জ মেটাবার টাকা, নৌকার পারমিটের খরচ জোগানোর ক্ষমতাও নেই। তিনমাসের টাকা আগাম মহাজন দেয়। বদলে মধু, চাক সবই মহাজনের।
“রাতের আন্ধাইরে ঠাউর হয় না ভালা...”
স্বগতোক্তি করে পিয়াল শেখ টেমিটায় রেড়ির তেল ঢালে আরেকটু।
“আনোয়ার ভাই, জলদি করবানা, হালার পুতগো সইখ্যে আইলে এক্কেরে বাদায় গোর দিব গুসল না করাইয়া।”
পিয়াল শেখ আনোয়ারের সম্বন্ধী। পুরাতন, ছোট্ট জেলে ডিঙিখানা মাত্র সম্বল করে পারমিট ছাড়া, অস্ত্র ছাড়া এই দক্ষিণ রায়ের রাজত্বে মধুর খোঁজে আসা ব্যতীত আর কোনও উপায় আল্লা রাখেননি।
কাদা জলে তড়াক লাফে নেমে ডিঙি ঠেলে গরান গাছের আড়ালে লুকোয় আনোয়ার। পিয়াল শেখ টেমিটা নেভায়। ভোরের আলো ফুটছে। জলে পা রাখতেই শরীর শীতল লাগে পিয়ালের। গেল বার কামঠে আঙুল খেয়েছে পায়ের। ডিঙিটা ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে রেখে দা-টা হাতে নিয়ে এগিয়ে চলে দু'জনে।
বনে বনদস্যু, বাঘ, জলে জলদস্যু, কুমির, ফরেস্টের সেপাই, জলের সেপাই সবার ভয় ছাপিয়ে যে রাক্ষসের ভয়টা জেগে ওঠে তার নাম খিদে।
আধক্রোশটাক এসেছে কি আসেনি, পিয়াল শেখ দা-টা শক্ত করে ধরল। অনেকক্ষণ থেকেই তার জঙ্গুলে মন গতিক ভাল বুঝছে না। পাশের ঝোপের আড়ালে কী যেন একটা নজর পেতে রেখেছে। চোখ চারিয়ে সোজা গাছ খুঁজছিল পিয়াল, লক্ষণ ভাল ঠেকছে না... গাছে উঠে বসা যাক। তিনি সোজা গাছ বাইতে পারেন না।
গাছ বেছে আনোয়ারকে
হাঁক পাড়তে যাবে, ঠিক সেই সময়েই যমদূতের মতো তিনি এলেন।
পিয়ালের চোখের সামনেই আনোয়ারের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন বনবিবির বাহন। আকস্মিকতা
কাটিয়ে মুহূর্তে হাতের দা টা ছুঁড়ে মারল পিয়াল। পড়বি তো পড় মোক্ষম ঘা ঠিক পিছন
পায়ে। জঙ্গল কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে আহত বাঘ দা গাঁথা অবস্থা তেই মিলিয়ে গেল জঙ্গলে।
কাছে গিয়ে নাকে
হাত দিয়ে দেখে শ্বাস চলছে তখনও। পিরানীর পুজো মানত করে সেজদা করে পিয়াল। পাশে পড়ে
থাকা আনোয়ারের দা খানা কুড়িয়ে নিয়ে আঙ্গুলহীন পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে আনোয়ার কে নিয়ে এসে
ডিঙিতে ফেলে। আনোয়ারের দাবনা থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তে কষে গামছাটা বেঁধে গলুই তে বসে
একটা বিড়ি ধরায়।
জানে
বাঁচলেও আনোয়ার যে কাজে কম্মে আর লাগবে না তা বেশ বুঝতে
পারছে পিয়াল শেখ। সাজোয়ান শরীরে মরণ নিয়ে বেঁচে লাভ কি! এর চেয়ে বাদায় পুঁতে একাই
বাড়ি ফিরলে কেমন হয়!
পরক্ষণে
বোনটার মুখখানা মনে পড়ে। বাঘবেওয়াদের নেকা করেনে কেউ। বাদাবনে একঘরে করে রাখে
সবাই।
সাতপাঁচ
ভেবে হাতের বিড়িটা ফেলে বৈঠা হাতে নেয় পিয়াল। আনোয়ার গুঙিয়ে ওঠে, “পানি...
এট্টু পানি দাবানা ভাইজান...”
।। ২ ।।
চুনো
মাছের ঝালটা দিয়ে ভাতটা মেখে বেশ করে গুমো লঙ্কা চটকে নেয় খাদিজা। সপ সপ গরাস তোলে
মুখে। ঝালে জিভ জ্বলে। ঢকঢক জল খায়। আবার ভাত..আবার জল..যতক্ষণ না সারাদিনের খিদে
মিটছে,
যতক্ষণ
না পেট টা ভাতে জলে ভরে যাচ্ছে খেয়ে যায় খাদিজা। দেখে মনে হয় সারাদিন এই
খাওয়াটুকুর অপেক্ষায় থাকে সে।
দাওয়ায় পা ছড়িয়ে
বসে অপলক দেখতে থাকে আনোয়ার শেখ। ভূতের খাটনি খাটে বৌ'টা। পরের
জমিনে মুনিষের কাজ, জাড়ের কালে পরের চাল ছাওয়ার কাজ, যেদিন যা
জোটে। ভোররাতে মীন ধরতে বেরোয় একলাটি। গলা জলে জাল টানে। সেই সাঁঝের সময়ে দুটি ভাত
জোটে। ‘আপন গতর খাটানো ট্যাহার ভাত’। পিয়াল শেখ শুনিয়ে যায়।
আনোয়ার
শেখ খুঁতো মানুষ। আনোয়ারের বিবিকে ভাত দ্যাবার ক্ষমতা আল্লা কেড়ে নিয়েছেন।
দালালেরা ছোঁক ছোঁক করে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাবার জন্য। সেইসব ছায়ামূর্তি খুব চেনে
আনোয়ার। খুব চেনা কেউ হলে বা পিয়ালের পরিচিত কেউ হলে যায় বটে ইন্ডিয়ায়। সে খুব
দূরে না। এই নদীর ওপারের মাইল খানেকের মধ্যেই। দিনে গিয়ে দিনেই ফেরে। খুব রাত হলে
যদি না ফেরে,
বড়
ডর লাগে আনোয়ারের। যতক্ষণ না ফেরে দ্যাহে রক্ত শুকিয়ে যায়। মনে হয় ছুটে গিয়ে ঘর
তোলপাড় করে দেয়। লণ্ডভণ্ড করে দেয় সব। দিন দুই আগেই তো শাদীবাড়িতে কাজে গিয়েছিল
পিয়ালের সঙ্গে।
পিয়াল
এসে বলল দু'দিন পরে
ফিরবে। মোটা টাকার কাজ। দিন পনেরো ঘরে বসে থাকতে পারবে এরপর।
ঘরের আশেপাশে
নারীমাংস লোভী নেকড়েরা ওত পাতে। আনোয়ার বুঝতে পারে সবই। পিয়াল শেখ শুনিয়ে গেছে দশ
হাজার দেন মোহর দিয়ে খাদিজাকে নেকা করার লোকের অভাব নাই। বেওয়া তো নয়...
কলিজায় কালসাপ
দংশায়। মুখটা বেঁকে যায় আনোয়ারের। প্রবল আক্রোশে স্থবির হয়ে যাওয়া পা দুটোয় কিল
মারতে থাকে আনোয়ার।
“হারামজাদী, নাপাক
মাইয়ামানুষ,
সারাদিন
মরদের গায়ে লাইগ্যা কাম করস, শরম নাই? জাহান্নামি
মাইয়া তর মুখ দেখা হারাম। মর মাগী মর... মইরতে পারস না?”
খাদিজার তাপ
উত্তাপ নেই। একমনে থালা চাটে সে। সানকির পাশে পড়ে থাকা ভাত আঙুল দিয়ে তুলে তুলে
খায়। উত্তর না পেয়ে খানিকক্ষণ বাদে ডুকরে কেঁদে ওঠে আনোয়ার।
“আল্লা আমায় পুরাই
মাইরা ফালায়নাই ক্যান? হা বনবিবি ক্যান বাঁচাইয়া রাখো?”
এনামেলের সানকি
খানা মেজে থুয়ে ইউনানি হেকিমের তেলখানা গরম করে আনে খাদিজা। আনোয়ারের পাশে বসে
নিস্তেজ অঙ্গে পরম মমতায় মালিশ করতে থাকে। মনে মনে আল্লার কাছে আনোয়ারের দরাজ
হায়াত কামনা করে। আনোয়ার জানতেও পারেনা।
“পানি খাবা আনোয়ার? বেশি নাই।
পোয়াটাক আসে।
খাবার
পানি নাই,
প্যাটের
ভাত নাই,
কাপড়
নাই,
কুপি
জ্বালাইব ত্যাল নাই, কাম না করলে, চলবে
ক্যামনে আনোয়ার?
তরে
ভাত দিমুনা ক...”
“তুই গার্ড বাবুর
ঘরকে পানি চাইতে ক্যান যাস? শোনলম নজর ভালানা।”
“কুয়া শুকাইসে, পানি পাবো
কোথা?”
জলে ঘেরা জঙ্গলে
খাবার জল বড়ই অপ্রতুল। সিনিয়র কোস্টগার্ডের কোয়ার্টারে সোলার বেস ফিল্টারে খানিকটা
জল খাবার উপযোগী করা হয়। খাদিজা এবং বাকিরা সেখান থেকেই অল্প চেয়ে আনে উপায়ান্তর
না দেখে। তাতেই আনোয়ারের রাগ। খাদিজা ইন্ডিয়ায় গেলে রাগ। গেরাম পেরিয়ে শহরে যাবার
কথা ভাইজান বললেও না করে দিয়েছে খাদিজা। আনোয়ার রাগ করবে। নিজের অক্ষমতার উপর রাগ।
এর চেয়ে বাঘের পেটে গেলে হয়ত মরে বাঁচত লোকটা। আঁচলে চোখ মোছে খাদিজা।
।। ৩।।
ছইয়ের
ভেতর বসে আঁচল ঢাকা দিয়ে একফোঁটা খোকাকে দুধ দিচ্ছিল বউ’টা। এক গা গয়নায় জড়ভরত বউ।
তুলনায় বরটাকে বেশ একালের মনে হল কাঁকনের। ধুতি পরা লোকটা সম্ভবত বউটার বাবা।
লোকটা যা বলছে তাতেই বর বাবাজি হুঁ হুঁ করে যাচ্ছে।
সাড়ে পাঁচটার
খেয়াটা না পেলে আজ কপালে দুর্গতি ছিল। এক তো এদিককার রাস্তাঘাট একেবারে অচেনা, তার উপর
নদীর ওপারে ছিটে জঙ্গলের রাজত্ব খানিক পর থেকেই। কী প্রাণ হাতে করেই না নেমন্তন্ন
রক্ষা করতে আসা,
মা
গো!
নভেম্বরের বিকেল।
ঝুপ করে সন্ধে নামতেই মাঝি হ্যারিকেন'টার বাতি বাড়িয়ে
দিল। সেদিকে তাকিয়ে ছেলেটা বলল, “দিনের দিন বেরোলেই ভাল হত...”
সে
কথা সম্ভবত মেয়ের বাপের পছন্দ হয়নি। তিনি বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছেন তাহলে বরং
ওপারে ফিরতি খেয়ায় আজ ফিরেই আসা হোক। কাল সকালে চাট্টি ভাতে ভাত খেয়ে না হয়...
তাতে
ছেলেটা আরোই হাঁই হাঁই করে উঠল। ভাত খেয়ে উঠতে গিয়ে তো এই হল। দেড় ঘন্টার মোটর
ভ্যান ঠেঙিয়ে আসতে আসতেই বেলা কাবার।
হাসি পেয়ে গেল
কাঁকনের। দেশ গাঁয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে ছেলেটা একেবারেই খুশি নয় মনে হয়। উল্টো দিকে
মুখ ফিরিয়ে দেখে আধখানা চাঁদের আলোয় ঠাউরানির চরে বেশ রূপ খুলেছে। যদিও ভটভটির
আওয়াজে সেরকম রোম্যান্টিক পরিবেশ নেই। ছেলেটির তাড়ায় মাঝি হাতল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন
দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে তার উপর। তবু মাঝে মাঝে ইঞ্জিন থামলে ছল ছল নদীর সুর শুনতে
মন্দ লাগছে না।
মোটর ভ্যানে
সুরকির রাস্তায় আসতে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে যাবার যোগাড় হয়েছিল। তিনদিন ধরে বেদম মুরগী
জবাই আর বাদশাই খানা খেয়ে খেয়ে যা পেটে জমে ছিল, তিনবার
রাস্তায় বমি করে করে সব এই চরেই রেখে এসেছে। রাস্তায় খাবার জন্য সায়লার বাড়ি থেকে
তিনজনের খোরাকের মত চালের রুটি আর মাংস দিয়েছে। এই নৌকোর দুলুনিতে আর সেসব বের
করার হ্যাপা করে কাজ নেই। বাসে উঠে খেয়ে নেবে'খন।
।। ৪।।
ছলাৎ-ছল
জলের শব্দে আর শ্বশুর জামাইয়ের একঘেঁয়ে বাগ-বিতণ্ডায় সময় কাটছিল কোনক্রমে। কী রকম
অদ্ভুত নিশুতি চারিদিকে! সন্ধে আর মাঝরাতে যেন তফাৎ নেই একটুও। এই বেশ চাঁদ ছিল, সেও হঠাৎ
আসা মেঘে সেঁধিয়েছে মনে হয়।
বুকের কাছে ব্যাগ’টা
চেপে বসে ছিল কাঁকন। খোকা ঘুমোতে মেয়েটা পাশের ব্যাগটা থেকে ঠোঙায় করে বাবা'কে আর বর'কে খাবার
দিল। কাঁকনের সেই দেখে পেট'টা আবার খালি হয়ে উঠল কেমন। মেয়েটা
ঠোঙায় করে ওর দিকেও খাবার বাড়িয়ে দিল হেসে। কাঁকন মৃদু আপত্তি জানালেও নিয়ে নিল।
খিদেও তো কম পায়নি। মেয়েটির বড় মিষ্টি হাসি। কথা কম বলে, অথচ
হাসিটাই এমন মনকাড়া যেন কতদিনের চেনা আপনজন।
খাবারের সূত্রেই
পরিবারটার সাথে আলাপচারিতা বেড়ে উঠল। মেয়েটির বাপের বাড়ি এখান থেকেও মাইল দশেক
ভেতরে। মামার বাড়ি ফ্রেজারগঞ্জ। সেখানেই বিয়ে টিয়ে হয়েছিল। বর বাবাজি নিজেই বলল যে
সে মোটেই শ্বশুরবাড়ির ধারপাশ মাড়াতে চায়না। ছেলে হতে মুখে ভাতের পর একবার মামার
ভাত খাওয়াতে নিয়ে আসা। নেহাৎ জরুরী না হলে এবারেও তাকে এই জল জঙ্গলের দেশে আনার
উপায় ছিলনা মোটেই। ছেলেটি কলকাতায় চাকরি বাকরি করে সম্ভবতঃ। বারাসাত অঞ্চলের
বাসিন্দা।
বোঝাই গেল বাপের
বাড়ি আসতে না পারায় মেয়েটির চাপা অভিমান রয়েছে বরের উপর।
বেশ লঘু চালে
মস্করা চলছিল নতুন আলাপ হওয়া দম্পতির সঙ্গে, এমন সময়
মাঝি নৌকো ঘুরিয়ে মোটর বন্ধ করে দিল। এ কী! পাড়ের প্রায় কাছেই চলে এসে নৌকো
ঘোরানোর মানে কি!
ছেলেটির
তাড়া সবচেয়ে বেশি। সে রেগে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আর কী মাঝির গায়ে। ভদ্রলোক নাতিকে
কোলে নিয়ে ছইয়ের ভেতর বসে ছিলেন, তিনিও মুখ বাড়ালেন। মাঝি দুজন ঠোঁটে
আঙুল চাপা দিল। ছেলেটির চোখে স্পষ্ট উষ্মা। কী কারণে পাড়ের কাছে এসে ঘোরানো হল
নৌকার মুখ! ইঞ্জিন বন্ধ, সে না হয় এইটুকু বৈঠা বেয়ে নেওয়াই
যায়।
বুড়ো মাঝি খুব
আস্তে আস্তে সঙ্গীকে বলল নৌকো মাঝ নদীতেই নোঙর করতে। কাঁকন ব্যাগটা টেনে আর একটু
ছইয়ের কাছে ঘেঁসে বসল। কী হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি ফিস ফিস করে কাঁকনের
কানে বলল,
“এরা
ডাকাত নয় তো!”
বুকটা ধড়াস করে
উঠল কাঁকনের। তার কাছে মূল্যবান কিছুই সেরকম নেই যদিও। কিন্তু তাতে কী! আস্ত সে
মানুষটাই কি কম মূল্যবান! এদিক থেকে কত মেয়েই তো পাচার টাচার হয় শুনেছে। মেয়েটির
সঙ্গে না হয় বাবা রয়েছে, বর রয়েছে; সে যে
একেবারে একা। কী মনে হতে ব্যাগ থেকে ফোন’টা বের করল কাঁকন।
বুড়ো
মাঝি’টা লুঙ্গি ভাঁজ করে তুলে এদিকেই এগিয়ে আসছে। চার জোড়া ভয়ার্ত, জিজ্ঞাসু
চোখের সামনে হাত জোড় করে বসল সে।
।। ৫।।
কাঁকন
সায়লার নম্বর ডায়াল করার সুযোগ পেল না, বদলে ব্যাগের হাতল’টাই
আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে চেপে ধরেছিল। বিপদকালে ব্যাগ দিয়েই যতটা কুস্তি লড়া
সম্ভব আর কী। এখন মাঝি'কে উবু হয়ে বসতে দেখে থতমত খেয়ে
গেল। মাঝি হাতের ইশারায় ছেলেটিকেও বসতে বলল। তারপর খুব ফিসফিসিয়ে বলা শুরু করল,
“আজ্ঞে বাবু আমারে
মাপ করেন,
এদানি
খেয়া বাইতিচি বটে তবে চরের লোকে আমারে বাউলে বলেই চেনে। এখুনো মাজেমদ্যি সে'রম টাকা
পেলে মোয়াল'দের সাথে
যাই ধুলো পড়তে। এ আমাদের বাপ পিতেমো'র শিকিয়ে যাওয়া
গুরুমন্তর বাবু। কানে কানে বলতি হয়। বাপেরে তার বাপ, তার
বাপেরে তার বাপ কানে দেচে। আমার বাউলে মন বলতেচে এ হাওয়ার
গতিক বড় সুবিদের না। দেকতেচেন না একটা পোকা মাকড় ওব্দি আওয়াজ করতেচেনে...”
কাঁকন এবং বাকি
তিনজনেই ঊর্ধ্বাকাশে মুখ তুলে চাইল। হাওয়ার গতিক সুবিধার না মানে! দিব্য মেঘ সরে
চাঁদ ফটফটিয়ে আকাশে রয়েছে। অসুবিধের কী! হ্যাঁ বড্ড বেশি রকম চুপচাপ তা ঠিক যদিও।
কিন্তু
আবহাওয়া সঠিক না হলে মাঝ-নদীতে নোঙর ফেলে বসে রইবার কী আছে সেটাও বোঝা যাচ্ছেনা।
মাঝি মনে হয় সে-কথা বুঝে ফেলেই বলা শুরু করল,
“বাবুরা সেই
হাওয়ার কতা কইনি গো। তেনার কথা কইতিচি। বড় মেঞা গো। এই চরে জন-মনিষের তো কমতি নেই।
তাও আমার এরম শরীলে কাঁটা দেতেচে কেন ভেবে পাইনে। আজ কাউরে চরেও দেখতেচিনে। কাল দে
শুনতিচি তিনি এয়েচেন। সকালেও তো খেয়া নে এলাম। ত্যাকনও তো মন'টা এরম
কু-ডাক দেয়নে।”
মাঝি
বলতে বলতেই দাঁড়িয়ে পড়ে কাঁধে গামছাখানা ফেলে চিন্তিত মুখে চন্ডী'তে গিয়ে
বসল।
“আপনেরা গলুইয়ে
গিয়ে বসেন সবাই। আমি জঙ্গল বাঁধার মন্তরখানা আউড়ে নিই। এইখান থেকে এক পা আর আমি
এগুতে লারব বাবু। আমারে মাপ করেন। মা জননী খোকারে শান্ত রাখেন একটু। আমারে গতিক
বুজতে দ্যান।”
কাঁকন চেন খুলে
ফোন'টা ব্যাগে
ভরে হামা দিয়ে ছইয়ের ভেতরে গিয়ে বসল। চার-চারজন বড় মানুষের বসার পর্যাপ্ত জায়গা
নেই। তবু উপায় কী! ছেলেটি ভয় পাবার থেকেও ভয়ানক বিরক্ত। বিড়বিড় করে সে শ্বশুরকে
কিছু বলতে না পেরে বউকেই ধমকে চলেছে। শ্বশুরমশাই খানিক স্তোক দেবার চেষ্টা করে চুপ
মেরে গেছেন।
এর
মধ্যেই অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্য চিরে হঠাৎই খোকা কেঁদে উঠল। চমকে উঠল কাঁকন।
।। ৬।।
মাঝি
উবু হয়ে বসে নজরদারি চালাচ্ছিল চরের দিকে, সন্ত্রস্ত
হয়ে এদিকে তাকাল। চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। বাচ্চাটা তখনও কেঁদেই চলেছে।
মেয়েটি পিঠ চাপড়েও
কাজ না হতে পেছন দিকে ফিরে বাচ্চাটাকে শান্ত করার চেষ্টায় বুকে নিয়ে আঁচল ঢেকে দুধ
চেপে ধরল মুখে। তাতেও চাপা গোঁ গোঁ থামছে না তার। কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে মনে হয়।
শিশুর কান্নার সব কারণ কি বড়’রা বোঝে!
পাড় থেকে প্রায়
হাত তিরিশেক দূরে নৌকো দাঁড়িয়ে। বেজায় মশা কামড়াচ্ছিল কাঁকনকে। কী ঝামেলাতেই না
পড়ল এসে! কাল দুপুরে অফিসে মিটিং আছে একটা। বিকেলেই ট্যালেন্ট হান্ট থেকে রাতারাতি
ফেমাস হয়ে যাওয়া তারকা এক গাইয়ের সঙ্গে ইন্টারভিউ ফিক্স করে দিয়েছে দয়িতাদি। তার
হোমওয়ার্কও কিছু করা হয়নি। এ-ক'দিন বিয়েবাড়ি করেই কেটে গেছে। অফিসে
সায়লা নেই। আপুর বিয়ের জন্যে পনেরো দিনের ব্রেক নিয়েছে। এই বীভৎস জায়গায় কেউ আসতে
চায়নি দেখে উইক অফের দুটো দিন আর সঙ্গের একটা লিভ নিয়ে কাঁকনই অগত্যা এসে হাজির
হয়েছিল। এই বিপদে পড়বে কে জানত!
ছেলেটা এতটাই
বিরক্ত যে পারলে মাঝিকে ঠেলে ফেলে নিজেই নৌকো ঠেলে পাড়ে নিয়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরেই
সে অসহিষ্ণু হয়ে বিড়বিড় করছে। এবার মাঝির সতর্কতার তোয়াক্কা না করেই চিৎকার করে
নোঙর তুলতে বলল।
কাঁকনেরও রাগ
হচ্ছিল। সন্ধে পেরিয়ে এখন রাত প্রায় ন'টা ছুঁই
ছুঁই। বাথরুম পেয়েছে। এখন পাড়ে নেমেও কিছুই পাবার উপায় নেই শহরে যাবার জন্যে। এই
গ্রাম্য বুজরুকিতে মাঝনদীতে সারারাত যদি দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মরেই যাবে ও। সঙ্গে শিশু
রয়েছে। এরা যেন কেমন! পৃথিবী পৃথিবীর মত চলছে আর এই প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা এখনও
নিজেদের অযৌক্তিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে পড়ে আছে। জঙ্গল বাঁধবে নাকি! হুঁহ...
কস্মিনকালেও সায়লা
বলেনি ও বাঘ দেখেছে। অত ভেতরেই নেই, তো এখানে কীসের জন্যে আসবে!
সামনাসামনি বাঘ দেখার উত্তেজনা প্রথমে অল্প বিস্তর হচ্ছিল না যে একেবারে তা না, তবে এখন
সেসব ছাপিয়ে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। বোতল থেকে জল বের করে মুখে
চোখে জলের ঝাপটা দিল কাঁকন। হঠাৎ মনে পড়ল সেই মেয়েটার কথা। কী যেন নাম ছিল
মেয়েটার!
খাদিজা...
তার বরকেই নাকি
বাঘে ধরেছিল। মেয়েটার কথা শুনে তো এই অঞ্চলের লাগল না। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছিল।
ভাল স্টোরি পাবে ভেবে সাংবাদিক সুলভ কৌতুহলে দু-এক বার আলাপ জমাতে গেছে কাঁকন। লাভ
হয়নি। কঠিন জিনিস...
চোরাগোপ্তা এ-দেশে
এসে কাজ করে বলে এরা এমনিই ভয়ে ভয়ে থাকে। তবে সায়লা'কে একদিন
কী কথায় “সুন্দরবনে থাকিস, অথচ বাঘ তো দূর একটা শেয়াল অবধি
দেখালি না” বলতে খাদিজা বিশ্রীভাবে তাকিয়েছিল, মনে আছে
কাঁকনের। তাকিয়েই ছিল। কী হাড় হিম করা চাউনি রে বাবা!
ছেলেটি সমানে তর্ক
করে চলেছে মাঝির সঙ্গে। মাঝি মিনমিন করে বলছিল ধানক্ষেতে নাকি পায়ের ছাপ দেখেছে
এলাকার লোকে গত পরশু।
সেই ছাপ বেশিদূর
যায়নি,
হঠাৎই
উধাও হয়ে গেছে।
তারপর
থেকে মানুষের পায়ের ছাপ। এরকম নাকি মানুষেও বাঘ হয়ে যায়। বাংলাদেশ থেকে জল পেরিয়েও
বাঘ আসতে পারে। তার নাকি বাঘতাড়া বর্ম রয়েছে বলেই এতক্ষনে বড়মিঞা টেরটি পায়নি
হ্যান ত্যান।
এসব শুনে ছেলেটি
আরও রেগেমেগে অস্থির। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করতে শুরু করতে মেয়েটির
বাবা এগিয়ে গেল থামাতে। মাঝি কাঁকনের দিকে ফিরে বলল,
“আবনারা বাবুরে
বোজান। আমি ফরেস পিটালের নৌকার ঝন্যি দেঁইরে আচি তকন থে। ওদের কাছে নিঁদালু বন্দুক
থাকে। আমারে চেনে বাবু। বললে আবনাদের ফোড়ন খাল বেয়ে সেপ জায়গায় পৌঁচে থুয়ে আসবে।”
আর
একটু থেমে কাঁকনের দিকে মুখ বাড়িয়ে বলল,
“পেচনের
পায়ের ছাপ চোটের। এ'রম চেহ্ন ভালো নয় গো দিদিমনি। ব্যাটা
আদমখোর এ আমি লিচ্চয় জানি।”
ছেলেটি ফোনের
নেটওয়ার্ক পায়নি। তাতে রাগ আরো বেড়েছে বরং। কাঁকন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে কেমন।
বাংলাদেশ থেকে সাঁতার কেটে বাঘ চলে আসবে!
ছেলেটার
জোরাজুরিতে অবশেষে মাঝি নৌকো নোঙর তুলতে রাজি হল। তবে একটা শর্তে। এই চরে নৌকো না
লাগিয়ে খানিক এগিয়ে ডকের পাঁক চরে লাগাবে। পাঁকে পা ডোবার ভয়ে সচরাচর বাঘ নামে না।
পাটাতন নামিয়ে নামলেও হাঁটু ওব্দি কাদামাখা হবার ভয় রয়েছে। একটু লোকালয় রয়েছে এমন
জায়গা দেখেই নামাবে।
কাঁকনের অন্য
চিন্তা শুরু হল। এদের চেনাজানা মানুষ আছে সম্ভবত কাছে পিঠে। কাঁকন কোথায় থাকবে এই
রাতে! মেয়েটি সে’কথা বুঝে নিয়ে নাকি কে জানে কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “ভয় কী! আজ
রাতটা আমাদের সঙ্গেই রয়ে যেও।”
মেয়েটিকে আগাগোড়াই
অদ্ভুত লাগছে কাঁকনের। ছেলেটি যত অধৈর্য, মেয়েটি এক্কেবারে
বিপরীত। কয়েক ঘন্টায় এমন কোনো অনুভূতি নেই যা কাঁকনের হয়নি। অথচ মেয়েটি তারই বয়েসী
হয়েও অদ্ভুত নির্লিপ্ত। খিদে পেতেই খাবার এগিয়ে দিচ্ছে, রাতে
থাকার চিন্তা হতে সেটাও বুঝে নিল..
নাহ্!
এ চত্বরে সব মানুষজনই ওই ধুলোপড়া বিদ্যে না কি তাই জানে মনে হয়। বাড়ি ফিরে এই নিয়ে
একটা জমাটি আর্টিকেল লিখতে হবে। এই অঞ্চলে থেকেও সায়লা এই নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য
করেনি আজ অবধি। অবশ্য ও থাকেই বা কতটুকু!
।। ৭।।
নৌকা
বাওয়া শুরু হতেও যেন মাঝির হাত চলে না। আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল যা হোক। মেয়েটির
বাবা কাঁকন'কে
চুপিচুপি জামাইয়ের কান এড়িয়ে বললেন,
“বাউলে বলছিল যখন, একটা রাত
কোনক্রমে নৌকোয় কাটিয়ে সকালে ফরেস্ট প্যাট্রোলের ভটভটি এলেই না হয় যাওয়া হত! তোমরা
এখনকার ছেলে মেয়ে। কিছুতেই পাত্তা দাও না। আমারই ভুল এদের নিয়ে দুপুর গড়িয়ে বেরিয়ে
আসা। এখন বিবির কৃপায় উদ্ধার হলে বাঁচি...”
মাঝিও তার স্যাঙাত’কে
আজগুবি গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। মানুষ বাঘের পেটে গেলে নাকি বেঘোভূত হয়ে রাতের পথে পাক
খাইয়ে নির্জনে নিয়ে গিয়ে মেরে খায়। এত ক্লান্তির মাঝেও হাসি পেয়ে গেল কাঁকনের।
নরশার্দূলের কথা শুনেছে বটে সে'ও। বলিউডি মুভিও তো রয়েছে। সে অবশ্য
ভূত না। কে জানে সেই দেখেই এসব গপ্প ফাঁদছে নাকি লোকটা। গ্রাম্য মানুষ, আর কী'ই বা আছে
এদের এসব ছাড়া। যা-হোক দুটো পয়সা পায় ভয় দেখিয়ে।
কিন্তু
এই চরে এখন নৌকো দাঁড়াবেই বা কোথায়! হেঁতালের ঝোপের
সার তো!
চাঁদের
আলো পড়ে বেশ ঝকঝক করছে নদী। জ্যোৎস্না ধোয়া জঙ্গুলে রাত্রি ঘিরে ধরেছে।
মাঝি বলল
বড় মিঞা এমন পিছু ধাওয়া করে করে মাইলের পর মাইল শিকার টেনে নিয়ে যেতে পারে নাকি।
তারপর অতর্কিতে এসে পড়বে। আচ্ছা আচ্ছা সা-জোয়ান টেনে নিয়ে মুহূর্তে মিলিয়ে যাবে।
মেয়েটির বাবা
নামার জন্যে চর খুঁজছিলেন বসতি দেখে। খুব দূরে হলে আবার মুশকিল। এর মধ্যে মেয়েটি
ব্যাগ থেকে শুকনো খাবার বের করে আবার ওদের দিকে বাড়িয়ে দিল। কাঁকনের এতক্ষণ বাদে
সায়লার মায়ের পাঠানো খাবারের কথা মনে পড়তে ব্যাগ থেকে কৌটো গুলো বের করে ভাগ করে
নিলো সহযাত্রীদের সঙ্গে।
এতক্ষণ খিদেবোধ
ছিল না। এখন খাবার দেখেই মনে হয় পেটে ছুঁচোর ডন-বৈঠক শুরু হল। সবে মুখে রুটিটা
দিয়েছে,
অদ্ভুত
সুরে কিছু একটা ডেকে উঠল। মাঝি এতক্ষণ মোটর চালায়নি। কেন কে জানে, তড়িঘড়ি
বৈঠা তুলে হাতল ঘোরাতে গেল। চর থেকে বেশি দূরে নেই আর। এমন সময় নতুন করে মোটর
চালানোর কী আছে। হতভম্ব হয়ে গেছে কাঁকন। মেয়েটির বাবা বললেন, “ফেউ
ডাকছে,
মাঝি
নৌকা ওই পাড়ে নিয়ে চল জলদি। এখানে এক মুহূর্ত না আর। মোটর চালাও...”
সেই মুহূর্তেই
ঝপাং করে জলে কিছু একটা পড়ল মনে হল।
“পালাতে হবে বাবু।
পালাতে হবে। গলুইয়ে গিয়ে সাপটে বসুন। আমি ওই পাড়ে নে যাই।”
কিছু একটা ছিল
মাঝির স্বরে। এতক্ষণ হম্বিতম্বি করলেও এইবার আর ছেলেটির গলা উঠল না। চাঁদের আলোয়
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিছু একটা ধেয়ে আসছে নৌকোর দিকে। স্যাঙাত একা হাতে নৌকো ঘোরাতে
পারছে না। এদিকে মোটরও স্টার্ট নিচ্ছে না। মেয়েটির বাবা ছইয়ে বসতে পারেননি, আর জায়গা
ছিল না। হঠাৎই নৌকো একদিকে হেলে গেল কীরকম। প্রাণপণে পাটাতন ধরে বসে আছে কাঁকন।
মাঝি মোটরের হাতল ছেড়ে বসে বৈঠা হাতে উঁচিয়ে কী করছে ওটা! দু-চোখে যেন ঘোর লেগে
গেল কাঁকনের।
ফোঁত ফোঁত করে
আওয়াজে মুহূর্তকাল তাকিয়ে দেখেই বুকের রক্ত শুকিয়ে গেল । মনে হল চেতনা এখানেই লোপ
পাবে তার। অর্ধেক শরীর তার নৌকায়, বাকিটা জলে। চাঁদের আলোয়
ঝিলিক
দিয়ে উঠল শ্বদন্ত। সাথে গগনভেদী হুঙ্কার। থাবার আঘাতে পড়ে গিয়ে মেয়েটির বাবা
হামাগুড়ি দিয়ে ছইয়ের ভেতরে ঢুকে আসতে চেয়েও পারলেন না। কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই
বাঘ'টা ঘাড়
ধরে জলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল ওঁকে। মুহূর্তের বোবাভাব কাটিয়ে “বাবা গো...” বলে
তীরের মত ছিটকে জলে পড়ল মেয়েটি'ও।
ঈশ্বর জানেন কেন
কাঁকন এক হাত দিয়ে পাটাতন ধরে আরেক হাতে মেয়েটির কোল থেকে ছিনিয়ে নিল শিশুটিকে।
হয়তো মেয়েটির হাত ধরলে মেয়েটি জলে পড়ত না কিন্তু ছিটকে জলে পড়ত কোলের শিশুটি।
নিজের সম ওজনের কাউকে ধরার শারীরিক ক্ষমতাও হয়ত সেই মুহূর্তে জোগাড় করে উঠতে
পারেনি কাঁকন। জানে না সে। সত্যিই জানে না।
ছেলেটিও ঝাঁপ দিতে
গেলে মাঝি লাফ দিয়ে এসে জোরসে আঁকড়ে ধরে রইল। ছইয়ের এক কোণে পুঁটলির মত বাচ্চাটাকে
চেপে ধরে কুঁকড়ে বসে আছে কাঁকন। পাটাতন ধরে পাগলের মত তীব্র চিৎকার করে যাচ্ছে
ছেলেটি। মাঝি আর স্যাঙাত মিলে দাঁড় দিয়ে জল ঠেলছে দ্রুত। এখন ছেলেটিকে থামাবার সময়
নেই তাদের।
জলের কোথাও
মেয়েটির চিহ্ন নেই। দু-দুটো মানুষের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পরেও নদী আপন খেয়ালে ধীর
লয়ে বয়ে চলেছে। নৌকোর উপরে কাঁপছে সবাই তখনও। কাঁকনের বুকের মধ্যে জাপটে
ধরা
শিশুটিকে দেখে চিৎকার থামিয়ে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল ছেলেটি।
ততক্ষণে মোটর চালু
করেছে মাঝির স্যাঙাত। রাতের নদী পেরিয়ে, মৃত্যু উপত্যকা
পেরিয়ে ছুটে চলেছে নৌকা। গন্তব্য এখনও স্থির করা হয়নি কারোরই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন