‘ক্যাপ্টেন তুমি কিচ্ছু বোঝোনি।’
‘ক্যাপ্টেন তুমি কিচ্ছু বোঝোনি।’
টিনটিনে জাতিবিদ্বেষ? সত্যি?
২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা এগমন্ট একটি বই প্রকাশ করেন। বইটি বিগত প্রায় পঞ্চান্ন বছর ধরে নিষিদ্ধ ছিল। বইটির সঙ্গে তারা একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনটিতে বলা হয় যে, এই বইটি কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যই। বইটিতে বুর্জোয়া এবং পিতৃতান্ত্রিক স্টিরিয়োটাইপ রয়েছে এমন মুচলেকাও দেওয়া হয়।
২০০৭ সালে বেলজিয়ামে বিয়েনভেনু মন্দোন্দো
নামের এক আফ্রিকান-বেলিজিয়ান নাগরিক কোর্টে যান এই বইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে।
২০১৯ সালে এই বইটির বিশেষ ‘ডিজিটাল-এডিশন’
প্রকাশ করা হয়। তখনও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এমন বাঙালি পাঠক বোধহয় কম আছেন যিনি এই
বইটি পড়েননি। বইটির নাম ‘কঙ্গোয় টিনটিন’! এমন একটি বই যা আপাদমস্তক বর্ণবিদ্বেষ এ মোড়া।
সাম্রাজ্যবাদী এক ইউরোপিয়ান দেশের প্রোপাগান্ডা করার জন্য বানানো।
টিনটিন? যে টিনটিন বাঙালিকে বিশ্ব চিনিয়েছিল,
যে টিনটিন তার শৈশব-কৈশোরের সঙ্গী, যে টিনটিনের বই পঞ্চাশোর্ধ্ব বাঙালিও হাতের কাছে
পেলেই আবার তাতে বুঁদ হয়ে যায়, তা হোক না সেই বই তার আগেও বার-দশেক পড়া, সেই টিনটিন
বর্ণবিদ্বেষী? সত্যিই তাই? আচ্ছা না হয় তবু তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া গেল যে, হ্যাঁ
‘কঙ্গোয় টিনটিন’ রেসিজমের গুদামঘর। তা হলে এই কমিক্সটিই কি
আর্জের ‘প্রথম এবং একমাত্র ভুল’ এই বলে বিতর্কের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যাবে? যদি দেখি
বাকি কমিক্সগুলোতেও এই বর্ণবৈষম্যের ছাপ রয়েছে?
এই সময় স্বাভাবিকভাবেই এক দ্বিধার জন্ম
হয়। ছোটোবেলায় কাউকে নায়ক বলে ভাবার পর তার যে প্রতিচ্ছবি
মনের মধ্যে তৈরি হয় তা বড়ো বয়সকালেও মানুষ বয়ে নিয়ে বেড়ায়।
কখনও সেই চরিত্রের প্রতি বিরূপ কোনও ভাবনা এলে নিজের সঙ্গেই যেন একটা লড়াই চলে। তাই
যখন এই প্রবন্ধ লেখার কথা ভাবলাম তখন মনে হয়েছিল টিনটিনকে তার নায়কের আসন থেকে সরিয়ে
তার ভিতরের মানুষটার ব্যবচ্ছেদ করতে পারব তো? বাইরের সুন্দর শরীরটাকে ভালোবাসলেও ভিতরের নাড়িভুঁড়ির জটপাকানো তাল দেখতে পেলে নিজেই একটা
অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ব না তো?
তারপর মনে হল ব্যবচ্ছেদটা আসলে সৃষ্টির
হবে না, হবে স্রষ্টার। তাই আর্জে নামের সেই বেলজিয়াম মানুষটির
মনের অলিন্দে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলাম এই প্রবন্ধে। আবার পড়তে শুরু করলাম টিনিটিনের
কমিক্সগুলি, এবারে এক প্রাপ্তবয়ষ্কের অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে,
কৈশোরের সরলরৈখিক কৌতূহলকে যতটা সম্ভব সরিয়ে রেখে।
যে-কোনও শিল্প তার সৃষ্টির সময়ের সাক্ষরকে
বহন করে। কমিক্সও তার ব্যতিক্রম নয়। জর্জ প্রসপার রেমির জন্ম
হয়েছিল ১৯০৭ সালে বেলজিয়াম শহরে। ১৯২৭ সালে কুড়ি বছর বয়সে রেমি যোগ দেন লে ভ্যাঁতিয়েম
সিয়েল (Le Vingtieme Siecle, The twentieth Century) নামের একটি খবরের কাগজে। খবর কাগজটি
চালাতেন নর্বার্ট ওয়ালেজ নামের একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক। তার ডেস্কের উপরে রাখা থাকত
বেনিতো মুসোলিনির ছবি। খবরের কাগজটির মূল ভাবধারার ভিত্তি ছিল তিনটি। সেগুলি হল ফ্যাসিবাদী
সমাজতন্ত্র, বেলজিয়ামের তৎকালীন সাম্রাজবাদ এবং খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্মপ্রচার। এ হেন
খবরের কাগজে ১৯২৮ সাল থেকে প্রতি বৃহষ্পতিবার বেরোতে থাকে ছোটোদের
জন্য একটি সাপ্লিমেন্ট। তার নাম দেওয়া হয় লে পেতি ভ্যাঁতিয়েম (Le Petit Vingtieme,
the Little Twentieth)। রেমির উপরে ভার পড়ল এই সাপ্লিমেন্টের জন্য একটি নতুন কমিক্স
স্ট্রিপ তৈরি করার। জন্ম হল টিনটিন এবং তার পোষা কুকুর মিলো-এর (Milou)। পরবর্তীকালে
এই মিলোর ইংরাজিতে নাম হল স্নোয়ি এবং বাংলা একে আমরা সবাই
চিনি কুট্টুস নামে। নর্বার্ট ওয়ালেজকে পিতার মতো শ্রদ্ধা করতেন রেমি। তাঁর আদর্শে ভীষণভাবে
অনুপ্রাণিত ছিল সেই একুশ বছরের যুবক। ততদিনে রেমি নিজের ছদ্মনামটি ঠিক করে নিয়েছেন,
আর্জে। ওয়ালেজের নির্দেশমতো টিনটিনের প্রথম কমিক্সটির জন্ম
দিলেন আর্জে, ১০ জানুয়ারি ১৯২৯ সাল থেকে তা প্রকাশিত হতে শুরু করল। তরুন রিপোর্টার
টিনটিনের প্রথম অভিযান হল সোভিয়েত দেশে। সোভিয়েত বিরোধী ডানপন্থী চিন্তাধারার চরম প্রোপাগান্ডা
চলল সেই কমিক্সের পাতায় পাতায়। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়ের
বেলজিয়ামে কমিক্সটি চরম জনপ্রিয়তা লাভ করল। বই হিসাবেও বেরোল
সেটি। এই জনপ্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে এবার ওয়ালেজ রেমিকে নির্দেশ দিলেন টিনটিনের পরের অ্যাডভেঞ্জারটি
হোক কঙ্গোয়। আফ্রিকার যে দেশে বিগত ৪৫ বছর ধরে বেলজিয়াম আগ্রাসনের
শিকার। গড়ে উঠেছে কলোনি। তুলো, কফি, কোকো আর রবারের লোভে নির্বিচারে নষ্ট করে ফেলা
হয়েছে মাইলের পর মাইল জঙ্গল, খুন করা হয়েছে কয়েক লক্ষ আফ্রিকান আদিবাসীকে। টিনটিন চলল
সেই আফ্রিকায়। জন্ম হল ‘কঙ্গোয় টিনটিন’-এর।
কঙ্গোয় টিনটিন রেমি দু’বার তৈরি করেছিলেন।
একবার ১৯৩০ সালে, আর-একবার ১৯৪৬-এ। আমরা বাংলায় যে কমিক্সটি
পড়ি তা ১৯৪৬-এর। ১৯৩০-এর কমিক্সটি তা থেকে বেশ কিছু অংশে
আলাদা ছিল। কমিক্সের মূল গল্পটি তো কোনও টিনটিন ফ্যানেরই
আজ আর অজানা নেই। টিনটিন আর কুট্টুস যায় কঙ্গোয়, সেখানে তাদের সাদর আমন্ত্রণ জানানো
হয়। কঙ্গোয় পৌঁছোনোর পর টিনটিন একের পর এক দুঃসাহসিক কাজ করতে থাকে। সে বিভিন্ন হিংস্র
জন্তুর হাত থেকে কুট্টুসকে এবং নিজেকে বাঁচায়, দু’টি আফ্রিকান
আদিবাসী দলের মধ্যের লড়াইকে একার চেষ্টায় আটকায়, তার বিরুদ্ধে হওয়া ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত
করে এবং সব শেষে আমেরিকান গ্যাংস্টার আল কাপোনের হিরে পাচারকারী দলটিকে পুলিশের হাতে
ধরিয়ে দেয়। শিশু-কিশোরের মন জয় করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট কমিক্সটি।
তার পাতায় পাতায় যেমন আছে অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা, তেমনই আছে হাসির উপাদান।
কিশোর মনে এই হাসির জোগান দেওয়ার জন্য
রেমি কী করলেন তা একবার দেখে নেওয়া যাক। এইখানে একটা বেশ ভারী শব্দের সঙ্গে আমাদের
পরিচয় হওয়ার প্রয়োজন আছে। শব্দটি হল ‘এথনোসেন্ট্রিজম’ (Ethnocentrism)। ক্যাপ্টেনের
মুখে অনেক কঠিন কঠিন শব্দ শুনে আমরা অভ্যস্ত। যারা ইংরাজিতে
টিনটিন পড়েছেন তারা জানেন anthracite, aborigine, ectoplasm। কিন্তু ethnocentrism-টা
কী? এর একদম সঠিক বাংলা অর্থ পাওয়া না গেলেও কাছাকাছি যে শব্দটিকে বোধহয় ব্যবহার করা
যায় তা হল ‘স্বজাত্যবোধ’। আবার এই স্বজাত্যবোধ শব্দটিও যেন ঠিক জুতসই নয়।
কোনও একটি জাতি তার নিজের সংস্কৃতি, জীবনধারা
এবং ভাবনার আলোয় অন্য জাতির মূল্যায়ন করে। এই মূল্যায়নের সময় তার নিজের জাতিটি যে তুলনামূলকভাবে
উন্নত এমন বোধের জন্ম হয়। এই এথনোসেন্ট্রিজমের ফলে এক জাতির মানুষ অন্য জাতিকে খুব
সহজেই অবজ্ঞার চোখে দেখতে শুরু করে। যা তার কাছে নতুন তাকেই মনে হয় নিম্নরুচির, মনুষ্যেতর।
এথনোসেন্ট্রিজমকে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে সহজেই বোঝানো যাবে। বাঙালিদের চোখে ‘গুজরাটি আর
বেনিয়ারা পয়সা চেনে শুধু’, ‘সাউথইন্ডিয়ানদের সবার গায়ের রং কালো এবং তারা সব রান্নাতেই
কারিপাতা আর নারকেল দেয়’ হল এথনোসেন্ট্রিজমের উদাহরণ। আবার এক এথনোসেন্ট্রিক গুজরাটি
ব্যবসায়ীর চোখে বাঙালি ‘বাবুমশায়’ কেবল গান কবিতা লেখাতেই দড়, তার দ্বারা ব্যবসা হবে
না।
আর-একটু বড়ো করে
ভাবতে গেলে ভারতীয় হিসাবে আমাদের এথনোসেন্ট্রিক ভাবনার কথা এসে যায়। আমরা ভাবি— ‘ইশ,
চীনারা কোনও খাবারই ছাড়ে না, বাদুড়, আরশোলা সব কেমন খেয়ে নেয়’, ভাবি— ‘ইউরোপীয়রা, আমেরিকানরা
শৌচকর্মের পর জল না দিয়ে টিশুতেই পশ্চাদ্দেশটিকে মুছে নেয়, কেমন নোংরা ওরা?’
টিনটিনের প্রায় সবক’টি কমিক্স এই এথনোসেন্ট্রিজমের রোগে আক্রান্ত। তার শুরুটা ‘সোভিয়েত
দেশে টিনটিন’-এ হলেও পরের কমিক্সেই সেই রোগ জাঁকিয়ে বসে।
‘কঙ্গোয় টিনটিন’-এর পাতায় পাতায় তাই ছড়িয়ে রয়েছে রেসিজ্ম,
স্টিরিয়োটাইপ-এর অজস্র উদাহরণ, এই সব আর্জের এথনোসেন্ট্রিজমের ফসল।
কঙ্গোয় টিনটিন-এর আফ্রিকান আদিবাসীদের
একটু খেয়াল করে দেখা যাক। কেমন দেখতে তাদের? তাদের সবারই গায়ের রং
ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মোটা ঠোঁট, গোলগোল চোখ, মাথায় চুল কম। তারা বেশিরভাগ সময়ে নোংরা
হয়েই থাকে, তাই এক আদিবাসী লাইনচ্যুত ট্রেনকে সরানোতে সাহায্য করতে রাজি হয় না, কারণ—
‘গায়ে যদি ধুলো বা ময়লা লেগে যায়?’
প্রশ্নটিকে আর্জে স্পিচ বাবলের মধ্যে
ব্যবহার করেন সার্কাজমের জন্য। কালো নিগ্রো মানেই সেই নোংরা। তবে আর্জে একা নন, সেই
সময়ে ইউরোপে নিগ্রোর গায়ের গাঢ় বাদামি রং যে সাবান ঘষলে উঠে
যাবে এমন বহুল প্রচারিত বিজ্ঞাপনও দেখতে পাওয়া যায়।
টিনটিন একজন আদিবাসীকেও নিজের দাসত্ব
স্বীকার করতে বলে না, কিন্তু তারা যেন সাগ্রহেই এই সাদা মানুষটিকে প্রভু বলে মেনে নেয়।
বাবাওরাম এবং তার পাশের হাতুভু গ্রামের আদিবাসীরা বর্বর এবং তারই সঙ্গে বোকা, তারা
খুব সহজেই রেগে যায়, বিজ্ঞানের কণামাত্র তাদের কাছে এসে পৌঁছোয়নি এবং সেই বিজ্ঞানকে
তার জাদু হিসাবেই দেখে। রঙের পার্থক্য এতটাই প্রকট যে তারা টিনটিনকে বারবার অভিহিত
করে ‘সাদা মানুষ’ নামে। টিনটিনের মুভি ক্যামেরা আর টেপরেকর্ডার দেখে তারা বিস্ময়ে অবাক
হয়। টিনটিন নির্বিচারে বনের পশুদের হত্যা করে চলে, তাতে তার নায়কচিত যে ঔজ্জ্বল্য তা
যেন আরও বেড়ে যায়। সে বিপদে পড়লে তাকে হিংস্র কুমিরের হাত থেকে বাঁচায় এক সৌম্যকান্তি
খ্রিস্টান মিশনারি। সেই মিশনারিটির নৌকাটিকে বেয়ে নিয়ে আসছে বেশ কিছু নিগ্রো। কমিক্সে মিশনারিটি গ্রামের মধ্যে স্কুল চালায়। টিনটিন সেই স্কুলের
ছাত্রদের ভুগোলের ক্লাস নেয়। বেলজিয়ামের ম্যাপ দেখিয়ে বলে—
‘বন্ধুরা, আজ আমি তোমাদের বলব তোমাদের দেশ বেলজিয়ামের
কথা!’ (My dear friends, today I will teach you about your fatherland: Belgium!)
বেলজিয়াম অধিকৃত কঙ্গোর শিশুরা তাদের প্রভুর দেশকে
চিনছে নিজের দেশ বলে। পরবর্তীকালে অবশ্য আর্জে তার নিজের এই কাজে যথেষ্ট লজ্জিত বোধ
করেন। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত কঙ্গোয় টিনটিনে দেখা যায় টিনটিন ভুগোলের কথা না বলে অঙ্কের
ক্লাস নিচ্ছে। তবে এটি আর দু’-একটি নির্মম প্রাণী হত্যার ছবির বদল বাদে বাকি কমিক্সটা কিন্তু একই রয়ে যায়। পোষা কুকুর কুট্টুসও এক গ্রামের রাজা
হয়ে বসে। সাদা রং কেবল মানুষকে শাসকে পরিণত করে না, তার দুধসাদা
কুকুরটিও সেই সুযোগ পায়। কাহিনির শেষে টিনটিন সেই দেশ ত্যাগ
করলেও গ্রামে তার মূর্তি বসে, ‘সাদা’ মানুষটির কথা তখনও গ্রামের ছোটোবড়ো
সকলের মুখে মুখে ফিরছে।
১৯৩০ সালে যখন এই কমিক্সটি
প্রকাশিত হয়েছে তখন ‘রেসিজ্ম’ শব্দটির অস্তিত্ব থাকলেও তা
নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি ইউরোপীয়রা। বেলজিয়ামরা কঙ্গোয় সাম্রাজ্যবাদী
আগ্রাসনকে সমর্থন না করলেও তার বিরুদ্ধে সোচ্চারে প্রতিবাদ করেনি। কারণ সেই বর্বর জাতির
দেশ থেকে নিয়ে আসা কাঁচামালে যে নিজের দেশের অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে। তার বদলে সেই
দেশের মানুষদের সভ্য করার দায়িত্ব নিয়েছে সাদা মানুষের দল। তাদের ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা
দেওয়া হচ্ছে, তারা সাহেবি পোশাক পরছে, তাদের ফ্রেঞ্চ এবং ফ্লেমিশ ভাষায় শিক্ষা দেওয়া
হচ্ছে। এক অসভ্য জাতিকে সভ্যতার আলোয় নিয়ে আসছে মহান দেশ বেলজিয়াম। তার পরিবর্তে কয়েকশো
কুইন্টাল রবার অথবা কয়েক হাজার নিগ্রোর মৃতদেহের মূল্য তো নেহাতই কমই নাকি? ‘কঙ্গোয়
টিনটিন’ বেলজিয়ামে যখন পুর্ণাজ্ঞ কমিক্সের বই হিসাবে প্রকাশ
পায় তখন ব্রাসেলসের রাস্তায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। দিনটা ছিল ৯ জুলাই,
১৯৩১। দেখা যায় ১০ জন কৃষ্ণাঙ্গ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে টিনটিনের মতো পোষাক পরিহিত এক
বেলজিয়াম অভিনেতাকে, তার সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় চিড়িয়াখানা থেকে
ভাড়া করে আনা কিছু পশু। সে-দিনের সেই শোভাযাত্রা দেখতে ব্রাসেলসের রাস্তায় ভিড় জমায়
৫০০০ জন মানুষ! বর্তমান পৃথিবী অনেক বদলেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় অভিবাসীদের সংখ্যা
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেসিজ্ম বা বর্ণবিদ্বেষের ঘটনা যেমন সামনে
এসেছে তেমনই এই নিয়ে মানুষ ওয়াকিবহালও হয়েছে। কিছুদিন আগেও গোটা পৃথিবী উত্তাল হয়েছে
‘ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার’ স্লোগানে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের সময়টা ছিল অন্যরকম।
সেই সময়ে ‘কঙ্গোয় টিনটিন’ তাই পেয়েছিল বহুল জনপ্রিয়তা।
এরপর ধীরে ধীরে আর্জের চিন্তাধারায় বদল
আসে। পরের কমিক্সটিতে নর্বার্ট ওয়ালেজের ছায়া থেকে বেরিয়ে
এসে নিজের মতো করে তৈরি করেন আর্জে। আসে ‘আমেরিকায় টিনটিন’, এই টিনটিন কিন্তু আমেরিকার
‘ইন্ডিয়ান’ আদিবাসীদের উপরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তবে সেখানেও এথনোসেন্ট্রিজম
পিছু ছাড়ে না আর্জের। ঘরে বসে বিশ্বের অন্য দেশগুলির পটভূমিকায়
কিছু লিখলে সেই আর্মচেয়ার কাহিনিতে স্টিরিয়োটাইপ তো আসতে বাধ্যই,
এতে আর্জের প্রত্যক্ষ কোন অভিসন্ধি নিশ্চয়ই ছিল না, ইন্ডিয়ানদের
অসহায়তাকে তিনি যথেষ্ট অনুকম্পার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও
যে ব্ল্যাকফুট ইন্ডিয়ান ট্রাইবের মানুষেরা বর্বর এবং বুদ্ধিহীন, ঠিক কঙ্গোর আদিবাসীদের
মতোই খুব সহজেই যেন তাদের বোকা বানানো যায়।
১৯৩২ সালে টিনটিন এসে পৌঁছোয় ভারতবর্ষে।
‘ফারাওয়ের চুরুট’ কমিক্সে সে মুখোমুখি হয় এক ফকিরের। ফকিরটি
ধূর্ত, লোভী। সে হিপনোটিজম জানে, গ্রেট ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিকও জানে, ব্লো পাইপ দিয়ে বিষাক্ত
তিরও ছোড়ে। এই হল আর্জের চেনা ভারতের পরিচয়। এই গল্পেই আবার এক গরুকে কামড়ে দেওয়ার
জন্য কুট্টুসকে দেবতা শিবের কাছে বলি দেওয়ায় উদ্যত হয় কিছু ভারতীয়। আবার পরের বই ‘নীলকমল’
শুরুতেই পরিচয় পাই রামশর্মা নামের এক সাধুর। সে রাজার দরবারে টিনটিনের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত
থাকে। কীভাবে? কাচের টুকরোর উপরে নেচে, নিজের শরীরে ছোরা ঢুকিয়ে, পেরেকের উপরে উল্টো
হয়ে শুয়ে। তৎকালীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে আর্জের ধারণার অগভীরতা এখানে প্রকট।
তবে এই নীলকমলেই যখন চীনের প্রসঙ্গ আসে
তখন আর্জে বেশ কিছুটা পরিণত। নীলকমল তৈরি করার আগে তার সঙ্গে আলাপ হয় ঝ্যান চোনগ্রেনের
(Zhang Chongren)। ঝ্যান ছিল ব্রাসেলসের রয়াল আর্টস অ্যাকাডেমির একজন চাইনিজ ছাত্র।
ঝ্যানের কাছ থেকে আর্জে শেখেন চৈনিক দর্শন, তাদের জীবনযাত্রার কথা ভালোভাবে বোঝেন। একটি দেশে না গিয়েও সেই দেশের মানুষ এবং শহরকে যতটা
সম্ভব বাস্তবিকভাবে আঁকার চেষ্টা করেন, এই সময়ে আর্জের আঁকার
পদ্ধতি লিন ক্লেয়ার (Ligne Claire)-এও বদল আসতে থাকে, তাই নীলকমল কমিক্সে দেখানো চীনা শহর এবং তার পরিবেশ, অন্দরমহল অনেকটাই জীবন্ত,
বাস্তবের কাছাকাছি। মাঞ্চুরিয়া প্রদেশে জাপানিদের আগ্রাসন ছিল এই কমিক্সের মূল কেন্দ্রে। নিজের বন্ধুটির প্রতি সম্মান জানাতে আর্জে
এখানে সৃষ্টি করেন চ্যাং চোং চেন নামের এক চরিত্রের, যে টিনটিনের ভীষণ ভালো বন্ধু, এই চ্যাঙ্গকে আমরা পরেও পাই তিব্বতে টিনটিন বইতে। নীলকমলে
দেখা যায় টিনটিন চ্যাং এর সঙ্গে বসে পাশ্চাত্যের মানুষেরা যেভাবে চীনাদের বর্ণবৈষম্যমূলক স্টিরিয়োটাইপ দিয়ে
দেখে তাই নিয়ে মজা করছে। হয়তো ঝ্যাঙের প্রভাবেই আর্জে এখন
নিজের এথনোসেন্ট্রিজম নিয়ে কিছুটা সচেতন, তাই টিনটিনের মাধ্যমেই তার আগেকার নির্বুদ্ধিতাকে
স্বীকার করে নিতে লজ্জা বোধ করেন না। কিন্তু আবার চীনাদের
প্রতি সমবেদনা দেখাতে গিয়ে এই কমিক্স তাদের দিকেই যেন অনেকটা
হেলে থাকে। জাপানিরা যেহেতু এখানে ভিলেন তাই তারা এবার আক্রান্ত
হয় আর্জের এথনোসেন্ট্রিজমে। খলনায়ক জাপানি গুপ্তচর মিতসুহিরাতোকে
আমরা দেখি কৃশকায় এক ধূর্ত মানুষ হিসাবে, তার নীচের চোয়াল বিশ্রীভাবে হাঁ হয়ে থাকে,
নাকের ফুটো শুয়োরের মতো। ছোটো মোটা গোঁফ আটকে থাকে ঠোঁটের
উপরে। এভাবে বর্ণবৈষম্যতা টিনটিনের সঙ্গে লেগেই থাকে। আর্জের অবচেতনে কখনওই তার সম্পূর্ণ
অবলুপ্তি হয় না। এর উদাহরণ দেখা যায় পরের বইগুলোতেও। যেখানে বারবার আর্জে সচেতনভাবে
টিনটিনকে মানবিক বা হিউম্যানেটেরিয়ান ভাবমূর্তিতে আঁকার চেষ্টা করলেও রেসিজ্মের ফল্গুস্রোত
বইছে।
১৯৪০ সালে জার্মানরা বেলজিয়ামের দখল নেয়।
বন্ধ হয়ে যায় নর্বার্ট ওয়ালেজের খবরের কাগজটি। তার জায়গায় আর্জে যোগ দেন লে সয়ার (Le
Soir) নামের একটি নতুন সংবাদপত্রে। লে সয়ার ছিল প্রত্যক্ষ্যভাবে নাৎসিদের মুখপত্র।
বেলজিয়ামের রাজনৈতিক ভুগোলে বদল আসার সঙ্গে সঙ্গে টিনটিনের কমিক্সও
বদলাল। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হল ‘আশ্চর্য উল্কা’। সেই গল্পের মূল ভিলেন যেন খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন নিউ ইয়র্কবাসী
ধনী ইহুদি, নাম ব্লুমেনস্টাইন। তার নাকটি অস্বাভাবিকভাবে বড়ো,
মোটা ঠোঁট। ইহুদিদের চরিত্রের বর্ণনা করতে মুখের এই দুই অংশকে
যেন অতিরিক্ত সার প্রয়োগে বাড়িয়ে দেওয়া হল। ঠিক যেমনটা হয়েছিল কঙ্গোয় টিনটিনে নিগ্রোদের
ক্ষেত্রে। কমিক্সে আরও দুই ইহুদি চরিত্রকে
দেখা যায়, যাদের নাম আইজ্যাক এবং সলোমন। তারা আসন্ন উল্কাপাতে যে পৃথিবী ধ্বংস হতে
চলেছে এই খবরে আনন্দিত, কারণ তা হলে তাদের পাওনাদারদের টাকা আর মেটাতে হয় না। ইহুদিদের অর্থের লোভ এতটাই যে পৃথিবী ধ্বংস হইয়ে গেলেও তাদের কিছু
যায় আসে না। অথচ মাত্র দুই বছর আগে ওয়ালেজের লা ভিন্তেমে সিয়েল পত্রিকায় প্রকাশিত কালো
সোনার দেশে গল্পে ইহুদিদের এতটা কদাকারভাবে আঁকা হয়নি, সেখানে তারা যেন মানুষই, এমনকি
সেখানে এক জায়গায় টিনটিনকেও ইরগুন প্রজাতির ইহুদি ভেবে ভুল
করার দৃশ্য রয়েছে। ১৯৪৪ সালে মিত্রশক্তি জার্মান কবল থেকে বেলজিয়ামকে উদ্ধার করার পর
লে সয়ার বন্ধ হয়ে যায়। আর্জে রেমন্ড লেব্ল্যাঙ্ক নামের এক
কমিক্সের প্রকাশকের হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৫০ সালে তৈরি
করেন নিজের স্টুডিয়ো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আর রাজনৈতিক চাপের মধ্যে তাকে কমিক্স তৈরি করতে হল না। এই সময় আশ্চর্য উল্কাতেও বদল আনা হয়, আইজ্যাক
এবং সলোমনের চরিত্র দু’টি অদৃশ্য হয়ে যায়। ব্লুমেন্সটেইন ইহুদি
নাম বদলে হয় বোলউইঙ্কেল। বাংলা ভাষায় অনুদিত টিনটিনে আমরা এই নামটিই পড়েছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আর্জের
যে কমিক্সগুলি বেরোতে থাকে তার মধ্যে একপ্রকার বদল লক্ষ করা
যায়। এই কমিক্সগুলি আগেরগুলির তুলনায় অনেক বেশি স্বতন্ত্র।
বিশ্বচিন্তার যে ‘ব্লাইন্ডস্পট’ আর্জের মধ্যে রয়েছে তা নিয়ে
যেন তিনি নিজেই এবার অনেকটা সচেতন। ‘মমির অভিশাপ’ এবং ‘সূর্যদেবের বন্দি’ এই দু’টি কমিক্স প্রকাশিত হয় পরপর। সেখানে লাতিন আমেরিকার ইনকাদের অনেক যত্ন নিয়ে আঁকেন আর্জে, ইনকাদের ঈশ্বরচিন্তাকে যথেষ্ট সম্মান দেন তিনি। কিন্তু আদিবাসীদের
বর্বরতার ছাপ এই ইনকাদের মধ্যেও রয়ে যায়। যা-ই সভ্য জগতের বোধের বাইরে তা-ই যেন অন্ধকারময়,
এমন চিন্তা টিনটিনের কমিক্সে বারবার ফিরে এসেছে। এই দু’টি কমিক্সও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে ইনকারা তাদের গোপনীয়তা রক্ষা
করার জন্য সমগ্র পেরুতেই যেন এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখে। কাহিনির
শেষে তারা টিনটিন এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সূর্যদেবের কাছে বলি দিতেও যেন পিছপা হয় না।
একইভাবে যদি আমরা ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত কানভাঙা মূর্তিতে ফিরে যাই তা হলে দেখব সেখানে
লাতিন আমেরিকান জঙ্গুলে মানুষখেকো আদিবাসী প্রজাতি আরামবায়া এবং তাদের শত্রু রামবাবাকে।
রামবাবারা মৃতদের মাথাকে শুকিয়ে সাজিয়ে রাখে। আবার আরামবায়াদের একজন ওঝা আছে, যেভাবে
সভ্য সাদা মানুষদের বুদ্ধি তাদের জাতির জন্য ক্ষতিকারক, ঠিক এমন এক ওঝার সন্ধান পাই
‘কঙ্গোয় টিনটিন’-এও। এখানে আর্জে যেন নিজেই জঙ্গুলে আদিবাসীদের এথনোসেন্ট্রিজমের দায়িত্ব
নিয়েছেন। সাদা ভূপর্যটক রিজওয়েলকে দেখা যায় খুব সহজেই আরামবায়াদের জীবনযাত্রার সঙ্গে
নিজেদের মানিয়ে নিতে, কিন্তু বোকা আরামবায়ারা কোনওভাবেই আর গলফ খেলা শিখে উঠতে পারে
না। ‘নেটিভ’দের বুদ্ধির দীনতা যেন বারবার ফিরে ফিরে আসে।
কঙ্গোয় টিনটিন-এ যে-ভুল আর্জে করেছিলেন তাকে শোধরাবার চেষ্টা করেন ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ‘লোহিত
সাগরে হাঙর’ গল্পে। সেখানে ভিলেন রাস্তাপপুলাসের সাঙ্গোপাঙ্গোরা আফ্রিকান মুসলিমদের
মক্কায় ধর্মযাত্রায় নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাহাজের খোলের মধ্যে পুরেছে। কিন্তু
তাদের আসল লক্ষ এই আফ্রিকানদের আরবে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া। এটি একটি বাস্তবিক
সমস্যা বা ‘রিয়েল ওয়ার্ল্ড প্রবলেম’। আর্জে যথার্থভাবেই টিনটিনের
মধ্য দিয়ে এই ঘৃণ্য ব্যবসার বিরূদ্ধে প্রতিবাদ জানান। টিনটিন এবং ক্যাপটেন হ্যাডক আফ্রিকান
মুসলিমদের জাহাজের খোলের ভিতর থেকে উদ্ধার করে। তাদেরকে বারবার বোঝাবার চেষ্টা করে
যে, তাদের বোকা বানানো হয়েছে। মক্কায় তারা কোনওদিনই পৌঁছোবে না, তাদের ক্রীতদাস হিসাবে
বিক্রি করে দেওয়া হবে। কিন্তু এত কিছু শুনেও বোকা আফ্রিকানরা বারবার একই কথা বলে,
‘আমরা মক্কায় যাব।’
এতে ‘সভ্য’ পাশ্চাত্যবাসী ক্যাপ্টেন হ্যাডক
বীতশ্রদ্ধ হয়ে চিৎকার করতে থাকে, কিন্তু তাতেও আফ্রিকানদের মধ্যে বোধের জন্ম হয় না।
মদের নেশায় বেশিরভাগ সময়ে চুর হয়ে থাকা ক্যাপ্টেন হ্যাডক যখন কোনও এক দেশে গিয়ে তাদের
সংস্কৃতির ব্যাপারে ভুল ধারণা করে বসে তখন তাকে আদুরে চরিত্রের তুলিতে আঁকা হয়, হ্যাডক
রেসিস্ট হলেও তা যেন তার চরিত্রের একটি মজার অংশ, সে বোকামি করলেও সেই বোকামির দায়
শুধু মদের বোতলের। অন্যদিকে ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘বিপ্লবীদের দঙ্গলে’ নামের কমিক্সে আবার ফিরে আসে আরামবায়ারা। এবারে তারা সভ্য জগতের সঙ্গে
পরিচিত হতে পেরেছে। এখানে তাদের কী পরিণতি হয়? ‘সভ্য’ আরামবায়ারা এখানে মদ্যপ। প্রফেসর
ক্যালকুলাস দুঃখ করে বলেন— “মাতালের দল!... সভ্যতা ‘অসভ্যদের’ এই হাল করেছে!”
তা হলে আর্জে কি কোনওভাবেই নিজের এথনোসেন্ট্রিজমকে
কাটিয়ে উঠতে পারেননি? বর্ণ বা জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কথা কি কখনই
ভাবেননি আর্জে? একেবারেই তাই নয়, বহুবার ভেবেছেন। তার সেই সচেতন ভাবনা বারবার ফুটে
উঠেছে টিনটিনের বিভিন্ন কমিক্সে। চতুর্থ কমিক্স ‘ফারাওয়ের চুরুট’ থেকেই টিনটিন অন্যজাতির মানুষের সঙ্গে
প্রভুর মতো নয়, বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছে, তার বিভিন্ন ভাষার বন্ধুর সংখ্যা ক্রমেই
বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা চ্যাং বা আদিবাসী জোরিনো বন্ধু হয়েছে
তার।
আমেরিকায় টিনটিনে একটি প্যানেলে আর্জে
প্রথমে একজন ইন্ডিয়ান ভিক্ষা করছেন এমন আঁকেন, পরে তা বদলে দিয়ে আঁকেন সেই ইন্ডিয়ান
রেডস্কিন সিটিতে একটি বাড়ির পাশে বসে আছে। এই কমিক্সে টিনটিন
যখন আকষ্মিকভাবেই তেলের খনি আবিষ্কার করে ফেলে তখন তেল-ব্যবসায়ী আমেরিকানরা কয়েকশো
হাজার ডলারের বিনিময়ে সেই খনি টিনটিনের কাছ থেকে কিনে ফেলতে চায়। নির্লোভ টিনটিন যদিও
দৃঢ়ভাবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং বলে যে এই তেল ব্ল্যাকফুট ইন্ডিয়ানদের সম্পত্তি,
তাদেরই একমাত্র অধিকার রয়েছে এই খনির উপরে। যদিও পরের প্যানেলেই দেখা যায় এক আমেরিকান
ধমকির সুরে একজন ইন্ডিয়ান সর্দারকে বলছে, ‘শোনো, সর্দার! পঁচিশ ডলার দিচ্ছি। আধ ঘণ্টার
মধ্যে মালপত্তর নিয়ে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবে!’
তার পরের প্যানেলে দেখা যায় বেয়োনেটের
সামনে কীভাবে ইন্ডিয়ানদের তাড়িয়ে দেওয়া হল এবং অচিরেই সেখানে গজিয়ে উঠল সভ্যদের ‘শহর’।
‘মমির অভিশাপ’ এবং ‘সূর্যদেবের বন্দি’
এই দু’টি কমিক্সে ইনকাদের উপরে স্প্যানিশদের অত্যাচারের পরিচয়
পাই যখন দেখি রুপাক ইনকা হুয়াও বিশুদ্ধ ইনকা রক্তের হয়েও পুলিশের কাছে লাঞ্চিত হয়।
আবার ইনকা ছেলে জোরিনোকে অপমান করে ‘বিদেশি’ স্প্যানিশরা। ‘মমির অভিশাপ’-এ জনৈক ট্রেন
যাত্রী বলে, ‘এসব সমাধি-টমাধির ব্যাপারে নাক গলাবার দরকার কী! অন্য দেশের লোকেরা তো
আমাদের এসব ব্যাপারে নাক গলায় না।’
এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় সূর্যদেবের বন্দি-তে
ইনকা সর্দারের কথায়, যখন সে আলৌকিক উপায়ে পর্যটকদের উপরে অত্যাচারে রত— ‘These
men came here like hyenas, violating our tombs and plundering our sacred
treasures.’
বাংলা অনুবাদে এই অংশটি যথার্থতা পায়নি।
তাই ইংরাজি অনুবাদটিকে রাখলাম এখানে।
একটিমাত্র কমিক্সের
নামই কেবল বলা যায় যাতে আর্জে যথাযথভাবেই জাতিবৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, তা হল
‘পান্না কোথায়’। সেখানে ক্যাপ্টেন হ্যাডক দয়াপরাবশ হয়ে জিপসিদের মার্লিন্সপাইকে নদীর
ধারের উপত্যকায় থাকার সুযোগ দেন। চাকর নেস্টর আর পুলিশ যদিও তাকে জিপসিদের ‘ঝামেলা’র
ব্যাপারে আগে থেকেই সচেতন করে রাখে। এরপর সবুজ পান্নাটি চুরি যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই
রনসন এবং জনসন দুই ডিটেকটিভ চোর হিসাবে সাবস্ত করে জিপসিদের। টিনটিন এবং হ্যাডক যদিও
নিশ্চিত থাকে এই কাজ জিপসিদের নয় এবং সেটিই শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়।
তা হলে এই দীর্ঘ এবং শুষ্ক আলোচনার শেষে
কী সিদ্ধান্তে উপনীত হব আমরা? টিনটিনের কমিক্সগুলোর প্রায়
সবক’টিই রেসিজ্ম এবং এথনোসেন্ট্রিজমে আক্রান্ত? এখানে একটি
ভাববার বিষয় আছে, সেটি বিতর্কিত হলেও ভাবার মতোই বই-কি। সাহিত্য এবং শিল্পে বর্ণবৈষম্য
বারবার চলে আসে, আবার তাকে সতর্কভাবে এড়ানোও যায়। কিন্তু কমিক্স
হল এমন একটি আর্টফর্ম যাতে সাহিত্য এবং শিল্প পাশাপাশি একে ওপরের সঙ্গে জুড়ে
থাকে। এতে একটি গল্পের শুধু পাঠকই নয়, দর্শকও হওয়া হয়। কমিক্স তাই
হয়তো এথনোসেন্ট্রিজমের দোষে বারবারই দুষ্ট হয়। শিল্পী যখন
কমিক্সে কোন চরিত্রকে আঁকেন, তখন তার জাতিগত কিছু বৈশিষ্ট্যকে
তাঁকে উচ্চকিতভাবে পাঠকের কাছে ফুটিয়ে তুলতে হয়। তাই হয় মজার উপাদান। এই কাজটি করতে
গিয়ে তাই বারবার স্টিরিয়োটাইপ চলেই আসে। এখানে টিনটিন একা
নয়, সিন্ডিকেটেড কমিক্সে প্রথম যে কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রটির পরিচয়
আমরা পাই সে হল ম্যান্ড্রেকের সাগরেদ লোথার। এই লোথারকেও প্রথম দিকে দেখানো হয়েছে ওই
মোটা ঠোঁটেই, তার বলা ইংরাজিতেও ছিল ভুলে ভরা। পরে কিছুটা
‘সভ্য’ হওয়ার সুযোগ পায় সে। এই বৈষম্য শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই নয়, শ্বেতাঙ্গরাও ভোগ করেছে।
অ্যাস্টেরিক্সের কমিক্সে ব্রিটিশদের দেখানো হয়েছে ফ্রেঞ্চ
এথনোসেন্ট্রিজমের আলোয়। সেখানে তাদের মোটা গোঁফ, সোনালী চুল, তারা হাঁটুর নীচ অবধি
লম্বা জুতো পরে, উষ্ণ বিয়ার খায়, খাবারে বেশি পরিমাণে পুদিনার চাটনি ঢালে।
বর্ণবৈষম্যের এই স্টিরিয়োটাইপগুলো
কমিক্সে মজার খোরাক জোগায়। এতে ‘অফেন্ডেড’ হওয়াটা মনে হয়
বোকামি। তবে এখনকার শিশু-কিশোরদের কাছে টিনটিনের জনপ্রিয়তা আগের মতোই রয়েছে এটা ভাবাটাও
মনে হয় তেমনই বোকামি। তবে তারা টিনটিন পাঠ করলেও কোন স্টিরিয়োটাইপে আক্রান্ত হবে না।
সিধুজ্যাঠা ইন্টারনেটের যুগে সঠিক তথ্যের সন্ধান পেতে তাদের দু’মিনিট সময়ও নষ্ট হওয়ার
নয়। তবে এই মধ্য তিরিশে আরও একবার টিনটিন
পড়তে গিয়ে বুঝলাম এখনও অনেক পড়া বাকি। ওই রংচঙে ছবি আর স্পিচ
বাবলের মধ্যে আরও অনেক গল্প লুকিয়ে আছে। আরও একবার নতুন করে যেন টিনটিনের সঙ্গে আলাপ
হল। মনে পড়ল লাল বোম্বেটের গুপ্তধনের একটি প্যানেলের কথা।
টিনটিনকে আবার তুলে নিয়ে আসার দায় আমরা
এই বড়োরাই নিই বরং। আবার নতুন আলোয় চিনতে শুরু করি তাকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন