প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর

 




প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান

 

তমোঘ্ন নস্কর

 

 

পর্ব ১০: খাপ পঞ্চায়েত

 

সন্ধে নামছিল ধীরে ধীরে। নগর দিল্লি লালে লাল, নিস্তব্ধ নিথর দিল্লি শহরের শবের উপর বসে একতরফা উল্লাস করছিল ওরা।

গোধূলির রং লেগেছিল বটগাছের পাতায়, নীলচে সোনালি আলো। অন্যদিন এই আলোয় মশাল চুবিয়ে গোটা দিল্লি নগরে রোশনাই উঠত কিন্তু আজ কাক আর শকুনের বিরক্তিকর কর্কশ চিৎকার। যেন তারা বলতে চায়, বড্ড তাড়াতাড়ি বেলা ফুরিয়ে গেল। এত এত খাবার আবার বাসি খেতে হবে কালকে

যমুনার পাড়ে গা মিশিয়ে বসেছিল ওরা। নদীর বুক থেকে ঠান্ডা হাওয়া মেখে যেই কুয়াশা উঠতে শুরু করেছিল। ওরা উঠে এল। এক, দুই, তিন, শত, সহস্র আর অমনি দারুণ একটা উত্তুরে হাওয়ায় সে কুয়াশায় ঘিরে ফেলল চতুর্দিক।

 

***

 

ছাউনিতে নিশ্চিন্ত আরামে পানভোজন করছিল তুর্কি সেনাদল। না, তারা এত গা ছাড়া দেয় না। তারা যোদ্ধার জাত। রণক্ষেত্রে তারা ঘোড়ায় ঘুমোয়।

কিন্তু এদেশের মানুষজন যেভাবে ভেঙে দুমড়ে গলে যাচ্ছে, তাতে করে বিশেষ কিছু করতে পারবে না।

ঢুলু ঢুলু নয়নে পানপাত্র হাতে পিছন ফিরতেই যাচ্ছিল কেবল। তার আগেই দৃঢ় মুষ্টির বজ্রপেষণে মট করে ভেঙে গেল ঘাড়টা। তার সম্মুখে বসে থাকা সৈন্যটি চিৎকার করে ওঠার আগেই তার ঘাড়টাকে মট করে ভেঙে দিল আর-একজন।

 

***

 

টলমল পায়ে তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করেছিল হায়দার। দারুণ ক্ষুধা লেগেছে তার। তার ভাগে যারা দু’জন পড়েছে তারা বহুত খুবসুরত। বাইরে থেকে আসা মশালের আলোয় জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা মেয়েদের দিকে দেখল। হিন্দুস্থানি অউরত, কার্পেটের মতো মোলায়েম শুনেছে সে।

হাত বাঁধা রাখা আছে চৌয়ার সঙ্গে, লালসাসক্ত হায়দার নিচু হয়ে হাতটা খুলতে গেল। আর তখনই

নিজের গলাটা চেপে ধরে একটুকু বাতাসের জন্য আঁকুপাঁকু করছিল হায়দার। তার তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না সামনের মেয়েটি তাকে মেরেছে!

প্রায় সবদিকেই একই দৃশ্য। তীব্র শারীরিক সুধা নিয়ে টলমল পায়ে তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করছে ওরা। আর খসে পড়ছে একে একে ভীত-সন্ত্রস্ত গনিমতের মালগুলি কীভাবে যেন বদলে গেছে। তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে এখন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিতে আক্রমণ করল যৌথবাহিনী। না, বিশালবপু কোনও বাহিনী নয়। দিল্লি আসার পথে ভাতনির থেকে  আহিরওয়ান, পানিপথ, সির্সা যত নগর তিনি ধ্বংস করেছেন; তাদের বেঁচে যাওয়া, টিকে যাওয়া সেনাদল নিজেদের নিয়ে গড়ে তুলেছে এই বাহিনী। তার মধ্যে গায়ে গা মিলিয়ে মিশে গেছে গ্রামবাসীরা।

উল্টোদিকের মানুষটার নাম যে তৈমুর লং, খঞ্জ তৈমুর। তিনি কাউকে ছাড়েননি। ছাড়বেনও না। ভাতনিরে হিন্দু পুরুষরা নিজের স্ত্রী-সন্তানদের নিজ হাতে জ্বালিয়ে দিয়েছে লুণ্ঠন ও ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে। আহিরওয়ান থেকে পানিপথের পথে শিশু থেকে বৃদ্ধ নির্বিশেষে কসাইয়ের মতো হত্যা করে গিয়েছেন।

হরিয়ানা, হরিদ্বার, মিরাট, সাহারানপুর থেকে মানুষজন মিশে গিয়েছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। মৃত্যু ভয় বড়ো ভয়— সে-ই মিলিয়ে দিল সব। জাঠ, গুর্জর, আহির, বাল্মীক, রাজপুত, ব্রাহ্মণ, ভিল, কোল প্রমুখরা একসঙ্গে মিলে তৈরি করেছিল মহা পঞ্চায়েতি। এই পঞ্চায়েতটিকেই বলা হত ‘খাপ’, যার থেকে পরবর্তীতে এসেছে ‘থাপ পঞ্চায়েত’ অর্থাৎ সমষ্টি।

 বলা হয়, তদানীন্তন প্রয়াগরাজে ভারতবর্ষের প্রথম খাপ পঞ্চায়েতি প্রতিষ্ঠা হয়। রাজা হর্ষবর্ধন তাকে মান্যতা দিয়েছিলেন সর্বখাপ অর্থাৎ সর্বজন হিতার্থে।

সচরাচর এই খাপগুলিতে চুরাশি বা ততোধিক গ্রামের মানুষ একত্রিত হত। বলাই বাহুল্য, এক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি মানুষ একত্রিত হয়েছিল।

প্রায় ৮০ হাজার মানুষ একত্রিত হয়েছিল, যাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহা বলশালী এক কুস্তিগীর যোগরাজ সিং গুর্জর। বাহিনীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বেশি ছিল নারী। সেই নারী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন রামপেয়ারি গুর্জর। খাপের প্রধান ছিলেন মিরাটের দেবপাল অর্থাৎ পাল বা খাপের অধিকর্তা।

এই বাহিনী কখনওই সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হত না। বরঞ্চ দিল্লি ফেরত হিমাচল-অভিমুখী তুর্কি বাহিনীর পিছনে এঁটুলির মতো লেগেছিল। রাতের অন্ধকারে গা মিশিয়ে অতর্কিত আক্রমণ করে পালিয়ে যেত, যাতে করে তুর্কি বাহিনী দ্রুত সম্মুখপানে অগ্রসর হয় আশেপাশে খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি না করে।

সম্ভবত ঘটেওছিল তাই। ১৩৯৮-এর ডিসেম্বরের মধ্যভাগে তৈমুর বাহিনী দিল্লি থেকে কাংড়ার দিকে যাত্রা করল। তার আগেই অতর্কিত বাহিনীর হামলা সামলেছেন কিন্তু সেই হামলার পুরো দায় বর্তাল মৌলানা থানেশারী আর তৎপুত্র ইলিয়াস আফগানের ঘাড়ে।

তৈমুর কস্মিনকালেও ভাবতে পারেননি, ক্ষুদ্র পঞ্চায়েতি সদস্যরা তাঁর বাহিনীকে অতর্কিতে আক্রমণ করবে। বিশেষত, যেখানে হিন্দু নারীরা তাঁকে দেখে বিষ পান করে স্বেচ্ছায় আত্মবলিদান দেয়, তারা তাঁরই বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে।

 

***

 

তুর্কি সৈন্যরা দ্রুতগামী অশ্বের পিঠে এসে লড়াই করে কিন্তু এই যে পর্বতসম জীবটি, এরা তো সব গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। ঘোড়াগুলোকে পেঁচিয়ে আছাড় মারছে। এদের শুঁড়ে বাধা অস্ত্রে বিষ মাখানো, ছড়ে গেলেও কিছুক্ষণ পর বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে।

মাল্লু ইকবাল আর নাসির-উদ্দিন তুঘলকের সম্মিলিত বাহিনী বিপুল। আর তার চাইতে বিপুল এই হস্তীবাহিনী। অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল তৈমুরের তাদের রণনীতি বুঝতে। খুঁজে বের করেছিলেন হাতির দুর্বলতা— দ্রুত ভয় পেয়ে যায় হস্তীরা। এরপরে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মাল্লু ইকবালের বাহিনী দিল্লির গেট ছেড়ে নগরের ভিতর দিকে ঢুকে যাচ্ছিল আর ক্রমাগত তাদেরকে পিষে ফেলতে ফেলতে অগ্রসর হচ্ছিল তুর্কি বাহিনী।

কিন্তু এই যুদ্ধে তৈমুর লঙের প্রাথমিক বিপর্যয় একটা চরম শিক্ষা দিয়ে গেল খাপ পঞ্চায়েত বাহিনীকে। মাল্লু ইকবাল প্রথমে পিছন দিক থেকে তৈমুর লঙের বাহিনীকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু সেই আক্রমণকে ঠেকাতে দুটো আলাদা আলাদা বাহিনীকে দু’দিক থেকে কোনাকুনি আক্রমণ করে তবে পর্যুদস্ত করতে হয়েছিল অপরাজেয় তুর্কি বাহিনীকে। খাপ বাহিনী বুঝেছিল, পিছন থেকে যদি অতর্কিতে আক্রমণ করা যায়, তা হলে তুর্কিদের বিপদে ফেলা যেতে পারে। তবে সেই আক্রমণ হতে হবে অতর্কিতে এবং রাতের আঁধারে এ দেশ তাদের নয়। তাই এখানকার পরিবেশের সঙ্গে তারা পরিচিত নয়।

 

***

 

অবাক হয়ে দেখছিলেন তৈমুর। এতদিন ভারতীয় নারীদের কেবলমাত্র লুণ্ঠনের বস্তু হিসেবেই তিনি দেখে এসেছেন। তাদের প্রাণভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত রূপ দেখে এসেছেন। কিন্তু এ কোন নারী!

 রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করেছিল দলটা। একদিকে বিপুল বেগে স্রোতস্বিনী গঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে আর অন্যদিকে পাহাড়ি খাড়াইয়ের ফাঁকফোকর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে তির। তবে বেশিক্ষণ তেমন লড়াই চলল না।

বারংবার আক্রমণ হচ্ছে বলে সতর্ক হয়েই ছিল তুর্কি বাহিনী। তুর্কিরা তাদের খাটো ধনুক বদলে লম্বা ধনুকে হাত পাকিয়েছে। তীব্র তীরবৃষ্টিতে যুঝতে না পেরে পাহাড় থেকে খসে পড়তে লাগল ওরা। অবাক হয়ে দেখলেন তৈমুর, তাদের মধ্যে অর্ধেক নারী!

অবশিষ্ট বাহিনী লাফিয়ে নামল তাদের সম্মুখে। বিবিধ অস্ত্র তাদের। কারওর হাতে ভল্ল, কারওর কুঠার, কারওর হাতে তরবারি, কারওর হস্তে ত্রিফলা। এরা তো তবে কোনও সুশিক্ষিত সৈন্যদল নয়। তার সঙ্গে মিশে আছে সাধারণ মানুষ, হিন্দুরা। তারা তা হলে প্রতিরোধ করতে জানে!

মুখোমুখি সে-সমরে নেতৃত্ব দিচ্ছে এক বৃষস্কন্ধ পুরুষ আর এক তরুণী। তাদের পিছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একদল যোদ্ধা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। তারা অনায়াসে একে অপরের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে লড়ে চলেছে। লড়াই চলল, তবে বেশিক্ষণ নয়। বেশিরভাগই মারা পড়ল। বাকিরা পিছু হটল।

পরদিন তৈমুরও যথা নিয়মে ছাউনি তুললেন। তিনি কেবল যাত্রা করে চলেছিলেন, উদ্দেশ্য তো ধর্ম বিস্তার আর লুণ্ঠন। ইতিমধ্যেই দিল্লি পেরিয়ে আসার পর মিরাটের সম্মুখে মোবারক খাঁর স্থলবাহিনীর আক্রমণ আর ৪৮খানি রণপোতের এত ভারী আক্রমণ পেয়েছিলেন। মোবারকের দশ হাজার সৈন্যকে নিঃশেষ করেছেন। ছারখার করেছেন রণপোতগুলিকে। কিন্তু তার সৈন্যদল প্রায় অর্ধেক। দেড় লক্ষের দুই তৃতীয়াংশ এই সুদূর যাত্রায় অন্তিম শয়ান নিয়েছে। এখন লক্ষ্য কাংড়া বিজয় এবং কাশ্মীর পথে মধ্য এশিয়ার পথ ধরে প্রত্যাবর্তন। তৈমুর চলে গেলেন। কিন্তু পিছনে পড়ে রইল সামান্য এক পঞ্চায়েতের সদস্যদের অসম সাহসী গাথা।

ইতিহাস তাদের জন্য বেশি কথা খরচা করে না। শুধু এটুকু লিখে দেয় যে, তৈমুরের সঙ্গে কিছু খাপ মিলিট্যান্টদের সংঘর্ষ হয়েছিল দফায় দফায়। দিল্লি, মিরাট, হরিদ্বারের কাছে তারা তুর্কী বাহিনীকে বাধা দেয়, ব্যস এটুকুই। তর্ক-বিতর্ক, সন্দেহের অবকাশ থাকবেই। তবু এই কাহিনি বলা থাকল; তারা শৌর্যে না হোক, তর্কেই না হয় বাঁচল।

 

The Royal Gurjars: Their Contribution to India, Naunihal Singh (2003)

Rampyari Gurjar’ by Jesse Russell, Ronald Cohn. Lambert, M. Surhon, Mariam T. Teno and Susan F. Henson

Jat Veeron Ka Itihaas by Dalip Singh Ahlawat

History of the Origin of Some Clans in India by Mangal Sen Jindal

Swami Omanand Saraswati’s books


______________________________________________________________________________

প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলি পড়ুন:

প্রথম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post.html

দ্বিতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_13.html

তৃতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_20.html

চতুর্থ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

পঞ্চম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

ষষ্ঠ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post.html 

সপ্তম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_12.html

অষ্টম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_19.html

নবম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

 

মন্তব্যসমূহ