প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর

 



প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান

 

তমোঘ্ন নস্কর

 

 

আবার কড়া রোদ আর বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন জয়সিংহ। এক বছর আগে এইরকমই কড়া রোদ আর বৃষ্টির মধ্যে শুরু হয়েছিল তাঁর দুর্গ আগলানো। বাবার ফেলে যাওয়া সৈন্যদেলকে একত্রিত করে মায়ের জওহরের কথা বলে তিনি নিজের সৈন্যদের উৎসাহিত করেছিলেন। ব্রাহ্মণাবাদের এই দুর্গনগরে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো চেষ্টা করেছিলেন খলিফার বাহিনীকে আটকে রাখার। রেওয়ার গেছে যাক, অন্তত এই দুর্গনগরটুকু টিকে থাক— তা হলে এর পিছনে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ গ্রাম ও তাঁর স্বজাতিরা নিশ্চিন্ত থাকবে। কঠিন বাধাও দিয়েছিলেন।

চতুর্দিকে প্রাকার পরিখা ঘেরা নগরটি যখন আটকে বসেছিল ওরা, তখন ভরা বর্ষা। তারপর শীত এল, রুক্ষ হাওয়া আর ধুলো-ঝড়ে ঢেকে গেল চতুর্দিক। আক্রমণের বহর স্থিমিত হয়েছিল কিন্তু গরম পতেই আবার পূর্ণশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা। রাজা দাহিরের চারশত হাতি আছে, সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী আছে। কিন্তু উল্টোদিকে খলিফা-বাহিনীর সামান্য যাযাবর সৈন্যদের ওই যে পাথর-ছোড়া যন্ত্রটা ওইটাই তাদের কাল হল।

তাদের মূল সুরক্ষা তাদের কেল্লার প্রাকার আর হস্তীবাহিনী। ওই নিক্ষিপ্ত পাথর কেল্লার প্রাকারকে গুঁড়িয়ে ফেলছে প্রতিদিন। মাঝে মাঝে ওই পাথরের সঙ্গে বস্ত্র জড়িয়ে আগুন জ্বেলে দিচ্ছে তারা। তাতেই হাতিগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে। ফলে নেশা করিয়েও তাদেরকে স্থির করা যাচ্ছে না।

হাতির ব্যবহার কেবলমাত্র সম্মুখ যুদ্ধে হয়। হাতি তাদের মূল সম্বল, কারণ দাহিরের বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধে খুব বেশি পারদর্শী নয়। তাঁদের ভারী, বড়ো তরবারি এক কোপে মানুষ কেটে ফেলতে পারে। কিন্তু চালনায়, ক্ষিপ্রতায় ওদের ওই খাটো তরবারি আর খাটো মানুষজন তুলনামূলকভাবে দ্রুততর।

শেষমেশ ওই পাথর নিক্ষেপণ যন্ত্র তারাও তৈরি করলেন। কিন্তু সম্মুখের শিবির এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটয়ে সাজানো যে, পাথর পড়লে একটি-দু’টি ছাউনি বই অন্য কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আর আগুন-পাথর ছুড়লে ফাঁকা মাঠে পড়ে আর ওরা জল দিয়ে নিভিয়ে দেয়।

কথার মাঝখানেই আরও প্রায় সাতখানি পাথর এসে গুঁড়িয়ে দিল দ্বিতীয় স্তরের দেওয়াল।

এইবার আরও একটু কাছে সরিয়ে নিয়ে আসছে ওরা যন্ত্রগুলিকে। তৃতীয় তথা শেষ স্তরের দেওয়াল গুঁড়োনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রথম দেওয়ালটি তো তিন মাস আগেই ভেঙে ফেলেছিল ওরা। সব থেকে মজবুত ছিল এই মাঠের স্তরটি। তৃতীয় দেওয়ালটি ভেঙে গেলে সরাসরি রাজবাড়ির আঙিনায় এসে পড়বে ওই পাথরগোলা।

 

***

 

পূর্বকথন

 

এই কাহিনি বুঝতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে বেশ কয়েক বছর পিছনে। সিন্ধুর পরাক্রমশালী শাসক রাজা দাহিরের সঙ্গে একটু একটু করে দানা বাঁধছে খলিফার অসন্তোষ। রাজা দাহির কিন্তু সহনশীল ছিলেন। ব্যবসার প্রতি তাঁর নজর ছিল। তাই ব্যবসাকে মূল প্রাধান্য দিয়ে সকল ধর্মের মানুষকে তিনি বসত গড়তে দিয়েছিলেন। এভাবেই আরব বণিকরা এসে আস্তানা গড়েছিল সেখানে।

তাদের কাছে দামাস্কাসের খলিফা দিনের পর দিন সেই স্থানের প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যের কথা শুনতেন আর লালায়িত হতেন সেই স্থান লুট এবং আগ্রাসনের জন্য। বিশেষত খলিফা-বাহিনীর এই আগ্রাসনের পিছনে ধর্ম-প্রসারই মূল ছিল; সে-বিষয়ে বহু গ্রন্থ বহুবার সমর্থন করেছে।

এই চরম অসন্তোষে আগুন লাগাল দেবলের বন্দরে— এমন এক বন্দর যা অবস্থানের দিক দিয়ে সেই সময়ে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল। কারণ ভারত মহাসাগর এবং আরব সাগরকে একই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল সে। শোনা যায় দেবলের বন্দরের বেশ কিছু নটিক্যাল মাইল অব্দি কেবলমাত্র জাহাজ আর জাহাজ থাকত। শুধুমাত্র বন্দরের স্থলভূমি নয়, জলভূমিও সরগরম থাকত বিকিকিনিতে।

সেরেং দীপ তথা শ্রীলংকার রাজা, দামাস্কাসের খলিফার জন্য বেশ কিছু বহুমূল্য সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন। দেবলের কাছাকাছি এসে পৌঁছোনোর পর সামগ্রীগুলো জলদস্যুদের দ্বারা লুঠ হয়। এইটে ভীষণ অপমানজনক লাগে খলিফার। সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তিনি রাজা দাহিরকে অনুরোধ কিংবা আদেশ করেন হৃত উপহারগুলিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য। রাজা দাহির স্পষ্টই অস্বীকার করেন সে-আদেশ, বলেন— জলদস্যদের উপরে নিয়ন্ত্রণ তাঁর নেই। শুধু তাঁর কেন, কোনও রাজারই নেই। তবে হ্যাঁ, তাঁর জলসীমায় হয়েছে, সেহেতু তিনি এর জন্য ক্ষতিপূরণ এবং তেমন মূল্যের উপহার সামগ্রী দিতে রাজি।

এই বিষয়টি খলিফাকে আরও বেশি রাগান্বিত করল। ভিতরে ভিতরে সমস্ত দেশীয় রাজাদের, এমনকি বৌদ্ধ রাজাদেরকেও তিনি উসকিয়ে দাহিরের বিরুদ্ধে একত্রিত করলেন।

রাজা দাহির ভেবেছিলেন তাঁর সুশিক্ষিত সৈন্যদলের সম্মুখে কতিপয় সিরিয়া এবং ইরানের যাযাবর বাহিনী কতটুকুই বা প্রতিরোধ দিতে পারে! কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁর এই ভাবনা-ই তাঁর পতনের মূল কারণ হল।

 

***

 

যুদ্ধ, আরুর প্রান্তর, ৭১২ এ ডি

 

সিন্ধুর বামতট লাল হয়ে গিয়েছে হস্তী-মাংস, রক্ত আর মেদে। রাজা দাহিরকে পিঠে নিয়ে তাঁর হস্তী প্রাণপণে ভয়ে ছুটে চলেছে বিপরীত দিকে।

যে-কাজটি রাজা দাহির কখনও করেননি তাঁর সন্তান-স্নেহে লালিত হস্তীদের প্রতি, আজ তাই করছেন বারেবারে। তাঁর হাতের অঙ্কুশটি বিঁধিয়ে দিচ্ছেন হাতির মাথায়। কিন্তু সে-হাতি থামে না। অবশ্য থামবেই বা কী করে, দুই ঊরুর উপর তখন দু’খানা দগদগে জ্বলন্ত ক্ষত; নিরীহ প্রাণীটা ভয় পেয়েছে। এরকম আকাশ থেকে উল্কাপাতকে বনের পশু ভয় পায়— সে যতই গৃহে পালিত, লালিত বা শৃঙ্খলিত হোক। তার আদিম প্রবৃত্তি যাবে কোথায় আর সেইটাই কাজে লাগাল খলিফার সেনাপতি মুহম্মদ বিন-আল-কাসিম।

খলিফার বাহিনীকে দুমড়েমুষড়ে প্রায় গুঁড়িয়ে এনে ফেলেছিলেন রাজা দাহির। সম্মুখ যুদ্ধে দ্রুতগতি এবং ক্ষিপ্র সিরিয়ান বাহিনী প্রথমটা বেশ চাপে ফেলেছিল রাজা দাহিরকে। কিন্তু হতি-বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করতেই সবকিছু যেন বদলে গেল। হাতির সম্মুখে ঘোড়াগুলো স্থির ও ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারা এগোয় না, ভয়ে পিছিয়ে যায় অথবা গতি পরিবর্তন করে। আর সেই সুযোগে তাদের উপরে আক্রমণ করে দাহিরের বাহিনী।

তখনই শত্রুপক্ষের মাথায় এসেছিল অগ্নি প্রক্ষেপণকারী যন্ত্রগুলোর কথা। সেগুলো সচরাচর দুর্গ অবরোধে ব্যবহার করা হয়। তবুও এখানে ব্যবহার করা হল। ফলটাও হল আশানুরূপ। বিশাল বিশাল আগুনের গোলা উড়ে আসতে দেখে হাতিগুলো উল্কাপাত বা দাবানল জ্ঞানে ভ্রমিত হয়ে পল। আর সেই সুযোগেই ঝাঁপিয়ে পল পিছনে থাকা আরবি-বাহিনী।

রাজা দাহির যে হস্তীর পিঠে বসতেন সেই হস্তীটি প্রাণভয়ে ছুটতে লাগাল রাজাকে পিঠে নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পল। তারাও রাজার পিছু পিছু পশ্চাদ্‌পসারণ করল। প্রাণপণে হস্তীর মাথায় অঙ্কুশ বিঁধিয়ে রাজা চেষ্টা করে গেলেন তাকে ফিরিয়ে আনার।

শেষমেশ পেরেওছিলেন কিন্তু ততক্ষণে চতুর্দিক বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। বাহিনীর উপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ অনেকখানি সরে গেছে। তবুও সেই ভাঙা বাহিনী নিয়ে বীর বিক্রমে লড়াই করে চললেন তিনি। সেই লড়াই সমাপ্ত হল সন্ধের ঠিক আগে, পিছন থেকে ছোড়া বিষাক্ত তীরে অবশ্য সিন্ধু আক্রমণটাই তো পিছন থেকে ছড়া তীর

 

***

 

এবারে যতক্ষণে খবর পৌঁছোল ততক্ষণ রানি চোখের জল মুছে অস্ত্র হাতে দুর্গের প্রাকারে উঠে দাঁড়িয়েছেন। চতুর্দিক সিন্ধুর রাজধানী রেওয়ারনগরকে ঘিরে আসা আরবি-বাহিনীকে হুংকার দিলেন রানি— আত্মসমর্পণ তিনি করবেন না। মাত্র পনেরো হাজার সৈন্য নিয়ে প্রায় চার দিন তিনি আটকে রেখেছিলেন নগরটাকে।

ক্রমাগত অগ্ন্যুৎপাত এবং ভিতরের বাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতায় ধসে পল অবরোধ। কিন্তু না, রানি ধরা দেননি। দুর্গের বাকি পুরনারীদের নিয়ে জওহর পালন করলেন তিনি। সিন্ধুর প্রাণকেন্দ্র প্রাণনগরী রেভার ধূলিসাৎ হল।

 

***

 

দাহির-পুত্র জয়সিংহ কামড়ে ধরেছিলেন অপর অবরোধ— সিন্ধুর দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্রাহ্মণাবাদ নগর। প্রায় এক বছর কাল দাঁতে দাঁত কামড়ে তিনি লড়াই চালিয়েছিলেন। কাহিনি তো উপরেই বলেছি।

ভারী পাথর এসে গুঁড়িয়ে দিল গোটা নগরটা। চতুর্দিকে দেখা যায় ধোঁয়া আর ধোঁয়া, জয় সিংহের মাথাটা কেটে বর্শায় গেঁথে মুহাম্মদ আল ইবন কাসিম নিয়ে চললেন খলিফাকে দেখাতে— বাপের মাথা দেখিয়েছেন এবার ছেলের মাথা দেখাবেন। সঙ্গে বন্দি করে নিয়ে চললেন দুই রাজকুমারী— রাজা দাহিরের কন্যা তথা জয়সিংহের ভগিনী— পারমাল এবং সূর্যদেবীকে।

কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস— সেই দুই রমণী বদলা নিলেন বিন কাসিমের বিশ্বাসহানির। যেভাবে পিছন থেকে ছুরি মেরে তিনি সিন্ধু দখল করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই আপনার কাটারি রঞ্জিত করে প্রতিশোধ নিলেন দুই হিন্দু রমণী।

      তারপর বহু জল গড়িয়েছে। আজ ১৩০০ বছর ধরে সিন্ধু অঞ্চলে চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে হিন্দু সাম্রাজ্য। কিন্তু রাজা দাহির আর তার পুত্র-কন্যাদের কথা মানুষের কথায়, লেখায়, স্মৃতিচারণায় বারবার ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে এই ভূমির সন্তানদের বীরত্বের কথা, প্রতিরোধের গাথা।


___________________________________________________________________________


প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলি পড়ুন:

প্রথম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post.html

দ্বিতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_13.html

তৃতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_20.html

চতুর্থ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

পঞ্চম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

ষষ্ঠ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post.html 

সপ্তম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_12.html

অষ্টম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_19.html

নবম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

দশম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

একাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_88.html

দ্বাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_15.html

ত্রয়োদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_24.html

চতুর্দশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_30.html

পঞ্চদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post.html

ষোড়শ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_13.html

সপ্তদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_20.html

অষ্টাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/10/blog-post_11.html

ঊনবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/10/blog-post_25.html


 

মন্তব্যসমূহ