প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর

 

প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান

 

তমোঘ্ন নস্কর

 

 

সপ্তবিংশ পর্ব: রিভালবার রানি— প্রথম ভারতীয় মহিলা স্নাইপার

 

১৬ নভেম্বর, ১৮৫৭

 

দাঁতে দাঁত চেপে এগোচ্ছিল দলটা। আর আধা ক্রোশ পথ, তার পরেই ঝড়ের মতো আছড়ে পড়তে হবে। এর মধ্যে কোনও ঝামেলা না-হলেই ভালো। ওইখানে ওরা কতজন আছে, কে জানে?

হঠাৎ ভাবনা-চিন্তা ছিন্ন করে দিল একটা ভারী আওয়াজ— ঘ্রুউম...!

লুটিয়ে পড়ল, দলের পুরোভাগে থাকা পতাকা-বহনকারী সৈনিকটি। মাথায় শিরস্ত্রাণ, তাই গলা লক্ষ্য করেই চালানো হয়েছে গুলি। একেবারে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে মাস্কেট-বল। নিচু হয়ে তাকে টানতে যেতেই, আবার গুলি— ঘ্রুউম...! ছিটকে ফেলে দিল শিরস্ত্রাণ।

আর সাহস করল না কেউ। অসহায়ভাবে দেখল, বাতাসের জন্য খাবি খেতে খেতে স্থির হয়ে গেল বন্ধুটি! তার খোলা চোখে তখনও যন্ত্রণামাখা বিস্ময়!

ঠিক কতজন আছে ওদিকে! এটা কি এমবুশ? এগোনোর সাহস হচ্ছিল না কারওর, ঝোপের আড়ালে কাঠ হয়ে বসে রইল তারা।

 

***

 

গাছপালা আর বুনো ঝোপে ঢাকা সানকেন লেন। আড়াল পেতে কোনও অসুবিধাই হয়নি কোম্পানির সৈন্যদের।

সেখানে বসেই বুঝল, সিকান্দার বাগের ভিতর থেকে তখন ভারী গুলি-বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। যা বোঝা যাচ্ছে প্রায় হাজার খানেক বিদ্রোহী আছে। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে বেগমের ফৌজ। এদিক থেকেও মাঝে মাঝে গর্জে উঠেছিল ভারী বন্দুক আর কামান। কিন্তু তেমন প্রতিরোধ তারা করতে পারছে না। কেবল প্রত্যুত্তর, তাও বিরতি নিয়ে থেমে থেমে...।

আসল কথা, প্রত্যুত্তর দেবে কী করে! ঝোপের বাইরে এলেই তো সেই ‘ঘ্রুউম’! সাহস করে ভারী হাওদা বন্দুক নিয়ে যতগুলি সিপাহি গুলি চালাতে গেছে, কেউ আর উঠে দাঁড়ায়নি।

কোনও এক অদ্ভুত উপায়ে বেছে বেছে গাছের আড়ালে থাকা, ভারী হাওদা বন্দুকধারী সিপাহিদের পেড়ে ফেলছে সেই অদৃশ্য মাস্কট! আর গুলি আসছে তির্যকভাবে, উপর থেকে।

তবে কি কোনও ক্রাকশট? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে ক্রাকশট!

ততক্ষণে ঢালের আড়াল নিয়ে ক্যাম্পবেল এসে পৌঁছেছেন। গুলির গতি আর চারদিকে আচ্ছন্ন করে থাকা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বড়ো গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে, ঘাঘু সেনানায়ক ক্যাম্পবেল প্রথমটা হতভম্ব হলেও, পরে বুঝলেন ব্যাপারটা। আশেপাশে থাকা সব গাছগুলিতেই আগুন ধরিয়ে দিতে বললেন।

 

কিছুক্ষণ পর

 

মাটিতে পড়ে থাকা মহিলাটির পাশে টুপি খুলে হাঁটু গেড়ে বসলেন ক্যাম্পবেল। ইতিহাসের বিখ্যাত (কুখ্যাত) সেনানায়ক কলিন ক্যাম্পবেল, তাঁর চোখে সম্ভ্রমের অশ্রু! বিদ্রোহী প্রতিপক্ষ হতে পারে কিন্তু বীরের সম্মান করতেই হয়।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, মহিলা। সম্ভবত ভারতের প্রথম মহিলা ক্রাকশট স্নাইপার ছিলেন ‘উদা দেবী’। উত্তরপ্রদেশের পাসি সম্প্রদায়ের এক সামান্য গৃহবধূ। জীবনযাপন যেখানে কড়া হয়, সেখানে মহিলাদের তো শক্ত হতেই হয়। উদা দেবীও তাই, জীবনের প্রয়োজনে গুলতি থেকে তিরধনুক সবই ধরতে জানতেন।

স্বামী মক্কা পাসি ছিলেন অউধের সেনা। নিজের দেশ ও অধিকার রক্ষায় বেগম যখন বিদ্রোহী হলেন, তখন সে-দলে স্বামীর সঙ্গে ভিড়ে গেলেন তিনিও। হবে না-ই বা কেন? রানি তো নয়, একজন মা লড়ছেন তাঁর সন্তানের অধিকারের জন্য, তা হলে আর-একজন মা কীভাবে থাকতে পারেন ঘরে বসে?

সিপাহি-বিদ্রোহ কোম্পানির বিরুদ্ধে শুধুমাত্র প্রথম দলগত বিদ্রোহ নয়, একটা ভীষণ আবেগ! এই বিদ্রোহ টেনে এনেছিল এমন অনেক সাধারণকে, যারা হয়তো এতদিন অবধি জমিতে লাঙল জুতে এসেছে কিংবা ঘরের কোণে চুলায় ফুঁ দিয়ে, কাঁখে জলভরা কলসির ওজন নিয়েই দিন গুজরান করেছে।

সর্বস্তর থেকে, গ্রাম-শহরের আনাচকানাচ থেকে, ঘরের কোণ থেকে উঠে এসেছিল জীবন-যোদ্ধারা। এ যুদ্ধ শুধু বিদ্রোহী সিপাহিদের নয়; রাজা-রাজড়া, কৃষক, কামার— সবার বিদ্রোহ।

যে-দিনের কথা হচ্ছিল, সে-দিন অর্থাৎ ১৬ নভেম্বর, রেসিডেন্সি উদ্ধারে যাচ্ছিল ভারী কোম্পানি ফৌজ, হেভি আর্টিলারি। আচমকাই সিকান্দার বাগের শুনশান সড়কে যে এমন বাধা পেতে হবে, ভাবেনি। তাই হকচকিয়ে গিয়েছিল খানিক, অবশ্য ভারী গোলাবারুদ থাকার দরুন সামলে নিয়েছিল দ্রুত।

যা-ই হোক, দুপুর নাগাদ স্বামী মক্কা পাসির পতন হলে, দু’খানা ক্যাভালরি পিস্তল কোমরে গুঁজে ঝাঁকড়া একটা বটগাছে উঠে যান উদা দেবী। প্রায় দুই ঘণ্টা লড়াই চালিয়ে যান। ৩২ জন হাওদা বন্দুকধারীকে অব্যর্থ লক্ষ্যে পেড়ে ফেলেন। একদিকে মূল দরজায় বিদ্রোহীদের পতন হচ্ছে। অথচ অন্যদিকে কোম্পানি সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করে ফেলছেন উদা দেবী। এক পর্যায়ে গাছে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলে, গাছ থেকে লাফিয়ে পড়তে বাধ্য হন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রেই বীরগতি প্রাপ্ত হন।

এই অসামান্যা বীরাঙ্গনাকে হয়তো ইতিহাস ভুলে গেছে। কিন্তু তিনি আজও রয়ে গেছেন সিকান্দার বাগের বাতাসের ফিসফিস হয়ে। ১৬ নভেম্বর তার মৃত্যুদিনে পিলিবটের পাসি সম্প্রদায় একত্রিত হয়, স্মরণ করে এই মহীয়সীকে। ব্যস ওই পর্যন্তই, আজ স্বাধীনতার ৭২ বছরেও ইতিহাসের পাতায় একটা স্থান বা উল্লেখের কি দাবি রাখেন না তিনি?

_________

 

পুরানো শহরের আনাচেকানাচে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস। যে-কোনও সময় ধাপ্পা দিয়ে চমকে দিতে পারে! আর যে-শহর সিপাহি-বিদ্রোহের সবচেয়ে বড়ো অভিঘাতটা নিজের বুক পেতে নিয়েছিল, তাকে নিয়ে তো কোনও কথাই নেই। তাই এ শহরে এলেই টাঙাওয়ালা আর অটোওয়ালা, কিংবা বিক্রমের ড্রাইভারদের সঙ্গে তাদের ভিড়ে মিশে যাই, কে বলতে পারে কখন আপ্পুলিশ বলে ইতিহাস। —তমোঘ্ন নস্কর।

 

তথ্যঋণ:

1. ‘Dalit group recalls its 1857 martyr Uda Devi’. The Times of India-GB

2. Safvi, Rana (7 April 2016). ‘The Forgotten Women of 1857’. The Wire-GB

3. feminisminindia

4. Wikipedia


___________________________________________________________________________


প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলি পড়ুন:

প্রথম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post.html

দ্বিতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_13.html

তৃতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_20.html

চতুর্থ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

পঞ্চম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

ষষ্ঠ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post.html 

সপ্তম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_12.html

অষ্টম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_19.html

নবম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

দশম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

একাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_88.html

দ্বাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_15.html

ত্রয়োদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_24.html

চতুর্দশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_30.html

পঞ্চদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post.html

ষোড়শ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_13.html

সপ্তদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_20.html

অষ্টাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/10/blog-post_11.html

ঊনবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/10/blog-post_25.html

বিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post.html

একবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post_8.html 

দ্বাবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post_16.html

ত্রয়োবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post_22.html

চতুর্বিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post_29.html

পঞ্চবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/12/blog-post.html

ষট্‌বিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/12/blog-post_14.html

 

 

মন্তব্যসমূহ