প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান - তমোঘ্ন নস্কর

 




প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান

 

তমোঘ্ন নস্কর

 

 

পঞ্চবিংশ পর্ব: গড়ভুষণারভমেনা সদ্দার

 

টকটকে লাল রং ধরেছে নদীর জলে। আচমকা দেখলে মনে হবে বিকালের সূর্য বুঝি ঝাঁপ মেরেছে নদীতে আর তার লাল মিশে একাকার হয়ে এই লালিমা।

            অবশ্য ঘটনাটা তাই-ই ঘটেছে। মুঘল সূর্য লজ্জায় ঝাঁপ মেরেছে মধুমতী নদীর জলে। এই লাল রং কেবল অস্তমিত সূর্যের লালিমা নয়, শত সহস্র হতভাগা সৈনিকের শোণিত মিশেছে এতে।

 

***

 

১৭১৩ আজিম-উস-শান তখন বাংলার সুবাদার। এই ভদ্রলোক আরঙ্গজেবের নাতি হওয়ার সুবাদে নিজেকে দিল্লির অধিপতি বলে মনে করতেন।

            স্তাবক পরিবৃত্ত মানুষটি রাজকার্যের -ও বুঝতেন না, উপরন্তু করের বোঝা চাপিয়ে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছিলেন। শুধু তাই না, তাঁর অধীনস্থ মুঘল সৈন্যরা নিজেদেরকে রাজা-বাদশা বলেই মনে করত। গবাদি পশু থেকে খেতের ফসল সবকিছু নষ্ট করে তারা পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করত ।

            অবস্থা এমনই দাঁড়াল যে, স্থানীয় রাজা, জমিদারদের নিশ্বাস নেওয়াই দুষ্কর হয়ে উঠল। নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ রাজার কোষাগারে জমা দেওয়াটাই দায় হয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে এই অত্যাচারের জবাব দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত হতে লাগলেন।

 

***

 

হাতুড়ির মতো সুবিশাল কুঠারটি আছড়ে পড়ছিল তার ঢালের উপর। দাঁতের দাঁত চেপে সেই আঘাত সামলাচ্ছিলেন আবু তোরাব। নিজের সুবিশাল চেহারা নিয়ে তার দারুন অহংকার ছিল। কিন্তু এখন তার সেই অহংকার ক্রমশ টলে যাচ্ছে।

            প্রতিপক্ষের চেহারা দেখে প্রথমে ভেবেছিলেন সেয়ানে সেয়ানে টক্কর হবে। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে বুঝতে পারছেন প্রতিপক্ষের রণকৌশল এবং বাহুবলের কাছে তিনি নেহাতই শিশু।

 

***

 

১৬৮০

 

মধুমতী নদীর তীরে এই জঙ্গল বেশ ঘন। ভূষণার রাজারা এই অঞ্চলকে অবাধে বাড়তে দিয়েছে, তাদের কেল্লার সুরক্ষার জন্য। এই ঘন জঙ্গলের অধিবাসীবৃন্দ তাদের প্রাকৃতিক সুরক্ষা-কবজ।

            বালক রামরূপ-র ভারী ভালো লাগে এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে। সবাই ব্যঙ্গ করে বলে গরিবের ঘোড়া-রোগ, ঘোষের পো কোথায় গরু চরাবে তা নয়, শিকারের রোগ...।

            জঙ্গলে একার মতো এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় রামরূপ। কাকেদের সঙ্গে কথা বলে, কাকেরাও তার কথায় সাড়া দেয়। প্রত্যেকটা পশুপাখির নির্দিষ্ট স্বর আছে। স্বর নকল করতে পারলেই হল।টাই সবথেকে মজার লাগে রামরূপে

            কিন্তু আজ যেন কেমন লাগছে! দু'-একটা খরগোশ, খ্যাঁকশিয়ালের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সবার মধ্যেই কেমন যেন ত্রস্ত ভাব। যে-ক’টা পাখির সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারা খালি ভয়ে উড়ে পালাতে চায়। দূর থেকে একখানি বৃংহণ কানে আসছে বটে, কিন্তু সেই সুর বড়ো অচেনা।

            সাতপাঁচ ভেবে গাছে উঠে একবার পর্যবেক্ষণ করতে চাইছিল রামরূপ। কিন্তু তার আগেই দুড়দাড় করে গাছপালা ভেঙে পাহাড়ের মতো এগিয়ে এল গজপতি। তার চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্টতই পড়া যায় শত্রুতা। চোখে চোখ রেখে শান্ত করার চেষ্টা করল রামরূপ কিন্তু বৃথা চেষ্টা...! ভীম বেগে সেই গজপতি ছুটে আসছে তার দিকে। অতি দ্রুত পাশের গাছটায় উঠে গেল রামরূপ। অযথা সে কোনদিন পশু-হত্যা করেনি। কিন্তু আজ তাই-ই করতে হবে।

            কোমর থেকে সুদীর্ঘ ছোরাখানা বের করে গাছের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ল হাতিটার ঘাড়ে। তারপর বারবার, সাতবার বিঁধিয়ে দিল ছোরাটা গজপতির কপালের ফাঁপা জায়গাটায়। হ্যাঁ, এই ভয়ংকর হাতি তাকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল বারবার। কিন্তু রামরূপেরও গায়ের জোর সাংঘাতিক।

            হাতির ডান কানটি সেই যে মুড়ে ধরেছিল, এই রাজহস্তী এত চেষ্টা করেও তাকে ছাড়াতে পারেনি। হাতিসুদ্ধ মাটিতে পড়ল রামরূপ।

            তবে ভয়ে পালিয়ে গেল না, চুপ করে বসে রইল গজপতির স্থির হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। গজপতি স্থির হয়ে যেতে একখানা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল তার বুক থেকে। এইদিকে রামরূপ যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, অন্যদিকে আর-কজন সন্তুষ্টির হাসি হাসছেন। তিনি রায়-বাড়ির অস্ত্রগুরু; যোগ্য শিষ্যের খোঁজ করে চলেছিলেন এতদিন। এতদিনে বুঝি পেলেন তাকে। এই বালক এত বড়ো হস্তীকে যে শুধু হত্যা করেছে তাই নয়, এই হস্তীকে পর্যুদস্ত করার সময় বালকের কৌশল তাঁকে মুগ্ধ করেছে। একে তৈরি করতে হবে।

 

***

 

১৭১৩

 

গদাম গদাম করে কুঠারের ঘা পড়ছে আবু তোরাবের আরবি ইস্পাতে ঢালের উপর। তার প্রতিপক্ষ আর কেউ ন সে-দিনের সেই বালক রামরূপ। আজকের 'মেনা হাতি', যে ভালো খালি হাতে হাতিকে বধ করতে পারেতাঁর নামের সঙ্গে সেই ইতিহাসকে জুড়ে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন গুরু। তাই রামরূপ ঘোষের নতুন নাম দিয়েছিলেন 'মেনা হাতি'। অর্থাৎ 'মানুষ হাতি'

            দিনের পর দিন গুরুর অস্ত্রশিক্ষায় মেনা পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন গেরিলা যুদ্ধে।

            মুঘল সুবেদার আর সৈন্যদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন মেনা। তারপর সময় এসেছিল মুখোমুখি সংঘর্ষের, যে-দিন সীতারাম রায় তাঁকে আদেশ দিয়েছিলেন ভূষণা কেল্লা দখল করতে হবে।

            যেমনটা বলেছিলাম, মধুমতী নদী এবং তার আশেপাশের অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ঢাকা, এই জঙ্গল মূলত রক্ষাকবচের কাজ করত। রাতের অন্ধকারে ছিপ নৌকা ভাসিয়ে আশেপাশের অঞ্চলকে আরও সুদৃঢ় করে তুলেছিলেন মেনা হাতি

            আমাদের বাহিনী মূলত তিন ভাগে বিভক্ত ছিল; অগ্রবর্তি বাহিনী মেনা হাতি, জলবাহিনী ফকির মাছকাট্টা, হাওদা রূপ ঢালি।

            গাছের ঘন ডালপাতার আড়ালে বড়ো বড়ো হাওদা বন্দুক পিঠে করে উঠে যেত গোধিকার দল। একসঙ্গে দুইটি বা তিনটি গোধিকাকে একসঙ্গে জুতে তাদের পিঠে বেঁধে দেওয়া হত হাওদা বন্দুক। তারা উপরে উঠে অপেক্ষা করত। পিছু পিছু উঠবে বরকন্দাজের দল। দিনের পর দিন প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল গোধিকাদের। সেই প্রশিক্ষণ কাজে লাগল যুদ্ধের দিন। ভুষণা কেল্লার অধিপতি আবু তোরাব, বক্স আলি নিশ্চিত ছিলেন তাঁদের সম্মুখভাগের নদীর দিক থেকে কেউ মুখোমুখি হতে পারবে না। কিন্তু যখন কেল্লার প্রাচীরের উচ্চতায় বসে থাকা সৈনিকরা একের পর এক বিদ্ধ হতে লাগল, তখন হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ দূরপাল্লার হাওদা বন্দুক ছাড়া নদী পেরিয়ে গুলি এ দিকে আসবে না। আর দ্বিতীয়ত, উচ্চতা বলে দিচ্ছে, গাছের মাথায় বসানো আছে হাওদা বন্দুক। ত ভারী বন্দুক গাছের মাথায় তোলা একপ্রকার অসম্ভব।

            দ্রুত অবস্থা সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন তাঁরা কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সেই সুযোগে জলপথ থেকে সেনারা প্রবেশ করল জঙ্গলে। অরক্ষিত হল কেল্লার সম্মুখ ভাগ জালের মতো বিছিয়ে থাকা জলপথ বেয়ে প্রবেশ করল অসংখ্য ছিপ নৌকা।

            পিলপিল করে ডাঙ্গায় নেমে পড়েছিল সীতারামের বাহিনী।

 

***

 

আর টিকতে পারল না ইরানি ইস্পাতের ঢালটা। দু'ফাঁক হয়ে গেল কুঠারের আঘাতে, চোখ বন্ধ করে ফেললেন আবু তোরাব।

            মুহূর্ত পরে, জয়ধ্বনি উঠল শতশত বাঙালির কণ্ঠে। কেল্লা প্রাকারে উঠে দাঁড়িয়েছেন মেনা, হাতে ধরা রক্তাক্ত নরমুণ্ড... তাঁর মাথার শিরস্ত্রাণে চকচক করছে চারগাছা সবুজ-লাল পালক, কেল্লাদার!

 

ইতিহাস বড়ো কৃপণ। তাই সে-দিনের সেই সংগ্রাম, ভুষণার কেল্লা দখল, বাঙালির বীরত্ব সে ধরে রাখেনি। কিন্তু বাঙালি হিসাবে এ আমাদের কর্তব্য

            যেতে যেতে আরও দু'টি কথা বলে যাই, মেনা হাতি সারা জীবন ধরে যা উপার্জন করেছিলেন, বিলিয়ে গিয়েছিলেন হতভাগ্য কর-পীড়িত আপামর বাঙালি-সাধারণের মধ্যে।


___________________________________________________________________________


প্রতিরোধে বীর ভারত-সন্তান ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলি পড়ুন:

প্রথম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post.html

দ্বিতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_13.html

তৃতীয় পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_20.html

চতুর্থ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

পঞ্চম পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/06/blog-post_24.html

ষষ্ঠ পর্ব:  https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post.html 

সপ্তম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_12.html

অষ্টম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_19.html

নবম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

দশম পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/07/blog-post_27.html

একাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_88.html

দ্বাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_15.html

ত্রয়োদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_24.html

চতুর্দশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/08/blog-post_30.html

পঞ্চদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post.html

ষোড়শ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_13.html

সপ্তদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/09/blog-post_20.html

অষ্টাদশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/10/blog-post_11.html

ঊনবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/10/blog-post_25.html

বিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post.html

একবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post_8.html 

দ্বাবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post_16.html

ত্রয়োবিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post_22.html

চতুর্বিংশ পর্ব: https://blogs.antareep.in/2025/11/blog-post_29.html

 

মন্তব্যসমূহ